মঙ্গলবার, ৩ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা নির্যাতন : এ অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না

ড. শেখ আবদুস সালাম

রোহিঙ্গা নির্যাতন : এ অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না

৪৫ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে আমরা বাঙালিরা পাক বাহিনীর নির্যাতনের অধ্যায় শেষ করে লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে উদ্বাস্তু অবস্থা থেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছিলাম। আজ এই সময়ে আমরা লক্ষ্য করছি যে আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে হাজার হাজার মানুষ নিজ ভূমি থেকে উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছে। বেসরকারি তথ্যমতে কয়েক বছর ধরে ইতিমধ্যে বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে অত্যাচারিত হয়ে কক্সবাজারসহ আশপাশের জেলাগুলোয় ঠাঁই নিয়েছে। সম্প্রতি এ প্রবণতা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এমনিতেই মানুষের ভারে ভারাক্রান্ত আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের এ দেশে চলে আসার হিড়িক আমাদের জন্য আরেক অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি করছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মিয়ানমারের পশ্চিমে অবস্থিত রাখাইন রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী হচ্ছে ‘রোহিঙ্গা’। এরা মিয়ানমারের অধিবাসী এবং ইসলামে দীক্ষিত জনগোষ্ঠী। মিয়ানমারের আকিয়াব, রেথেডাং, বুথিডাং, মংডু, কিয়ক্টাও, মাম্ব্রা, পাত্তরকিল্লা এসব এলাকায় এদের বসবাস। ২০১২ সালের এক হিসাব অনুযায়ী প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা বর্তমানে মিয়ানমারে বসবাস করছে। মিয়ানমার ছাড়াও পাঁচ লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এবং প্রায় চার লাখ সৌদি আরবে বসবাস করে বলে ধারণা করা হয়। এ ছাড়া বর্তমানে পাকিস্তানে প্রায় ২.৫০ লাখ, থাইলান্ডে ১.২৫ লাখ, মালয়েশিয়ায় ৩০ হাজার ও ভারতে প্রায় ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এরা বিভিন্ন সময় মিয়ানমার সরকারের নির্যাতনের কারণে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, অতীতে সময়ে সময়ে রাখাইন প্রদেশের উত্তরাংশে বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছিল। ১৫৫৪ সালের দিকে আরাকানের মুদ্রা বৃহত্তর বাংলায় ব্যবহূত হতো। বর্তমান প্রজন্মের রোহিঙ্গাদের কথ্য ভাষায় আজও চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণের প্রভাব রয়েছে। তাদের বাক্য এবং বচনে উর্দু, হিন্দি, আরবি শব্দ লক্ষ্য করা যায়। আমরা যাদের রোহিঙ্গা বলি তারা নিজেরা নিজেদের রোহাইঙ্গা বলে। শব্দটি এসেছে মূল রোসাইঙ্গা শব্দ থেকে। এর অর্থ হচ্ছে রোসাঙ্গের অধিবাসী। ধারণা করা হয়, একসময় কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণে নাফ নদ পর্যন্ত বিস্তৃত পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামই রোসাঙ্গ নামে পরিচিত ছিল। রোসাঙ্গ এলাকাটি এমনকি নাফ নদের আরেক পাড়ে আরাকান রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

এ ভূখণ্ড একসময় ব্রিটিশের দখলে আসে। ১৮৯১ সালে ব্রিটিশ সরকারের এক আদমশুমারিতে দেখা যায়, আরাকানে তখন ৫৮ হাজার ২৫৫ জন মুসলমান ছিল। ১৯১১ সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪৭ জনে।

ব্রিটিশরা একসময় মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে। তবে তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ব্রিটিশ শাসকদের এ ভুল (!) কর্মটিই আজকের রোহিঙ্গাদের দুর্গতির কারণ। এখন মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী চাইছে নির্যাতন করে তাদের দেশছাড়া করতে।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করে। সেই সময় পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এই জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের রাজনৈতিক যাত্রা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে।  শুরু হয় রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগের অধ্যায়। ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা তখন তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, ভোটাধিকার কেড়ে নেয়। ধর্মীয়ভাবেও তারা অত্যাচারিত হতে থাকে। রোহিঙ্গাদের হত্যা-ধর্ষণ তখন হয়ে পড়ে নিয়মিত ঘটনা। তাদের সম্পত্তিও জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়। দাসের মতো তাদের বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে। তখন থেকে তাদের তেমন শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার সুযোগও নেই।

১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান ভাগের বছরখানেক আগে অর্থাৎ এটা যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল যে ভারত স্বাধীন হয়ে মুসলমানদের জন্য একটি এবং হিন্দুদের জন্য আরেকটি আলাদা দেশ হবে তখন রোহিঙ্গা নেতারা বার্মিজ মুসলিম লীগ গঠন করেন। সেই নেতারা গিয়ে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাদের ইচ্ছা ছিল রাখাইন প্রদেশ বা এর রোহিঙ্গা মুসলিমপ্রধান এলাকাগুলো পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হোক। জিন্নাহ এ বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখাননি। ভারতবর্ষের মতোই মিয়ানমারও তখন ব্রিটিশ কলোনি ছিল। আর ভারতবর্ষের মতোই তারাও তখন স্বাধীনতার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

মিয়ানমারের স্বাধীনতার কয়েক বছর পরই রোহিঙ্গারা ‘জিহাদ’ শুরু করে। রোহিঙ্গা মুজাহিদরা মংডু, বুছিডংসহ বিভিন্ন জায়গায় সরকারি অফিস-আদালতে হামলা করে, নন-মুসলিম লোকজনকে মারতে শুরু করে। এ রকম কয়েক দিন চলার পর বার্মিজ আর্মি কয়েকটি বড় অভিযান চালায়। একপর্যায়ে তারা অস্ত্র ফেলে আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করে। এরপর সেখানে বেশ কয়েকটি মুজাহিদ গ্রুপের জন্ম হয়। তাদের দাবি ছিল ওরা মুসলিম, ওরা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব মানে না, ওরা রাখাইন প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে চায়। এ পর্যায়ে রোহিঙ্গাদের হামলায় মিয়ানমারের এথনিক বার্মিজরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। একসময় মিয়ানমারের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রেঙ্গুনে অনশন কর্মসূচিতেও নেমেছিলেন (১৯৫৪ সালের অনশন কর্মসূচিটা বেশ বড় ছিল)। তাদের দাবি ছিল এই রোহিঙ্গা মুজাহিদদের হাত থেকে আমাদের বাঁচান। এ পর্যায়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী যখন মুজাহিদদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় তখন নিরীহ রোহিঙ্গারাও অত্যাচারের শিকার হয়। এভাবে চলতে থাকে বছরের পর বছর।

১৯৭১ সালের ঠিক আগে-পরে এ রকম একটা বড় জিহাদি গ্রুপ গঠিত হয়েছিল জাফর কাওয়ালের নেতৃত্বে। জাফর কাওয়ালের সময় থেকেই রোহিঙ্গাদের মধ্যে মুসলিম মৌলবাদী লাইনে (আমাদের দেশের জামায়াতিদের লাইনে) রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হতে থাকে। তত দিনে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায় এবং রোহিঙ্গাদেরও আর রাখাইন প্রদেশ নিয়ে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার সুযোগ থাকল না। ওরা তখন বিশ্বব্যাপী ইসলামী বিপ্লবের লাইনে ধাবিত হয়। একসময় এসে জাফর কাওয়ালও আত্মসমর্পণ করেন। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের মধ্যে যে কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপ আছে এরা সবাই রেডিক্যাল মুসলিম লাইনের অনুসারী। এদের কয়েকটি গ্রুপের সঙ্গে আল-কায়েদার যোগাযোগ ছিল বা আছে বলে খবর রয়েছে। আমাদের দেশের জঙ্গিবাদী দলগুলোর সঙ্গে এসব রোহিঙ্গা গ্রুপের সংযোগও খানিকটা স্পষ্ট।

রোহিঙ্গা সমস্যার স্বরূপটা আমাদের জানা দরকার। আমাদের দেশের একদল লোক রোহিঙ্গা সমস্যাকে মুসলিমদের সঙ্গে বৌদ্ধদের বিবাদ হিসেবে দেখিয়ে উত্তেজনা তৈরি করতে চায়। বিষয়টার এতটা সরলীকরণ করা ঠিক হবে কিনা, তা আরও একটু গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা সেখানেরই একটা এথনিক গ্রুপ। সংখ্যায় যত কমই হোক, ওদের অধিকার আছে সেই দেশের নাগরিক হিসেবে সেখানেই মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করার এবং সেই দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার। কেবল রোহিঙ্গা বলেই ওদের সঙ্গে রাষ্ট্র বৈষম্য করবে তা অন্যায়।

আমরা যখন রোহিঙ্গাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার কিংবা রোহিঙ্গাদের হত্যার খবর পাই সেটা নিঃসন্দেহে খুবই অমানবিক এবং অন্যায়। কিন্তু ওদের সেই দুর্দশাকে নিয়ে আমরা অনেক সময় বানানো ফটো পোস্ট করে আমাদের দেশেও এক ধরনের ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করি। তাতে রোহিঙ্গাদের বিশেষ কোনো লাভ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করি না। বিএনপিসহ আমাদের দেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের অবাধে বাংলাদেশে প্রবেশ এবং আশ্রয়দানের কথা বলছে। বিএনপি নেত্রী এজন্য রোডমার্চ করে চট্টগ্রাম যাবেন বলে শুনেছি। নূরে আলম সিদ্দিকী তার এক লেখায় রোহিঙ্গাদের অবাধে গ্রহণ করে ক্যাম্প খুলে তাদের আশ্রয় দেওয়ার কথা বলেছেন। সেটা করতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর অভিঘাত, চলমান স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নধারা অব্যাহত রাখা, সন্ত্রাসী কার্যক্রম আবারও উসকে দেওয়ার ঘটনা ঘটবে কিনা; এসব মাথায় রাখা দরকার। রোহিঙ্গাদের বর্তমান সমস্যাটি সৃষ্টি হয়েছে ৩ অক্টোবর সেখানকার একটি জঙ্গিগোষ্ঠী কর্তৃক তিনটি সীমান্ত চৌকিতে আক্রমণ করে মিয়ানমারের ৯ সীমান্তরক্ষীকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এ ঘটনা যতটা না রাজনৈতিক তার বেশি সন্ত্রাসী-জঙ্গি কর্মকাণ্ড। ওদের জন্য কিছু করতে হলে আমাদের সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে; আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা পর্যায়ে সমস্যাটি তুলে ধরতে হবে। আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করা মিয়ানমারের পুরনো অভ্যাস। কিন্তু মিয়ানমারও তো পাল্টাচ্ছে। আঞ্চলিক আর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা ছাড়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কোনো সামরিক বিবাদ কাম্য নয়।

তবে মিয়ানমার সরকারের এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করা আমাদের সবার দায়িত্ব। এমনভাবে এই প্রতিবাদ করতে হবে যেন মিয়ানমারের শাসকরা বুঝতে পারেন, বিশ্বের মানুষ এ অন্যায় সহ্য করবে না। তবে আমরা যখন রোহিঙ্গাদের এই মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিবাদ করব তা যেন ওদের মৌলবাদী সশস্ত্র গ্রুপগুলোর প্রতি নৈতিক সমর্থনের রূপ পরিগ্রহ না করে তাও একটু খেয়াল রাখা দরকার। দুনিয়ার যেখানেই এসব জিহাদি সন্ত্রাসের পথে নেমেছে তার কোনোটাই কিন্তু শেষ বিচারে মানুষের পক্ষে যায়নি। রোহিঙ্গাদের প্রতি অন্যায়, আসলে মানুষের প্রতি অন্যায়। একে যেন কোনো ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে আমরা মিলিয়ে না ফেলি। তাহলে এই অসহায় জনগোষ্ঠীটি সারা দুনিয়ার মানুষের সহমর্মিতা হারাবে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অভিবাসন ইস্যু নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কিছু দিন আগে ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাতে বলেছেন, বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে সুরাহা করতে হবে। আমরাও মনে করি প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের আলোকেই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এ ব্যাপারে অং সান সু চির প্রতি জাতিসংঘ মহাসচিবের পরামর্শও প্রণিধানযোগ্য।

লেখক : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর