শনিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

মোহন মিয়া : একজন স্বাপ্নিক রাজনীতিবিদ

অধ্যাপক আবদুল গফুর

মোহন মিয়া : একজন স্বাপ্নিক রাজনীতিবিদ

ইউসুফ আলী চৌধুরী ওরফে মোহন মিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর। তার পিতা খান সাহেব ময়েজউদ্দিন চৌধুরী সাধারণ অবস্থা থেকে নিজ চেষ্টায় একজন জমিদারে উন্নীত হন। মোহন মিয়ার জন্ম এমন এক সময়, যখন এ দেশের মুসলমান সমাজ শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি-বাকরি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, রাজনীতি, ধর্ম ও সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রে প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল। ফরিদপুর একটি মুসলিম প্রধান জেলা হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সব ক্ষেত্রে তারা ছিল পিছিয়ে। কিশোর বয়স থেকেই স্বজাতির কিসে মঙ্গল হবে এ চিন্তায় তিনি বিভোর থাকতেন। ফরিদপুর শহরে সে সময় মাত্র চার-পাঁচ ঘর মুসলমান পরিবার সচ্ছল অবস্থার অধিকারী ছিল। বাকি সবারই ছিল জরাজীর্ণ দশা। সংখ্যাগুরু মুসলমানদের প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রদর্শন ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। মোহন মিয়ার মধ্যে এর ফলে শৈশব-কৈশোরেই একটা প্রতিবাদী মন জন্মলাভ করে।

মোহন মিয়া শৈশব-কৈশোরে মুসলমান সমাজের অনেকেই অগ্রসর হিন্দু সমাজের দেখাদেখি ধুতি পরত, হিন্দুদের পূজায়-পার্বণে অংশগ্রহণ করত এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হিন্দু রীতিনীতি অনুকরণ করে এক ধরনের আত্মতুষ্টি অনুভব করত। মোহন মিয়া কখনো এ ধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগেননি। তিনি শৈশব থেকেই লুঙ্গি, পাজামা, শেরোয়ানি, টুপি ব্যবহার করতেন। সে সময় শহরের সব স্কুলে হিন্দুরা সরস্বতী পূজা উদযাপন করত মহা ধুমধামের সঙ্গে। মুসলমান ছেলেরাও সে উৎসবে যোগদান করত, এমনকি পূজার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জেলা বোর্ড তহবিল থেকে সহায়তা করা হতো। শিক্ষা সম্বন্ধে মোহন মিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি খুব বাস্তবমুখী ছিল। তিনি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমাজকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার দিকে লক্ষ্য রেখেই ফরিদপুর শহরের উপকণ্ঠে ‘বায়তুল আমান’ নামে একটি কৃষি শিল্প শিক্ষা প্রকল্প চালু করার প্রয়াস পান। বায়তুল আমান প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল পাঁচটি (এক) ইসলামের আদর্শ, কৃষ্টি ও সভ্যতায় অনুপ্রাণিত করে মানুষের মন গড়ে তোলা, (দুই) আধুনিক সভ্যতা ও বিজ্ঞানের সঙ্গে দেশবাসীর পরিচয় ও সম্পর্ক স্থাপন করা, (তিন) জনসাধারণের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ, কর্তব্যবোধ ও কর্মশক্তি সম্বন্ধে চেতনা সৃষ্টি করা, (চার) বিশ্বভ্রাতৃত্বের ভাবধারায় প্রত্যেককে আদর্শ নাগরিক ও সত্যিকার মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলা, (পাঁচ) জনসাধারণের মধ্যে আত্মোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। এই পাঁচটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই প্রকল্পে যেসব কর্মসূচি ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনার প্রস্তাব দেওয়া হয় তার মধ্যে ছিল— ১. আবাসিক স্কুল ও মাদ্রাসা, ২. শিল্প (ইন্ডাস্ট্রিয়াল) বিদ্যালয়, ৩. কৃষি ও ডেইরি ফার্ম, ৪. মৎস্য চাষ ৫. ছাপাখানা ও মুখপত্র, ৬ বায়তুল আমানের কর্মকর্তা-কর্মীদের আদর্শ বসতি, ৭. মসজিদ, ৮. লাইব্রেরি, ৯. ব্যায়ামাগার, ১০. মেহমানখানা, ১১. পল্লী উন্নয়ন এবং ১২. চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য। সেই ১৯৪৫ সালে তার অগ্রসর শিক্ষা পরিকল্পনা ছিল এককথায় বিস্ময়কর। শিক্ষা সম্বন্ধে এ ধরনের অগ্রসর চিন্তাধারা আমাদের দেশে আর মাত্র একজন রাজনৈতিক নেতার মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়। তিনি সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। নিজে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণেই হয়ত তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, পশ্চাত্পদ সমাজের উন্নতি সাধনে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। জমিদারি দায়িত্ব গ্রহণের পর তার প্রথম ও প্রধান চিন্তা ছিল কীভাবে শিক্ষার আলো মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে দেবেন। এই চিন্তার ফসলই ছিল ফরিদপুর শহরে ময়েজউদ্দিন হাই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা। জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র তিন বছরের মাথায় ১৯২৬ সালে তিনি এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করেন। আধুনিক শিক্ষা ও ধর্মশিক্ষার সমন্বয়ে নিউ স্কিম পদ্ধতির এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি শিক্ষার সঙ্গে আদর্শ ও বাস্তবতার নিগূঢ় সম্পর্কের ব্যাপারে তার প্রখর সজাগতারই প্রমাণ দেয়। শুধু শহরে নয়, গ্রামাঞ্চলেও যাতে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়তে পারে, তার জন্য তিনি বিলনলিয়া গ্রামে প্রতিষ্ঠা করলেন একটি জুনিয়র মাদ্রাসা। মমিন খাঁর হাটে প্রতিষ্ঠা করলেন একটি হাইস্কুল। সে সময় শহরে মুসলমান শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই আসত গ্রাম থেকে। শহরে বা আশপাশে জায়গীরের ব্যবস্থা করতে না পেরে অনেকেই উচ্চ শিক্ষার আশা চিরতরে বিসর্জন দিতে বাধ্য হতো। এ সমস্যা মোকাবিলা করতে মোহন মিয়া ১৯৩৮ সালে মুসলমান দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের বিনা পয়সায় থাকা-খাওয়ার সুবিধাসহ মুসলিম স্টুডেন্ট হোম নামক অভিনব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সারা বাংলার বুকে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের অন্য কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না।

নারীরা সমাজের অর্ধাংশ। নারী জাতিকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করে সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ উপলব্ধিতেই ১৯৩২ সালে ময়েজউদ্দিন হাই মাদ্রাসার অদূরে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন একটি জুনিয়র গার্লস মাদ্রাসা, যা এখনো তার স্মৃতি বহন করে হালিমা গার্লস হাইস্কুল নামে টিকে আছে। ফরিদপুর শহর ছাড়া তদানীন্তন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার অন্যত্র কোথাও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। তিনি যখন ফরিদপুর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তখন শিক্ষা উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষা ও শিক্ষার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জেলা বোর্ড তহবিল থেকে অর্থ দান করেছেন। শিক্ষা সম্পর্কে মোহন মিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি খুব বাস্তবমুখী ছিল। তিনি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমাজকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ফরিদপুর শহরের উপকণ্ঠে ‘বায়তুল আমান’ নামে একটি কৃষি, শিল্প, শিক্ষা প্রকল্প চালু করার প্রয়াস পান। মোহন মিয়ার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির মাধ্যমে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর শেরে বাংলা মুসলিম লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন করে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং পরে সদলবলে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৪০ সালে শেরে বাংলা যখন মুসলিম লীগ দলীয় প্রধানমন্ত্রী তখন মোহন মিয়া ফরিদপুর জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪১ সালে শেরে বাংলা মুসলিম লীগ ত্যাগ করে ‘শ্যামা হক’ মন্ত্রিসভা গঠন করলেও মোহন মিয়া মুসলিম লীগেই থেকে যান। ১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন নবরূপ পরিগ্রহ করে। ‘বাঁচ এবং বাঁচতে দাও’ এই নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান দাবিতে অচিরেই উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে। ফরিদপুর জেলার পাকিস্তান আন্দোলন অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন ইউসুফ আলী চৌধুরী ওরফে মোহন মিয়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এক পর্যায়ে তিনি প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে তিনি মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন এবং পরে শেরে বাংলা গঠিত কৃষক শ্রমিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদের সদস্য হিসেবে ১৯৫৬ সালে সংবিধান প্রণয়নে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখার ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে মার্শাল ল’ জারি হলে পাকিস্তান গণতন্ত্রের সম্ভাবনা একরকম রহিত হয়ে যায়। সেই ঘোর দুর্দিনে ষাটের দশকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখের নেতৃত্বে পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে যে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট গঠিত হয় তার অন্যতম নেতা ছিলেন ইউসুফ আলী চৌধুরী। পরবর্তীকালে দেশে স্বাধিকার আন্দোলন যখন জোরদার হয় তখন এমনকি একাত্তরে বাংলাদেশে স্বাধীনতার জন্য যে সংগ্রাম হয় তার প্রতিও মোহন মিয়া সাহেবের গভীর সমর্থন ছিল, যদিও আধিপত্যবাদী ভারতের সাহায্যে স্বাধীনতা  সংগ্রাম কতটা বাস্তবতাপ্রসূত এ সম্পর্কে তার বরাবরই একটা সংশয় ছিল। ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর তিনি অকস্মাৎ ইন্তেকাল করেন।

সর্বশেষ খবর