বুধবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ক্ষমতাসীনদের দাপট ও বিএনপির অসহায়ত্ব

আমীর খসরু

ক্ষমতাসীনদের দাপট ও বিএনপির অসহায়ত্ব

রাজনীতিতে এবং শাসন কাজে মাঝে মাঝে নীরবতা এবং সব কিছুই চুপচাপ ঠিকঠাক চলছে— অনেকের ধারণা মতে এমন একটি সময়কাল বর্তমানে অতিক্রান্ত হচ্ছে। জন অংশগ্রহণ যদিও এ গণতান্ত্রিক সমাজে দিনে দিনে কমেছে এবং এর দেখা পাওয়াটা এখন দুষ্কর। তবে জন অংশগ্রহণবিহীন কথিত গণতন্ত্রে কতটা সিস্টেমের অন্তর্গত দুর্বলতা অথবা শাসকসৃষ্ট এহেন পরিস্থিতি— তা নিয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা হতে পারে।  আওয়ামী লীগের সদ্য বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক এবং রাজনীতিতে অতিসজ্জন বলে পরিচিত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এ ধরনের নীরবতামূলক পরিস্থিতির বিদ্যমানতায় বেশ কিছুটা শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। অবশ্য সৈয়দ আশরাফের প্যাটার্নটাই এমন যে, তিনি আকার-ইঙ্গিতে বহু কথা বলেন, বহু কথা না বলেই। বিষয়টা এমন যে, ‘অনেক কথা যাও যে বলে, কোনো কথা না বলে।’ এসব নীরবতাকে কখনো কখনো অস্বস্তিকর, যাকে ইংরেজিতে ‘আনইজি কাম’ বলা হয়ে থাকে। আর এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণের মধ্যে কোনো কিছু নিয়েই এখন আর প্রকাশ্য কোনো মাথাব্যথা নেই। দিনে দিনে পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে তাতে এসব বিষয়ে তাদের মাথাও যেমন থাকবে না, তেমনি ব্যথারও কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

গণতন্ত্র সম্পর্কে প্রথমেই অতি সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা বৃহদাকার ধারণ করায় প্রতিনিধিত্বশীল শাসন ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে। তবে প্রতিনিধিত্বশীল শাসন ব্যবস্থার প্রণেতা এবং দার্শনিকরা নিজেরাই এ কথা গোড়াতেই কবুল করে নিয়েছেন যে, আদতে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ব্যবস্থাটি ঘুরেফিরে সেই কতিপয়ের শাসনই পরিণত হয়— যদি না আগেভাগে যথাযথ ব্যবস্থাবলী গ্রহণ করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, বর্তমানে ‘আমার ভোট আমি দেবো’ এমন ব্যবস্থাটি অর্থাৎ নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষমতাই আর চালু নেই। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বহু দেশে এমনটা ঘটছে। তবে এখানে জোর দিয়েই একটি কথা বলতে হচ্ছে, নির্বাচন বা ভোট যখন গণতন্ত্রের অপর নাম হয়ে দাঁড়ায় অথবা সমার্থক বলে কতিপয়কেন্দ্রিক শাসন এবং স্বৈরশাসকরা স্বজ্ঞানে, কূটকৌশলের অংশ হিসেবে যখন এমনটা চর্চা বা প্র্যাকটিস করতে শুরু করল— তখনই প্রকৃত গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও যা বাকি ছিল, তারও বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে। কারণ নির্বাচন বা ভোট এবং গণতন্ত্র যে এক কথা নয়, সাধারণের মনোজগৎ থেকে সে কথাটি পর্যন্ত স্বৈরশাসকবর্গ সুকৌশলে মুছে দিয়েছে। বাংলাদেশও কোনোক্রমেই এর বাইরে নয়।

এক্ষেত্রে অবিভক্ত পাকিস্তানের বহু উদাহরণ দেওয়া যায়। গণতান্ত্রিক পথ-প্রথা, পদ্ধতি ভাঙার জন্য প্রথমে মৌলিক গণতন্ত্র চালু করেছিলেন আইয়ুব। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তার শুরুটা যেসব কারণে হয়েছিল তার অন্যতমটি ছিল গণতন্ত্র। অর্থাৎ স্বাধীনতার মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রাপ্তি ও চর্চার মধ্য দিয়ে সবার জন্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু শুধু ভোটই যে গণতন্ত্র এমন একটি অপকৌশল বাস্তবায়ন করা হয় শাসকবর্গের পক্ষ থেকে, দেশটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অল্পকাল পরেই। যার স্পষ্ট আলামত প্রথমবারে দেখা যায় ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এরপরে ছোট-বড় যত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার প্রায় সবই অনুষ্ঠিত হয়েছে দলীয়, নানাবিধ প্রভাব আর পেশি ও অস্ত্রশক্তির ওপর ভর করে। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পরে সামরিক শাসন আমলের নির্বাচনে আমরা আইয়ুব খানের নির্বাচনের প্রতিচ্ছবি দেখেছি কমবেশি। আমাদের দেখতে হয়েছে হ্যাঁ-না ভোট, এরশাদ জামানার নানা কিসিমের নির্বাচন।

একটি বিষয় বলতেই হবে, যৎসামান্য হলেও নির্বাচন জনগণের জন্য গণতন্ত্র প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ও সুরক্ষা সৃষ্টি করে, বিশেষ করে জনমনে সামান্য হলেও অধিকার আদায়ের শক্তিটুকু দিয়ে থাকে; যার সবকিছুই এখন বিদায় নিয়েছে। এ কথাটিও বলতে হবে, ১৯৯০ সালের স্বৈরশাসনের বিদায়ের পরে নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে একে একে নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠানোর যে ত্বরিত কর্মটি আমরা নানা সময়ে বাধ্য হয়ে প্রত্যক্ষ করেছি, তা প্রতিবারই নিত্যনতুন কৌশল উদ্ভাবনকারী এবং অবিশ্বাস্য। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন তথাকথিত ভোটদান পর্বকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার নেতিবাচক ইতিহাস হিসেবেই বহুকাল বিবেচিত হবে। অথচ এ কথাও আমাদের স্মরণে আছে, ২০০৮-এ আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কে নানা সুন্দর সুন্দর কথা বলা হয়েছিল। এতে আরও নানা প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়েছিল; যার দু-একটির উল্লেখ করা প্রয়োজন। নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকারের প্রধান ৫টি বিষয়ের ৫.৩ দফায় নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন পদ্ধতির ইতিবাচক সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল। ওই ইশতেহারে ভিশন ২০২১-এর প্রথম দফায় বলা হয়েছিল, ‘একটি নির্ভরযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা, নিয়মিত নির্বাচন, সরকারের জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হবে।’

এসব প্রতিশ্রুতির পরে শুধু সংসদ নির্বাচনই নয়, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, এমনকি বাজার-স্কুল কমিটির নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন পক্ষের নানা তেলেসমাতি আমাদের দেখতে হচ্ছে ও হয়েছে। নির্বাচনকে অকার্যকর মাধ্যম হিসেবে পরিণত করে এমন প্রথা-পদ্ধতি ও ঐতিহ্যকে নির্বাসনে পাঠানোর যাবতীয় ব্যবস্থা সম্পন্নের লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও বাতিল করা হয়। অর্থাৎ পরে জিগিরও তোলা হয়— গণতন্ত্র নয়, উন্নয়ন।

নির্বাচনী প্রক্রিয়ার এমন ওলোট-পালট অবস্থার প্রেক্ষাপটে বর্তমানে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন হঠাৎ কেন জানি সরগরম হয়েছে। বিএনপি নির্বাচন কমিশন গঠন ও নির্বাচন সম্পর্কে যে ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করেছে, তা যে নতুন কোনো উদ্ভাবন বা আবিষ্কার তা মনে করার কোনো কারণ নেই। বিএনপির প্রধান যে দাবি তা হচ্ছে— একজন যোগ্য ও নিরপেক্ষ প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ কমিশনারদের তালাশ-তল্লাশি করে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সার্চ কমিটি গঠন করা। তাছাড়া সামরিক বাহিনীকে নির্বাচনকালীন কিছু ক্ষমতা প্রদানের জন্যও বলা হয়েছে। এ লক্ষ্যে বিএনপি রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ চায়। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান অনুযায়ী অর্থাৎ সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রপতি গঠন করবেন।

বাস্তবে আওয়ামী লীগ বিশেষভাবে জানে যে, বাস্তবে কী ঘটতে যাচ্ছে। আর বিএনপি এতকাল পরেও নানা অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ হয়ে রাষ্ট্রপতির শুভবুদ্ধি ও সদিচ্ছার উন্মেষ ও উদয়ের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির শুভবুদ্ধির বা সদিচ্ছার মূল্য আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান অনুযায়ী কতটুকু দেবে বা শুভবুদ্ধির অঙ্কুর কতটুকু বাড়তে দেবে— তা তাদের ওপরই নির্ভর করে। সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে— এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করবেন : তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোনো পরামর্শদান করেছেন কি না এবং করে থাকলে কী পরামর্শ দান করেছেন, কোন আদালত সেই সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের তদন্ত করতে পারবেন না।

কাজেই ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন যথারীতি সাংবিধানিক নিয়মে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমেই গঠিত হবে।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিএনপির ১৩ দফার মধ্যে প্রকারান্তরে সরকারের সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্যের কথা আকার ইঙ্গিতে বলা হয়েছে। কিন্তু এবারে এবং আগেও আওয়ামী লীগ এসব প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সব সময়ই রাজনৈতিক সংলাপ এবং জাতীয় ঐকমত্যের প্রস্তাব নাকচ করে দিচ্ছে-এবারেও দিয়েছে। বিএনপির সাংগঠনিকসহ নানা রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে এ নিয়ে নানা ফায়দা লুটবে— এটাই স্বাভাবিক।

তাহলে প্রশ্ন উঠে যে, ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে কেন একটি সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছিল? যতদূর জানা যায়, ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পরে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকগণ এটা মনে-প্রাণে দেখাতে চেষ্টা করেছিলেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হলেও অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ ও সদিচ্ছার কোনোই কমতি নেই।  কিন্তু লোক দেখানো ওই ব্যবস্থা যেমন বেশি দিন স্থায়ী হওয়ার নয়, তেমনি তা হয়নি।

এবারেও ঐকমত্য, সংলাপ, বিএনপির কথা মতো সার্চ কমিটি গঠন এবং এ জাতীয় কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের সদিচ্ছা ও শুভবুদ্ধির উদয় হবে— তা মনে করার আদৌ কোনো কারণ নেই। শুভবুদ্ধির উদয় এবং সদিচ্ছার উত্থান ঘটত যদি বিএনপি তার নেতৃত্বের দক্ষতা, যোগ্যতা, প্রজ্ঞা এবং সাংগঠনিক সক্ষমতা ও শক্তি প্রদর্শন করে আওয়ামী লীগকে বাধ্য করতে পারত। বিএনপিকে এ বিষয়টিকেও মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন ও ১৩ দফা প্রস্তাবনা যদি রাজনৈতিক কৌশল হয়েই থাকে তবে তা অচিরেই ব্যর্থ হবে।  এখানে বিএনপির বড় দুর্বলতা হচ্ছে, বিএনপি নিজেই।  

লেখক : সাংবাদিক।

amaderbudhbar.com

সর্বশেষ খবর