মঙ্গলবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করে তবে কি ভুল করেছি?

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করে তবে কি ভুল করেছি?

কদিন কেন যেন মনে হচ্ছে তবে কি মুক্তিযুদ্ধ করে, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করে ভুল করেছি? তা না হলে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে জীবনের বিরাট অংশ অবহেলা-অনাদরে কাটিয়ে আমরা শত্রু হলাম আর বঙ্গবন্ধু হত্যাকে যারা সমর্থন করেছেন, দাঁত কেলিয়ে হেসেছেন তারাই আজকাল পরম সম্মানিত! বড় কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে লাইব্রেরিতে যাওয়া অনেকটা বদভ্যাস হয়ে গেছে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের লাইব্রেরি খুবই সমৃদ্ধ। কদিন আগে সেখানে কিছুক্ষণ ছিলাম। পুরনো পত্রিকা ওল্টাতে ওল্টাতে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর একটি উপসম্পাদকীয় পড়লাম। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর যখন লুকিয়ে ছিলাম, তখনো লেখাটি পড়েছিলাম। আবার পড়তে গিয়ে দেহ-মন বিক্ষোভে ফেটে পড়তে চাইছিল। তাই আজকের লেখা ইত্তেফাকের আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে নিয়েই শুরু করছি। ‘প্রসঙ্গ : দেশ ও জাতি’ শীর্ষক ওই উপসম্পাদকীয়তে তিনি লিখেছেন ‘কয়েক দিন ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভুগিয়া উঠিয়াছি। শরীর এখনো দুর্বল। বর্তমান সরকার দৈনিক ইত্তেফাক আমাদের হাতে ফিরাইয়া দিয়াছেন, ইহাকে পুনরায় নিজেদের ব্যবস্থাপনায় চালু করিতে গিয়া গত কয়েক দিন আমাদের সকলকে ব্যস্ত থাকিতে হইয়াছে। শারীরিক এই দুর্বলতা ও ব্যস্ততা সত্ত্বেও দেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বক্তব্য পাঠক সাধারণের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন বোধ করিতেছি।

প্রথমেই বলিতে হয়, দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের কথা। এই পরিবর্তন আকস্মিক, তবে অস্বাভাবিক নয়। প্রকৃতির যে নিয়ম, সেই নিয়মের বাইরে কেউ যাইতে পারে না। নদীর স্বাভাবিক গতিপথকে যদি রুদ্ধ করিয়া দেওয়া হয়, তবে নদীর জলরাশি অস্বাভাবিক উপায়ে হইলেও উহার গতিপথ সৃষ্টি করিয়া নিবে। ইহা প্রকৃতিদত্ত নিয়ম। পৃথিবীতে এই নিয়মের ব্যত্যয় কখনো ঘটে নাই, ঘটিতেও পারে না। বাংলাদেশে মানুষের কল্যাণে ও মঙ্গলের নাম করিয়া যে ব্যবস্থাটি দাঁড় করানো হইতেছিল, আপামর দেশবাসীর মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে গোটা ব্যবস্থাটি সেখানে মুষ্টিমেয় দ্বারা কুক্ষিগত করা হইয়াছিল, বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল গণমানুষের নিয়মতান্ত্রিক আত্মপ্রকাশের পথ। এই সর্বগ্রাসী ব্যবস্থার দ্বারা মানুষ নিষ্পেষিত হইতেছিল, ভাঙ্গা বুকের যাতনা ও হতাশা তীব্র হইতে তীব্রতর হইতেছিল। এর যে কোথায় শেষ, কেহ ভাবিয়া পাইতেছিল না। এই অবস্থায় প্রকৃতির নিয়মেই একটা পথ সৃষ্টি হইয়াছে। বলা যায়, মুষ্টিমেয় কিছু লোকের দ্বারা কুক্ষিগত সেই সর্বগ্রাসী ব্যবস্থার ফলেই বর্তমানের রাজনৈতিক পরিবর্তনটি দেশের সর্বাত্মক পরিস্থিতির দুঃসহ অবস্থায় অবধারিত হইয়া উঠিয়াছিল।

এই নূতন রাজনৈতিক পরিবর্তনটি সাধিত হইয়াছে প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে, সেনাবাহিনীর দ্বারা। এই পরিবর্তন সাধনে তরুণ সামরিক অফিসারদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বলা যায়, দেশের একটা অসম্ভব দুঃসহ অবস্থার বিলোপ ঘটাইয়াছেন তারা এবং জাতির সামনে সৃষ্টি করিয়াছেন চলার উপযোগী পথ ও সুযোগ। এই কাজের জন্য তারা গোটা জাতিরই অভিনন্দন লাভের যোগ্য। গোটা জাতি যে সময় দিগিবদিক জ্ঞানশূন্য অবস্থায় শুধু নিচের দিকে তলাইয়া যাইতেছিল, সেই সময় তারাই জীবনের ঝুঁকি নিয়া এই পরিবর্তন সাধন করিয়াছেন। ব্যক্তি পর্যায়ে কাহারও জন্য দুঃখ-শোক বা সহানুভূতি প্রকাশের চাইতেও জাতীয় স্বার্থের দিকটা বড় করিয়া দেখার যে আবশ্যকতা, সেই বিবেচনায় এই নূতন রাজনৈতিক পরিবর্তনকে স্বাগত জানাইতে হইবে।’ আরও অনেক কিছু আছে কিন্তু আজ এটুকুই থাক।

বঙ্গবন্ধু অনেক সময় বলতেন, ‘আল্লাহর মাইর দুনিয়ার বাইর, যখন মারে তল পেটে মারে। তখন কেউ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।’ কী বিচিত্র ব্যাপার! কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার বিশাল ঈদের জামাতকে কোনো কোনো মিডিয়া সরাসরি প্রচার করে ঈদের জামাতের চেয়ে প্রচারের মাহাত্ম্য বেশি করে ফেলেছিল। অনেকের ধারণা ২৫০ বছরের পুরনো জামাত কারও দাবি ১৮০-১৯০ বছর। সে যাই হোক। এই ভূখণ্ডে মুসলমানদের আবির্ভাব প্রায় হাজার বছর আগে। তাই ওই সময়ের মধ্যে হলেই হলো। কত লোক হলো ঈদের জামাতে সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে ঈদের জামাতে কারা শরিক হলেন, তাদের ইমান-আকিদা কতটা। আর যিনি জামাত পরিচালনা করলেন তার আল্লাহর প্রতি কতটা ভয়, কতটা আনুগত্য সেটাই বিবেচ্য। কিন্তু শোলাকিয়ায় জামাত এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে ঈদের নামাজ সেখানে মুখ্য ছিল না, মুখ্য হয়ে উঠেছিল জনসভার মতো লোকজন কত। জনাব মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসঊদ শেষের দিকে বেশ কয়েকবার শোলাকিয়ায় নামাজ পড়িয়েছেন। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে তার খুতবা শুনেছি তাতে মারাত্মক অহংকারের আভাস পেয়েছি। আল্লাহ অহংকারীকে পছন্দ করেন না। আগে হোক পরে হোক আল্লাহ রব্বুল আলামিন অহংকারীর গলা টিপে ধরেন। কাউকে সময় দেন আবার কাউকে একেবারেই দেন না। লাখ লাখ নামাজির সামনে তার খুতবা হয়তো আল্লাহর পছন্দ নয়। তাই হাতে হাতে ফল দিয়েছেন। ১২০০ পুলিশ পাহারায় ২০০ নামাজির জামাতে তাকে অংশ নিতে হয়েছে। এটাই আল্লাহর বিচার। এভাবেই আল্লাহ বিচার করেন। আল্লাহ তার কোরআনে স্পষ্ট বলেছেন, তিনি মশার উপমা দিতেও কুণ্ঠা বা লজ্জাবোধ করেন না।

দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনায় নিদারুণ কষ্টে সময় কাটছে। কোনো ঈদে এত মানুষ শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় কখনো প্রাণ হারায়নি। সেতু ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আমার খুবই প্রিয়। কিন্তু রাস্তাঘাটের দুর্গতি ও এত জীবনহানি দেখে স্থির থাকতে পারছি না। তাকে আর কী বলব? সেদিনও বলেছি এত মৃত্যু দেখে আপনার কি কোনো কষ্ট হয় না? আমি জানি তারও কষ্ট হয়। কিন্তু কিছুই করার নেই। সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে হাতছাড়া হয়ে গেছে। এটা অনেকে মুখ ফুটে বলতে পারছেন না বা বলতে চাচ্ছেন না। কতদিন আর হবে, দুই-আড়াই বছর। প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের ছেলে কক্সবাজার যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তার নামাজে জানাজায় শরিক হয়েছিলাম। প্রাণবন্ত নানক ছেলের মৃত্যুতে এক দিনে আধখানা হয়ে গিয়েছিল। তার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। আমরা আপনজন না খোয়ালে কেউ অন্যের ব্যথা বুঝতে চাই না। অহরহ ঢাকা-টাঙ্গাইল করি। গাড়িতে বসে নিজে যেমন অশান্তিতে থাকি তেমনই বাড়িঘরে আত্মীয়স্বজন শঙ্কায় থাকে। আপনজন বলেই ওবায়দুল কাদেরকে বলেছি সবাইকে নিয়ে আরেকটু যত্নবান হয়ে চেষ্টা করুন। তার যে নীতি-নৈতিকতা তাতে তার প্রতি এখনো আমার বিশ্বাস আছে তিনি আন্তরিকভাবেই একটা কিছু করবেন। তা না করলে ভারতের রেলমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মতো পদত্যাগ করে সরে যান। রেলমন্ত্রী হিসেবে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর পদত্যাগ ছিল একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরুর মন্ত্রিসভায় লাল বাহাদুর শাস্ত্রী যখন রেলমন্ত্রী তখন রেল দুর্ঘটনায় তিনি পদত্যাগ করেন। বন্ধুবান্ধব হিতৈষীরা শাস্ত্রীজিকে বোঝাতে চেষ্টা করেন সামান্য একটা রেল দুর্ঘটনার জন্য তিনি মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করবেন? এটা কেমন কথা, তিনি তো আর রেল চালান না। শাস্ত্রীজি বলেছিলেন, ‘রেলমন্ত্রী হিসেবে নিরাপদে রেল চলাচল আমার দায়িত্ব, আমি তাদের চালাই। যারা রেল চালায় আমি চালাতে পারিনি বলে জীবনহানি ঘটেছে। এর সম্পূর্ণ দায় আমার। কোনো যুক্তিতে সে দায় আমি অস্বীকার করতে পারি না। তাই পদত্যাগ করছি।’ অমন ন্যায়নীতি নৈতিকতার মানুষ এখন কোথায় পাব?

দেশের অশান্ত রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের ইদানীং বক্তব্য আমাকে আলোড়িত করেছে। সৈয়দ আশরাফকে আগাগোড়াই ভালোবাসি, স্নেহ করি। বয়সের কিছুটা পার্থক্য থাকলেও সব সময় বন্ধু হিসেবেই বিবেচনা করি। সেও আমাকে সব সময় একজন প্রকৃত বন্ধুই ভাবে। আশরাফের পরিবারে আমাদের ছিল অবারিত দ্বার। আশরাফের বোন রূপা, লিপি কোলেপিঠে মানুষ হয়েছে। আশরাফের মা আমায় খুব ভালোবাসতেন। আগেকার মানুষ ছিলেন আলাদা। রাজনৈতিক নেতাদের স্ত্রীরা আপন-পর ভাবতেন না। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, তার পরের দিনগুলো সুখে-দুঃখে যেভাবেই হোক সব সময় একটা চমৎকার সম্পর্ক থেকেছে। সেই সৈয়দ আশরাফ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে একজন জাতীয় নেতার মতো সবাই মিলে দেশের সামগ্রিক সমস্যা সমাধানে যে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন তা অভূতপূর্ব। ষড়যন্ত্রকারীরা যে কোনোভাবে জঙ্গি বা ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করতে পারলে আমাদের কারোর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। কি সরকারি কি বিরোধী— তখন আমরা সব সমান হয়ে যাব। এ ক্ষেত্রে কোমরে গামছা বেঁধে সবাইকে একাত্ম, এক প্রাণ হয়ে মোকাবিলা করতে হবে। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিনাশের যে কোনো চেষ্টা বা তত্পরতা সমূলে বিনাশ করতে হবে। আর রাজনৈতিক দল হিসেবে এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের যেমন ঠিক সরকারের তেমন অগ্রণী ভূমিকা পালন করা দরকার। এ ক্ষেত্রে দলমতের তেমন পার্থক্য থাকা উচিত নয়।

গত পরশু রামপুরে এক জনসভায় গিয়েছিলাম। ঝড়-তুফানের মধ্যে গত ১৫-২০ বছর অত বিপুল জনসমাগমে অমন স্বতঃস্ফূর্ত জনসভা আর একটাও দেখিনি বা করিনি। মানুষের মধ্যে প্রশ্ন— দীর্ঘ এক বছর কালিহাতী উপনির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে কেন? সব আসনেই কি সরকারি দল জিতবে? এক ফুলে কখনো বাগান হয়? তাহলে এমনটা কেন? কালিহাতীর জনগণ অনতিবিলম্বে নির্বাচন চায়। কলাকৌশল করে ঠেকিয়ে রাখুন কেউ চায় না। বরং সরকারের জন্য হিতে বিপরীত হচ্ছে। আমার বিশ্বাস সরকারের সবাই বুদ্ধিহীন নয়। বিবেকবান-বুদ্ধিমান অনেকেই আছেন। তারা জনগণকে মর্যাদা দেবেন। জনগণের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্যই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জনগণকে তাই অসম্মান ও বঞ্চিত করা কোনো কাজের কথা নয়।

লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর