শনিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

মজলুমের পাশে দাঁড়াতে হবে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

মজলুমের পাশে দাঁড়াতে হবে

কলেমার মালা গলে পরার অপরাধে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হওয়া নতুন নয়। যুগে যুগে যারাই কলেমার রঙে রঙিন হয়েছেন, তাদের সবাইকে নির্যাতন-নিপীড়নের মোকাবিলা করতে হয়েছে। কেউ কেউ তো শাহাদাতের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এর কারণ হলো, আল্লাহ রব্বুল আলামিন দেখতে চান ইমানের ঘোষণার আলোকে কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষ কি মনে করেছে, ‘আমরা ইমান এনেছি’ এ কথা বললেই তাদের জান্নাত দিয়ে দেওয়া হবে! তাদের পরীক্ষা করা হবে না! আমি তাদের আগের জাতিদেরও পরীক্ষা করেছি। আল্লাহ অবশ্যই পরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নেবেন কারা ইমানের দাবিতে সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী।’ (সূরা আনকাবুত : ২-৩)।

ইমানের দাবিতে সত্যবাদী প্রমাণ করার জন্য প্রতিটি মুমিনকেই আল্লাহতায়ালা পরীক্ষা করেন। প্রকৃত মুমিন বান্দা আল্লাহর দয়ায় সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। যেমন হয়েছিলেন রসুল (সা.)-এর প্রিয় সাহাবিরা। পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহ সাহাবিদের দুটি দলে বিভক্ত করেছেন। একদল মুহাজির, আরেকদল আনসার। কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নিজ ভূমি ত্যাগ করে যারা অন্য ভূমিতে আশ্রয় গ্রহণ করে তাদের বলে মুহাজির। আর নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে মুহাজিরদের সাহায্যকারীদের বলা হয় আনসার। মক্কা থেকে রসুল (সা.)সহ একদল সাহাবি যখন হিজরত করে মদিনায় এলেন তখন মদিনার মানুষ তাদের খুশিমনে বরণ করে নিলেন। রসুল (সা.) দেখলেন হিজরতকারী সাহাবিরা একেবারেই নিঃস্ব। এভাবে সহায়-সম্বলহীনভাবে পড়ে থাকা ব্যক্তির মানসিকতায় বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এভাবে না খোদার ইবাদত করা যাবে না সুন্দর জীবনযাপন। তাই তিনি মুহাজিরদের সঙ্গে আনসারদের ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করে দিলেন। সর্বপ্রথম আলী (রা.)-কে নিজের ভাই বলে স্বীকার করে নিলেন। যদিও আলী (রা.) আগে থেকেই রসুল (সা.)-এর ভাই ছিলেন। কিন্তু এ ভ্রাতৃত্ব ছিল দীনের জন্য হিজরত ও সাহায্যের ভিত্তিতে। তারপর নিজ চাচা আব্বাসের সঙ্গে জায়েদ ইবনে হারেসা, আবুবকর (রা.)-এর সঙ্গে খারেজা (রা.)-এর ভ্রাতৃত্ব তৈরি করে দেন। ‘হায়াতে মুহাম্মদ’ গ্রন্থের ভাষায়  এ ভ্রাতৃত্ব ছিল রক্ত সম্পর্কের মতোই। আনসাররা মুহাজিরদের সঙ্গে নিজেদের সম্পদ, ঘরবাড়ি, স্ত্রী সব ভাগ করে নিলেন। সব আনসারই যে বিত্তশালী ছিলেন, এমন নয়। অনেক আনসার গরিবও ছিলেন। তবুও তারা মুহাজিরদের সঙ্গে নিজেদের অল্প সম্পদ ভাগ করে নিলেন। এ বন্ধনের স্বীকৃতি দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা ইমান এনেছে, হিজরত করেছে, নিজেদের জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে আর যারা মুহাজিরদের আশ্রয় দিয়েছে এবং সাহায্য করেছে তারা পরস্পর বন্ধু।’ (সূরা আনফাল : ৭২)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা ইমানের রং ধারণের দিক থেকে এগিয়ে আছে এবং যারা ইমানের রং ধারণ করে ইমানওয়ালাদের অনুসরণ করছে তাদের সবার ওপর আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট।’ (সূরা তাওবাহ : ১০০)।

মুহাজিরদের সাহায্য করা আনসারদের জন্য ফরজ। আল্লাহ বলেন, ‘তারা যদি দীনের ব্যাপারে তোমাদের কাছে সাহায্য চায়, সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য।’ (সূরা আনফাল : ৭২।) প্রিয় পাঠক! বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা বাংলাদেশের মুসলমানরা আনসার। আর প্রতিবেশী মিয়ানমারের নির্যাতিত মুসলমানরা মুহাজির। তারা হিজরত করে আমাদের দেশে আসছেন, নদীতে ভাসছেন। এ অবস্থায় তাদের সাহায্য করা আমাদের জন্য ফরজ। এ ফরজ যদি আমরা আদায় করতে না পারি তবে আল্লাহর কাছে ইমানের দাবিতে সত্যবাদী হতে পারব না। অনেকে বলতে পারেন, আমাদের কী করার আছে বা আমরা কী করব? এ লজ্জাজনক প্রশ্নের উত্তর হলো, আমাদের যা আছে তাই নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। দেশের কোনো কোনো কওমি মাদ্রাসা ও বিভিন্ন সংগঠন রাখাইনের মুহাজিরদের জন্য কালেকশন করে তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে।

অনেকে ব্যক্তিগতভাবে তাদের সাহায্য করছেন। আপনিও তাই করুন। অফিস-আদালতে, ঘরে-বাইরে, বাজারে-মসজিদে সব জায়গায় রাখাইনদের করুণ কাহিনী তুলে ধরে মুসলমানের ঘুমন্ত বিবেক জাগিয়ে তুলুন। এ লেখাটি মানুষকে পড়তে দিন। তাদের জানান, মিয়ানমারের মুসলমানদের যতটা পারা যায় সাহায্য করা নামাজ-রোজার মতোই ফরজ। তারপর এদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজের যোগ্য করে দিন। দেখবেন এরা পরিশ্রমের মাধ্যমে সোনালি দিন ফিরিয়ে আনবে। যেমন এনেছিলেন আবুবকর, ওমর ও আলী (রা.)। নিঃস্ব অবস্থায় এসে আনসার ভাইদের দানের প্রতি তাকিয়ে থাকেননি তারা। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে মদিনার অর্থনৈতিক বিপ্লবের সহযোগী হয়েছেন।

হায়! আজ কোথায় সেই আনসার! যারা আল্লাহর পথে হিজরতকারীদের জন্য নিজের সবকিছু দিয়ে সাহায্য করেছিলেন? অজানা-অচেনা মানুষকে শুধু ইমানের রং দেখে রক্তের ভাই হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। হে আল্লাহ! আমি অক্ষম! আমি অধম। কলমের লাঙ্গল দিয়ে কাগজভূমিতে বীজ বপন করলাম রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য। এ বীজকে চারা বানিয়ে তোমার বান্দাদের বিবেকজুড়ে বৃক্ষ বানিয়ে দাও।  জাগিয়ে দাও মুসলমানের ঘুমন্ত বিবেক। ভূলুণ্ঠিত মানবতা আবার গেয়ে ওঠুক জয়গান, জয়োল্লাস করুক মুমিনের ছোঁয়া পেয়ে। ‘মানবতা’ রঙিন হোক ইমানের রঙে। মানবতা বেঁচে থাকুক মানবতার প্রেমে।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর