শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

গৃহবন্দী রাজনীতি

মেজর (অব.) মো. আখতারুজ্জামান

গৃহবন্দী রাজনীতি

নির্দ্বিধায় রাজনীতি এখন সম্পূর্ণ গৃহে বন্দী। সরকারি দল বা তাদের অনুগত বা পোষ্য ছাড়া কারও পক্ষে প্রকাশ্যে রাজনীতির কার্যক্রম চালানো এখন সম্ভব নয়। সম্প্রতি বিএনপি একটি জনসভা করতে চেয়েছিল কিন্তু সরকার তাদের অনুমতি দেয়নি। অথচ একই জায়গায় সরকারি দল কয়েক দিন আগেই ঘটা করে বিশাল সম্মেলন করেছে। সরকারি দলের সম্মেলনের একদিন পরে একই জায়গায় বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে সরকার তাদের অনুমতি দিয়েছিল।  কেন সরকারি দল বা তাদের মিত্ররা জনসমাবেশ করতে পারবে এবং কেন সরকারের প্রতিপক্ষরা জনসভা করতে পারবে না তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাও নেই। সরকার তার গায়ের জোরে এখন দেশ চালাচ্ছে। তবে সবচেয়ে বড় দুঃখজনক হলো দেশে কোনো সাহসী বিরোধী দলও নেই।

রাজনীতি এখন চলছে প্রেসক্লাবের ভিতরে। তাদের ছোট-বড় কয়েকটি হলরুম ও কক্ষ আছে। কিছু প্যাডসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের রাজনৈতিক দল প্রতিদিন প্রেস ক্লাবের বিভিন্ন কক্ষ ভাড়া নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে সেমিনার, আলোচনা সভা, গোলটেবিল, লম্বা টেবিল, মৃত্যুবার্ষিকী, জন্মবার্ষিকী, আগমন দিবস, প্রত্যাগমন দিবস, জেলে যাওয়া দিবস, জেল থেকে মুক্তি পাওয়া দিবস, সংবর্ধনা দিবস ইত্যাদি ঘটনা উপলক্ষ করে বিরোধী দলের নেতাদের নিয়ে আসেন। যেখানে  নেতারা পাকা পাকা কথা বলে চা-বিস্কুট খেয়ে চলে যান। বেশির ভাগ অনুষ্ঠানে তেমন কোনো দর্শক থাকে না, তবে অগণিত টিভি সম্প্রচার কেন্দ্র ও সংবাদপত্র থাকায় তাদের বক্তব্য প্রচার-প্রচারণার প্রচুর সুযোগ থাকে। যার ফলে বিভিন্ন পদ-পদবির রাজনৈতিক বীর নেতাদের ডাক দিলেই তারা প্রেসক্লাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এতে অবশ্য প্রেসক্লাবের টুপাইস কামাই হচ্ছে কিন্তু রাজনীতি ঘরে বন্দী হয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের ঘরোয়া পরিবেশে জনগণকে সঙ্গে না নিয়ে নেতাদের বাগাড়ম্ভর বক্তব্য দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদের বিভ্রান্ত করে ও বিপদে ফেলে দেয়।

এই রাজনৈতিক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে সম্প্রতি যোগ হয়েছে জাতীয় নেতা-নেত্রী বা দলপ্রধানদের সংবাদ সম্মেলনের এবং সেটি আবার সরকারের নিয়ন্ত্রিত বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট পাঁচতারা হোটেলে। দলের কার্যালয়ে বা অন্য কোনো হল বা খোলা স্থানে দলের শীর্ষ নেতাদের প্রেস কনফারেন্স করতেও দেওয়া হয় না। রাজনীতি এখন সম্পূর্ণ সরকারের নিয়ন্ত্রণে। বর্তমান সরকারপ্রধান সরকার এবং তার নিজ জোটসহ নিজের দল চালাচ্ছেন, চালাচ্ছেন সংসদের বিরোধী দল, যারা সরকারের হাতের পুতুল। সেই সঙ্গে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চালাচ্ছেন দেশের সবচেয়ে বড় বিরোধী দলটিও। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় কিন্তু তারপরও চরম বাস্তবতা হলো সব কিছুই দারুণভাবে নিয়ন্ত্রিত।

সরকারি দলের নেতারা সারা দেশে সভা-সমাবেশ করে বেড়াচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রকাশ্য নির্দেশে আগামী নির্বাচনের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। সভা-সমাবেশে বিএনপির নেত্রীকে, তার পরিবারকে, দলের প্রতিষ্ঠাতাকে গালিগালাজ করছে অথচ বিএনপি তার আত্মপক্ষ সমর্থন করে কোনো বক্তব্য রাখতেও সাহস পাচ্ছে না। আমি অবশ্যই এ জন্য সরকারকে দায়ী করব না। সরকার তো চাবেই সব কিছু তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে। সরকার তো তার মতো করেই দেশ চালাবে। কিন্তু বিরোধী দল কেন সরকারের সব কিছু মেনে নেবে? আমি বলছি না সরকারের কাজে বাধা দেওয়া বিরোধী দলের দায়িত্ব। কিন্তু সরকারের প্রতিটি কাজের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা এবং তার মন্দ দিকটা জনগণের সামনে তুলে ধরা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক দায়িত্ব, যা কোনো অজুহাতেই সরকারবিরোধীরা এড়িয়ে যেতে পারে না। এখানেই ত্যাগের প্রশ্ন, রাজনৈতিক সাহসের প্রশ্ন। এখানে সংঘাত বা সহিংসতার প্রশ্ন নয়। জীবন বাজি রেখে জেল-জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে জনগণের স্বার্থের কথা, জনকল্যাণের কথা, জনগণের অধিকারের কথা মাথা তুলে বুক চেতিয়ে বলতে হবে। এটি রাজনৈতিক দায়িত্ব। আমি সহিংস রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না কিন্তু কেউ যদি আমাকে হিংস্র থাবা দিয়ে জনগণের অধিকারের কথা বলার জন্য আমাকে দমন করতে চায়, আমার কণ্ঠ রোধ করতে চায় তাহলে অবশ্যই জনগণকে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য হিংস্রতার বিপক্ষে রুখে দাঁড়ানোর পথ বেছে নিতে আহ্বান জানাব। এ আমার রাজনৈতিক অধিকার। আমার রাজনৈতিক দায়িত্ব। এখানে আপস করার কোনো সুযোগ নেই। থাকতে পারে না। তাহলে রাজনীতি থাকে না। থাকে না দেশপ্রেম। রাজনীতি ক্ষমতার পালাবদল নয়। রাজনীতি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার। জনগণের সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা ক্ষমতায় থেকেও যেমন করা যায় তেমনি ক্ষমতার বাইরে থেকেও করা যায়।

 

 

আমরা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিশ্বাস করি এবং এই বিশ্বাস অব্যাহত রাখতে চাই। সরকার নির্বাচিত হওয়াই শুধু গণতন্ত্র নয়। অনেক রাজনৈতিক দল এবং আমার নিজের দলও বিগত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। অনেকে তাই এই সরকারকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার নয় বলে আখ্যা দিয়ে যাচ্ছে, আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। কারণ যে কোনো খেলায় ওয়াক ওভার দিলে জয়ী দলের জয়কে যেমন অস্বীকার করা যায় না তেমনি কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করলে তা কখনই অবৈধ হয়ে যায় না। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও তার ন্যাপ ’৭০-এর নির্বাচন বয়কট করার পরও সে নির্বাচন কিন্তু অবৈধ হয়নি। এমনকি স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত মুসলিম লীগও সেই নির্বাচনকে অস্বীকার করে না। আমরা ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করিনি। নির্বাচন প্রতিহত করতে চেয়েছিলাম কিন্তু জনগণ আমাদের সঙ্গে ছিল না। যার ফলে ওই নির্বাচন আমরা প্রতিহত করতে পারিনি। একই অবস্থা হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনেও। সেদিন আওয়ামী লীগ নির্বাচন প্রতিহত করতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। পার্থক্যটা হলো ১৯৯৬-এর নির্বাচনের নির্বাচিত সরকার টিকতে পারেনি অথচ আমাদের দুর্ভাগ্য হলো ২০১৪ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত সরকার এখনো টিকে আছে। রাজনীতির চরম ও কঠিন বাস্তবতা হলো রাজনীতিতে পরাজিতের কোনো স্থান নেই, মূল্য নেই। তবে রাজনীতিতে চূড়ান্ত জয় বা পরাজয় নেই। এটি সদা চলমান প্রক্রিয়া। রাজনীতিতে যে কোনো সময় জয়ী পরাজিত হতে পারে এবং পরাজিতও আবার জয়ী হতে পারে। কাজেই এই সরকারের নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে আমার কোনো প্রশ্ন নেই। তবে এই সরকার যেভাবে দেশ চালাচ্ছে তাকে আমি কখনই গণতান্ত্রিক বলব না। কারণ আমি মনে করি এই সরকার বর্তমানে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে দেশ চালাচ্ছে। এখানে সরকারবিরোধীদের কোনো স্থানই দেওয়া হচ্ছে না। শুধু জামায়াত বা যুদ্ধাপরাধীদেরই নয়, মুক্তিযোদ্ধাদেরও সরকারের নীতি বা কর্মের সমালোচনার অধিকারটিকে গলা টিপে ধরা হচ্ছে। যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সরকার যা কিছু করছে, যেভাবেই করছে তার সব কিছুই তার মতো করে— তার স্বার্থসিদ্ধি করে করছে। ভিন্নমত বা জাতির সার্বিক স্বার্থ ও জনকল্যাণকে সরকার কোনো তোয়াক্কাই করছে না। 

সরকার রাষ্ট্র সব একদলীয় হয়ে গেছে। সব কিছু সরকার নিজের দলের মধ্যে নিয়ে এসে একাকার করে ফেলছে। এখানে সরকারি দলের বা তাদের অনুসারীদের পক্ষে না হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরিও পাওয়া যায় না, না হলে টাকা লাগে। দলীয় অন্ধ আনুগত্যের নামে সারা দেশে কোটি কোটি মানুষের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। লীগের বাইরের মানুষকে বিসিএস ক্যাডার তো দূরের কথা সাধারণ পিয়নের চাকরিও দেওয়া হয় না, প্রমোশন তো স্বপ্নের ব্যাপার। ব্যবসা-বাণিজ্য কোনো কিছুতেই লীগের বাইরে কাউকে ন্যূনতম সুযোগটিও দেওয়া হয় না। তার উপরে জায়গা-জমি দখল, টেন্ডার বাণিজ্য, বিদেশি বিনিয়োগ, সরকারবিরোধীদের ব্যবসা-বাণিজ্য দখল করে নেওয়া ইত্যাদি জবরদখলের রাজনীতি চলছে। সারা দেশে এখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা বিরাজ করছে। সরকারি দলের বাইরের জনগণের এখন নাভিশ্বাস। সবাই এর থেকে মুক্তি চাচ্ছে কিন্তু একটি দায়িত্বশীল সাহসী বিরোধী দলের অভাবে বর্তমান বেপরোয়া সরকারের লাগাম টেনেও ধরা যাচ্ছে না।

বিরোধী দলেও গণতন্ত্র নেই, জবাবদিহিতা নেই। নিরাপত্তার চাদরে যেমন সরকারপ্রধান জনবিচ্ছিন্ন তেমনি জীবন রক্ষায় শঙ্কিত বিরোধী দলের নেত্রীও স্বেচ্ছায় কারারুদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী এখন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তৃতা দেন। সেই বক্তৃতায় জনগণের চেহারায় কি ভাব ফুটে তা দেখার ক্ষমতা যেমন প্রধানমন্ত্রীর নেই তেমনি বিরোধী দলের প্রেস কনফারেন্সের বক্তব্যে জনগণের মনে কতটুকু সাড়া তুলে তাদের বিক্ষুব্ধ করে তাও তিনি দেখতে পারেন না। তাই জনমত জানার জন্য দুই নেত্রীকেই নির্ভর করতে হয় চারপাশের তথাকথিত ক্ষমতাশীল চাটুকারদের ওপরে। নেত্রীদের সত্য জানার কোনো উপায় নেই। আজকের রাজনীতিতে মিছিলের আগে নেতারা থাকেন না। জনসভায় মিছিল করে কর্মীরা আসে না। গাড়িতে করে জনসমাবেশে লোক আনতে হয়। আনতে হয় ভাড়া করে। রাজনীতি এখন মেকি। ভাড়া করা নেতা, ভাড়া করা কর্মী। এখন রাজনৈতিক চাঁদাবাজি গোপনে হয় না। যে যত বেশি চাঁদা দিতে পারে সে তত বড় নেতা। দুই নেত্রীর বড় বড় উপদেষ্টাদের দিকে তাকালেই দেখা যাবে রাজনীতি এখন কাদের উপদেশে চলছে। এখন দুই নেত্রীই ঘরে বসেই সব কিছু পাচ্ছেন! মাঠে এখন আর রাজনীতি নেই। কর্মী বা কাউন্সিলরদের সামনে এখন দলের কেন্দ্রসহ সব পর্যায়ের কমিটি প্রকাশ্যভাবে ঘোষিত হয় না। যদি কাউন্সিলরদের সামনে ঘোষণা দেওয়া হতো তাহলে নেত্রীরা দেখতে পেতেন কত জোরে ‘মানি না’ স্লোগান উঠত। কিন্তু এখন সাধারণ সম্পাদক বা মহাসচিব বা বড় বড় নেতা বা উপদেষ্টাদের পদের নাম ঘোষণা হয় রাতের অন্ধকারে এবং বিভিন্ন সময়ে এলানের মাধ্যমে। এখন রাজনৈতিক বড় দলে নেতা নেই আছে শুধু কর্মচারী যাদের চাকরিরও নিশ্চয়তা নেই! নির্দেশ না শুনলে তাত্ক্ষণিক বিদায়। টুঁ শব্দটি করার ক্ষমতাও তাদের নেই। হায়রে রাজনৈতিক নেতৃত্ব!!

বাংলাদেশের রাজনীতি এখন দুটি ঘরে বন্দী। ওই দুটি ঘর থেকে যখন যে এলান আসবে রাজনীতি সেভাবেই চলবে। জনমত, জনকল্যাণ, জনস্বার্থ এইগুলো কোনো কিছুরই এখন মূল্য নেই। ওই দুই গৃহের যা স্বার্থ জনগণের তাই স্বার্থ(!), ওই গৃহদ্বয়ের যা মত জনগণেরও তাই মত(!), ওই দুই গৃহের যা কল্যাণ জনগণের কল্যাণও তাই হতে হবে! এর বাইরে যারাই যাবে তারাই সন্ত্রাসী, জঙ্গি, স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, দলের শৃঙ্খলাবিরোধী। তাঁবেদারি-চাটুকারিতা ছাড়া এখন কোনো নেতা-কর্মীর স্থান নেই। রাজনীতি দুই নেত্রীর হাতের মুঠোয়।  রাজনীতি এখন তাদের ঘরে বন্দী।

তবে মনে হয় এ অবস্থা জনগণ বেশি দিন মেনে নেবে না। নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়ে গেছে। সাগর ফুঁসছে। সিগন্যাল দিন দিন বাড়বে। ঝড় অবশ্যম্ভাবী। পুবাকাশে উঠবে আবার নতুন সূর্য। আমরা আশাবাদী। আমরা সুন্দর স্বপ্ন দেখি।  স্বপ্ন দেখি নতুনের, পরিবর্তনের। সামনে আমাদের সুদিন।  যা কিছু পুরনো জঞ্জাল তার থেকে মুক্তি। এখন অপেক্ষা শুধু সময়ের।

     লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর