শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

আল্লাহর রঙে নিজেদের আত্মাকে রাঙাতে হবে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

বিচিত্র এই পৃথিবীতে সবই কেমন অপরূপ রূপময়। অপরূপ রঙের খেলা যিনি খেলছেন তিনি আর কেউ নন। আমাদের স্রষ্টা আল্লাহতায়ালা। রঙের কারিগর আল্লাহ মানুষের জীবন রাঙাতে মানুষের জন্য নাজিল করেছেন আল-কোরআন। মানুষ এ কোরআন পড়বে, বুঝবে এবং বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করবে— এ তিন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিবর্ণ মানুষ সেজে উঠবে বর্ণিল সাজে, কোরআনের সাজে। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেছেন, ‘সিবগাতাল্লাহি ওয়ামান আহসানু মিনাল্লাহি সিবগাহ!’ অর্থাৎ ‘জীবনকে আল্লাহর রঙে রাঙাও। আল্লাহর রং থেকে আর কোন রং বেশি রঙিন?’ আল্লাহপাকের এই উদাত্ত আহ্বান গায়ে মেখেছিলেন স্বর্ণযুগের মানুষরা। অর্থাৎ সাহাবি, তাবেয়ি এবং তাবে তাবেয়িনরা। তাই তো কেয়ামত পর্যন্ত তারাই মানুষের হেদায়াতের নমুনা হয়ে বেঁচে থাকবেন। এদের উদ্দেশ্যেই আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘মুহাজির এবং আনসারদের মধ্যে যারা ইমানের রং ধারণের দিক থেকে এগিয়ে আছে এবং যারা আত্মায় ইমানের রং ধারণ করে তাদের অনুসরণ করছে— তাদের সবার ওপর আল্লাহ সন্তুষ্ট। এবং তারাও আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট।’ (সূরা তাওবাহ : ১০০।) রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর রং ধারণের দিক থেকে আমার যুগের মানুষই শ্রেষ্ঠ।’ (বুখারি ও মুসলিম)। আল্লাহর রঙে রঙিন মুসলমান যখন দাওয়াতের কাজে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ল, তখন তারা মানুষের চাকচিক্যময় জীবনাচার দেখে নিজের আত্মার রঙের কথা ভুলে গেল। লোভ, হিংসা, গীবত, ক্ষমতালিপ্সার মতো আত্মবিধ্বংসী রঙগুলো কীভাবে যেন মুসলমান গায়ে মেখে আত্মায় ধারণ করে নিল। সেই থেকে ইসলামের রং ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে মুসলমানের আত্মা থেকে। পৃথিবীজুড়ে আল্লাহর রঙে রঙিন মানুষের আজ বড় অভাব। আত্মার রং ভুলে পৃথিবীতে ধুঁকে ধুঁকে মরছে মুসলমান। অথচ তাদের কোনো হুঁশই হচ্ছে না, আত্মার ডাক্তারের খোঁজ করছে না কেউ। এরা সামান্য অসুস্থ হলেই দেশ-বিদেশে চিকিৎসার জন্য ছুটে যাচ্ছে। একটু ভালো থাকার জন্য, ভালো পরার জন্য কত ধরনের ফন্দির-ফিকিরই না করছে তারা। রাতে ভালো ঘুম হওয়ার জন্য অথবা কোথাও আরামে বসার জন্য মশা যেন কামড়াতে না পারে— এ কারণে তাদের কত চেষ্টা-প্রচেষ্টা। অথচ আল্লাহকে পাওয়ার জন্য কোনো প্রচেষ্টা নেই তাদের। বলছিলাম বিবর্ণ আত্মার মুসলমানদের কথা। জন্ম থেকেই তিলে তিলে তাদের আত্মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে ভাবনা নেই তাদের। মুসলমানের যত ভাবনা এ মাটির দেহটাকে নিয়েই। এ দেহকে সাজাতে, এ দেহকে রাঙাতে তাদের নিরন্তর প্রতিযোগিতা অমুসিলমদেরও আজ হার মানিয়েছে। মুসলমান আজ বুঝতে চায় না যে, এই দেহ খাঁচাটার মূল্য শুধু ওই প্রাণপাখিটা ছিল এটুকুই। পাখি ছাড়া এই খাঁচাটা আর কেউ ঘরে রাখে না, তবুও সেই খাঁচার যত্নেই বিভোর। বাংলাদেশের মতো দরিদ্রপ্রবণ একটি দেশের শহর-গ্রামের সবখানে এখন বিউটি পারলারে সয়লাব। মোড়ে মোড়ে একাধিক বিউটি পারলার মুসলিম জাতির বিবর্ণতাকেই যেন ফুটিয়ে তুলছে প্রকটভাবে। ভিতরে মরা জাতি এখন বাইরেও মরছে প্রতিনিয়ত। তাই তো বাইরে যে মানুষের রূপ দিয়েছেন আল্লাহতায়ালা নিজে, সেটাও বিউটিফাই করার জন্য কত অপচেষ্টা করছে তারা। বিউটি পারলারের অবস্থা দেখলে সেই গোলামের কথা মনে পড়ে যায়, যার মনিব গোলামকে দায়িত্ব দিয়েছিল খাঁচার পাখিকে সুস্থ রাখার জন্য। বোকা গোলাম পাখির কথা ভুলে গিয়ে খাঁচার প্রতি মনোযোগী হলো। খাঁচাকে ধোয়া-মোছাসহ সব ধরনের যত্নই করেছিল কিন্তু পাখির ব্যাপারে কোনো যত্নই নেয়নি সে। পাঠক মহলের কাছে জানতে চাই— বলুন তো, এ গোলামের ওপর তার মনিব সন্তুষ্ট থাকবেন নাকি অসন্তুষ্ট হবেন? এ গোলাম কি মনিবের শাস্তি পাওয়ার যোগ্য নয়? গোলাম কি পাগল এবং মানসিক বিকারগ্রস্ত নয়? তাহলে মহান মনিব আল্লাহ প্রদত্ত রুহ পাখির সঙ্গে আমরা গোলামরা যে আচরণ করছি তা কি সেই অবাধ্য গোলামের মতো হয়ে গেল না? আল্লাহ বলেছেন, ‘কাদ আফলাহা মান জাক্কাহা’ অর্থাৎ ‘যে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করল সে সফলকাম হলো’— আর আমরা এ কথা ভুলে কীভাবে দেহকে পরিশুদ্ধ করা যায়? সম্পদকে আরও বাড়ানো যায়— এই দুনিয়াবি ধান্ধায় মনোযোগী হয়ে পড়েছি। সুতরাং আমরা কি মালিকের শাস্তি পাওয়ার যোগ্য নই?  হে আমার মুসলমান ভাই! এখনো সময় আছে আল্লাহর রঙে আত্মাকে রাঙিয়ে নিন।  আত্মা আল্লাহর রং ধারণ করতে পারলে কিয়ামতে আল্লাহর দিদার মিলবে বান্দার।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর