শুক্রবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

তাবলিগ নবীওয়ালা কাজ

মুফতি আমজাদ হোসাইন

তাবলিগ নবীওয়ালা কাজ

দাওয়াত ও তাবলিগের মূলনীতি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, আপন পালনকর্তার পথের প্রতি আহ্বান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সঙ্গে বিতর্ক করুন পছন্দযুক্ত পন্থায়। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তাই ওই ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনিই ভালো জানেন তাদেরকে, যারা সঠিক পথে আছে। (সূরা নাহ্ল : ১২৫)। আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে রুহুল মাআনীতে আল্লামা মাহমূদ আলুসী বাগদাদী রহ. দীনি কাজে কোনো বাড়াবাড়ি করা যাবে না। মানুষকে এমনভাবে দীনের দাওয়াত দিতে হবে যাতে কারও মনে কোনোরূপ কষ্ট অনুভব না করে এবং সে যেন বুঝে এতে দাওয়াতকারীর দাওয়াত দেওয়ার মাঝে কোনো স্বার্থ নেই। সে তো একমাত্র নিঃস্বার্থভাবেই আমাকে দীনের দিকে আহ্বান করছেন। দায়ীর দরদমাখা গাস্তের কারণে যাকে দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে আল্লাহপাক এক সময় তাকে হেদায়েত দিতে পারেন। পবিত্র কোরআন ও রসুল সা. এর অসংখ্য হাদিসের ভাণ্ডার ইসলামী শরীয়তের মৌলিক ও প্রধান উৎস। ইসলামী জীবন বিধানের অন্যতম মূল ভিত্তি। কোরআনুল কারিম ইসলামের প্রদীপস্বরূপ আর হাদিস তার বিচ্ছুরিত আলো। ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানে কোরআন যেন হৃৎপিণ্ড আর হাদিস এই হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত ধমনী। জ্ঞানের বিশাল ক্ষেত্রে এ হৃৎপিণ্ড ও ধমনী প্রতিনিয়ত তাজা তপ্ত শোণিত ধারা প্রবাহিত করে এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে অব্যাহতভাবে সতেজ ও সক্রিয় রাখে। হাদিস একদিকে যেমন কোরআনুল কারীমের নির্ভুল ব্যাখ্যাদান করে, অনুরূপভাবে কোরআনের ধারক-বাহক মহানবী সা.এর পবিত্র জীবন-চরিত, কর্মনীতি, আদর্শ, তার কথা, কাজ, হিদায়েত ও উপদেশের বিস্তারিত বিবরণও প্রদান করে। এজন্যেই ইসলামী জীবন বিধানে কোরআনুল কারিমের পরেই হাদিসের স্থান। সাহাবায়ে কেরামরা মহানবী সা.এর প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং তার প্রতিটি কাজ ও আচরণ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতেন। মহানবী সা. এর সাহাবিদের ইসলামের আদর্শ ও সব বিধিনিষেধ যেমন মেনে চলার নির্দেশ দিতেন, তেমনি তা স্মরণ রাখতে এবং অনাগত মানব সভ্যতার কাছে পৌঁছে দেওয়ারও জোর তাগিদ দিয়েছেন। কোরআন ও হাদিস চর্চাকারীদের জন্য তিনি নিম্নোক্ত ভাষায় দোয়া করেছেন। হে আল্লাহ! সেই ব্যক্তিকে সজীব ও আলোকোজ্জ্বল করে রাখুন যে ব্যক্তি আমার কথা শুনে স্মৃতিতে ধরে রাখল, তার পূর্ণ হিফাজত করল এবং এমনকি অপর মানুষের কাছে পৌঁছে দিল ওই ব্যক্তির কাছে যে ব্যক্তি কোরআন ও হাদিসের বাণী শুনতে পায়নি। [মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৬৭৩৮, ৪/৮০]। রসুল (সা.) তিনি তার আদর্শ ও উন্নত চরিত্র মাধুরী দিয়ে সাহাবায়ে কেরামদের এক বিশাল জামাতকে পরবর্তী উম্মতের জন্য হেদায়েতের আলোকবর্তিকাস্বরূপ তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন। তার সাহচর্যপ্রাপ্ত এ জামাত নিজেদের আরাম-আয়েশ, পরিবার-পরিজনকে আল্লাহর হাওলা করে নিজেদের জীবন বাজি রেখে বিশ্বের আনাচে কানাচে দীনের দাওয়াত নিয়ে বের হয়ে পড়েন। তাদের জানা ছিল না কোনো পথ-ঘাট। ছিল না কোনো পরিচিত লোকজন। কণ্টকাকীর্ণ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দেশ থেকে দেশান্তর ভ্রমণ করে বেড়িয়েছেন। গড়ে তুলেছেন বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মসজিদ, মাদ্রাসা, মারাকেজ ও খানকা। সেসব মারাকেজ ও মাদ্রাসা থেকে যুগে যুগে বহু মহামনিষী তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে দীনের দিকে আহ্বানকারী মুহাদ্দেসীন, মুফাসসেরীন, মুবাল্লেগিনদের এক বিশাল জামাত। যেমন ইমাম আবু হানীফা র., ইমাম শাফী র., ইমাম মালেক র., ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল র., ইমাম বুখারি র., ইমাম মুসলিম র., শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামাহ র., শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী র., শাহ আশ্রাফ আলী থানভী র., হজরত হুসাইন আহমদ মাদানী র., হজরত ইলিয়াস র. মুর্শিদে কামেল আল্লামা দেলওয়ার হুসাইন র. (ফেনুয়ার হুজুর)সহ প্রমুখ উলামায়ে কেরাম। দীনের সংরক্ষণের জন্য হজরত কাসেম নানতবী র. প্রতিষ্ঠা করেছেন দারুল উলুম দেওবন্দ। আর দীনের ইশাআত (প্রচার ও প্রসার) করার জন্য হজরত ইলিয়াস র. গঠন করেছেন তাবলিগি জামাত। এ তাবলিগ জামাতের প্রতিটা নিবেদিতপ্রাণ সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও নিজেদের দায়িত্ব আদায় করার মানসে সম্পূর্ণ নিজ জিম্মায় বিশ্বের আনাচে-কানাচে বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন। এ দীনি ভাইদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আমাদের দেশে প্রতিবছর আয়োজন হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমার। বিশ্ব ইজতেমার উসিলায় সমগ্র বিশ্বে দেশের সুনাম-সুখ্যাতি ও পরিচিতি বাড়ছে। নিজের দেশের আর্তমানবতার সেবা হচ্ছে। পথহারা মানুষ দীনের দিকনির্দেশনা পাচ্ছে। পরস্পর ভ্রাতৃত্ব বন্ধন অটুট হচ্ছে। লাখ লাখ জনতার এ ইজতেমার রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি করছেন স্বয়ং আল্লাহপাক। ফলে প্রতিটি দীনি ভাইয়ের অন্তরে আছে এক অজানা প্রশান্তি। নেই কারও মনে কোনো আক্ষেপ। যেখানে ধনী-গরিব দেশি-বিদেশি সবাই একই ময়দানে উলামায়ে কেরামদের বয়ান শুনছেন। আর কায়মনে মাওলা পাকের জিকির-আজকারে নিজেদের আবদ্ধ রেখেছেন, আখেরি মোনাজাতের দিন দেশের আবাল-বৃদ্ধাসহ সর্বস্তরের জনগণ এ দোয়ায় শরিক হওয়াকে নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করছেন। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : খতিব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, বারিধারা, ব্লক-জে, নতুনবাজার, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর