বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ও-তে ওমরাহ : ক-তে কমরেটের কমরেড

মোস্তফা কামাল

ও-তে ওমরাহ : ক-তে কমরেটের কমরেড

অ-তে যখন অজু হয়েই গেল, তখন ও-তে ওমরাহ হওয়াই উত্তম। প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা মঞ্জুরুল আহসান খানের অনুসারীরা পাঠ্যপুস্তকে ও-তে ওড়নায় সাম্প্রদায়িকতার কেসটা ধরেছেন আগেভাগে। ততক্ষণে কমরেড খান ও-তে ওমরাহ সেরে ফেলেছেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির এই সাবেক সভাপতির ওমরাহ নিয়ে খোঁচাখুঁচিতে তাই আশেকরা বিরক্ত।  তিনি চূড়ান্ত গায়েবি দাওয়াইর জন্য ওমরায় গেছেন, না অবশিষ্ট বামদের বোধবুদ্ধির জন্য শাফায়েত চাইতে গেছেন— এসব আজেবাজে প্রশ্নের উচিত জবাবও আছে তাদের স্টকে। দেশে যারা মনে করেন কমিউনিস্ট মানেই নাস্তিক, তাদের দমনে ব্যাপক অবদান রেখেছেন এই কমরেড। বদনাম ঘুচিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন, কমিউনিস্টরা অধার্মিক নন।

এই কমরেডরা এমন যুক্তিতে ডিফিট খাচ্ছেন তাদের বিরোধী বামশক্তি ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের কমরেডদের কাছে। কারণ ওমরাহকে অবদান বললে ওইদিকের সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনুর ক্রেডিট অনেক বেশি। কারণ, ইনু-মেননরা ওমরাহ নয়, আস্ত হজ করেছেন এবং তা আরও আগেই, উজিরি পাওয়ার পরেই। জ্যামিতির মতো প্রমাণ, হ-তে হজ প্রতিষ্ঠা করে তারা ইহকাল-পরকাল দুই দুনিয়াতেই গোল্ডেন জিপিএ। সেই ক্ষেত্রে মঞ্জুরুল আহসান খান পিছিয়ে। তিনি তো করেছেন ওমরাহ। পাল্টা জবাবে, তার মুরিদের দাবি, তিনি কারও হেদায়েতে বা ধমকে ওমরায় যাননি। তিনি মক্কা-মদিনায় গেছেন খাস দিলে স্বপ্রণোদিত হয়ে। অথচ, ইনু-মেনুরা হজে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধমকে। তা-ও জুদা নয়। একত্রে একসঙ্গে।

দুই পক্ষের মধ্যবাদীরা ওমরাহ-হজে এত খোঁচাখুঁচির বিরোধী। তাদের মতে, যেনারা হজ-নামাজসহ ধর্মকর্ম করবেন। সেটা তেনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, মন্দিরে পূজা দিয়ে, গির্জায় উপাসনা করেও উৎপাদনের উপায়ের রাষ্ট্রীয় মালিকানাকে সমর্থন করা যায়। এর সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক নেই। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতেও তো আছে সাম্যের কথা। দরকার পড়লে ইসলামী সমাজতন্ত্রও হতে পারে। ইউরোপের আলবেনিয়ায় হয়েছে না? দেশটির প্রেসিডেন্ট আনোয়ার হোজ্জা এক সময় বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তার দেওয়া তত্ত্ব জনগণতন্ত্র স্তালিনের নেতৃত্বে কমিউনিস্টদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে গ্রহণ করা হয়েছিল। সেই মোতাবেকই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই পূর্ব ইউরোপে কায়েম হয়েছিল জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এমন নগদ উদাহরণের পরও ধর্ম নিয়ে টানাটানি না করার পরামর্শ মধ্যপন্থিদের।

একটা জায়গায় বাংলাদেশের ধর্মপীর আর বামদের বেশ মিল। জামায়াতি-হেফাজতিদের মতিগতিও এমনই। এরা সবাই শুদ্ধতাবাদী। সব পীরেরই দাবি— শুদ্ধ ইসলামের খেদমতদার একমাত্র তিনিই। জামায়াত-হেফাজতও ইসলামের একমাত্র পরিবেশক। প্রতিটি বামদলও ভাবভঙ্গিতে বোঝায় তারা ছায়া শুদ্ধবামের সোল এজেন্ট আর কেউ নন। এই গোছের শুদ্ধবামরা কিছু দিন পর ভেঙেচূরে শুদ্ধতম হন। এক চিমটা মার্কস, আধখানা চে, সিকিখানা লেনিন, এক চামচ জলিল-তাহের, আড়াই চামচ তদ্বির ব্যবসা, সোয়া তিন গ্রাম শ্রেণি সংঘাত, কয়েক পিস শত্রু খতমের যজ্ঞে তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন নিজেদের শুদ্ধতা। এক ইনু, এক মেনন, এক মইনুদ্দিন বাদল কেউই একমাত্র নন। তাদের আশেকানরা অনেকেই মনে মনে ইনু, সুবিধা আদায়ে মেনু, আরাম-আয়েসে মঈনু। এই শুদ্ধাশুদ্ধি খেলায় যতবাম ততভাগ। তারা ধর্ম, প্রগতিশীলতা, অসাম্প্রদায়িকতা, কমিউনিস্ট-সোশ্যালিস্ট, আস্তিক-নাস্তিক সব একাকার-ম্যাচাকার করে ফেলেছেন। পল্টিবাজির শুদ্ধতায় তাদের স্নান-গোসল আর বেলা-অবেলা মানতে চায় না। ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, বাসদ, সাম্যবাদী দল, সিপিবি ইত্যাদির কেউ শোষণ-দুর্নীতি অব্যাহত রাখতে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। কেউ আবার ক্ষমতা চায়। অথচ রাজপথে তাদের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস অত্যন্ত বর্ণাঢ্য। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন? কোথায় ছিল না তাদের সাহসী ভূমিকা? দুঃখজনকভাবে আন্দোলন সংগঠন, পরিচালন, বেগবানকরণে বামদের অবদান হাইজ্যাক হয়েছে বুর্জোয়াদের কাছে। নিজেদের আঁতলামী আর জ্ঞানগরিমার তত্ত্বের ক্যাচালের সুযোগই নিয়েছে বুর্জোয়ারা। মায়ার পরশে একসময় কিছু মানুষ কোনো কোনো বাম নেতার শুদ্ধতায় মুগ্ধ হতো। এক ধরনের আফসোসবোধে আক্রান্ত হয়ে বলত- আহা, এরা একবার ক্ষমতা পেলে হয়তো কিছু একটা হতো। এখন আর বোঝার বাকি কিছু নেই। নামকরা বামদের অনেকেই এখন আওয়ামী লীগ-বিএনপির উঠান চষেন। এরশাদের স্বাদ নিয়ে অর্থ-ক্ষমতায় কামিয়াবি হওয়া কমরেডের লিস্টও ছোট নয়। কিছু কমরেড ডানে-বামে, উত্তর-দক্ষিণে নানা সুবিধা লুটলেও বাকিদের রাজনীতি, সমাজ-সংসার সবখানেই অনুপযুক্ত-অখাদ্য হয়ে কষ্টকর দিনাতিপাত। কোনো রকমে দম-নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা এই শ্রেণিকে ভোটাররা বাতিল মালই মনে করে। কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের অধিকার, সাম্য-সততার গীতগান মানুষ গিলতে চায় না। কেউ কেউ তো শুনতেও নারাজ। জীবনের বাঁকে বাঁকে ব্যর্থতার পরিহাসভরা এই মানুষগুলোর গুরুচরণ অবস্থা দেখে দিন দিন এই নির্বোধের সংখ্যা কমছে। এর মূল কারণ, অবুঝের সংখ্যা কমছে। বাড়ছে বোধ-বুদ্ধিমান। এই বুঝবানরা মলমূত্র ছাড়া আর কিছুই ত্যাগ না করার ব্যাপারে আপসহীন। সাধারণ মানুষও সুবিধা চায়। সুযোগের নিশ্চয়তা চায়। চাইবে না কেন? এটাই মানুষের বৈশিষ্ট্য। অবুঝ শিশুও দুধ-মিঠাই চায়। যে বেশি দেবে তার দিকে কৃতজ্ঞতার চাহনিতে স্বর্গীয় হাসি দেয় শিশু। সুবাধিবাদী মানুষের দ্বিচারিতার বরকতে ‘যেমন মানুষ তেমন শাসক’ই নিশ্চিত হয়ে চলছে। এর হেরফের হওয়ার সম্ভাবনা বা আশঙ্কা কোনোটার লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।

বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যেও প্রাপ্তির অংক মেলানোর এ দিগম্বর প্রতিযোগিতা বামদের চূড়ান্তভাবেই উচ্ছিষ্টের খাতায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে তাদের উতরানোর নমুনা না দেখে মানুষও এগোচ্ছে বুঝমতো। সবার বুঝ প্রায় একই। তারা দুর্বত্তায়নে ত্যক্ত-বিরক্ত, ক্ষুব্ধ হলেও বামদের কাছে আশা দেখে না। এ সুযোগে মুরিদ বাড়ছে ভণ্ড, ঠক, সন্ত্রাসী, প্রতারকদের। আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জামায়াত-হেফাজত জনগণের কত বন্ধু? তাদের কাছে মার খেতে খেতে বামরা এখন গভীর মনোকষ্টে, কেউ কেউ কোমায়। কেউ কেউ ঘোরাঘুরি করেন পায়গম্বরিক অলি-গলিতে। আসলেই ক্যাস্ট্রো-চেগুয়েভারা, মার্কস-লেনিনরা হায়াত থাকতে বাস্তবতা বোঝেন না। সহি-শুদ্ধ আওলাদ বা ছা-পোনাও পান না।

এরপরও কেউ কেউ মতাবলম্বীরা এখনো বাম ঐক্যের স্বপ্ন দেখে। আশা করে সত্যিকার শুদ্ধতার বোধ জাগালে ফ্রেশ ব্লাডের বামরা এখনো অনেক অসাধ্য সাধনে সক্ষম। কিন্তু অ্যাকটিভিস্ট বামদের নিজেদেরই সেটা অজানা। জানাতে চাইলে তারা পীরের মুরিদানা খারিজের ঝুঁকিতে আঁতকে ওঠেন।  সাইড কেটে পালান এমুই-হেমুই, ইয়ানদি-হিয়ানদি। বামদের নিয়ে রাজনৈতিক কবি সুকান্তের বোধও সম্ভবত এমনই ছিল। নইলে ‘ঐতিহাসিক’ কবিতায় তিনি কেন লিখে গেছেন....?

তোমাদের ঐক্যহীন বিশৃঙ্খলা দেখে

বন্ধ হয়ে গেছে মুক্তির দোকানের ঝাঁপ

তোমাদের বিবদমান বিশৃঙ্খলার ভিড়ে

মুক্তি উঁকি দিয়ে গেছে বহুবার।

     লেখক : বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

সর্বশেষ খবর