শিরোনাম
বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

রাম মন্দিরের খেলায় মেতে উঠেছে বিজেপি

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

রাম মন্দিরের খেলায় মেতে উঠেছে বিজেপি

আবার সেই পুরনো রামমন্দিরের খেলায় মেতে উঠেছে ভারতের শাসক দল তথা গেরুয়া বাহিনী। বিগত শতকের ৯২ সালে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে সেখানে শ্রী রামের মন্দির নির্মাণের যে উদ্যোগ বিজেপি নিয়েছিল, তার ফলও তারা পেয়েছিল ১৯৯৯ সালে ক্ষমতায় এসে। আচ্ছে দিন, মেক ইন্ডিয়া স্লোগানে যখন কাজ হচ্ছে না, তখন ২৫ বছর আগেকার রামমন্দিরের স্লোগান আবার শুরু করেছে।  নির্বাচন এলেই তারা অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির দিয়ে হিন্দুত্বের সুড়সুড়ি শুরু করে। ২৫ বছর আগে বাবরি মসজিদ নিয়ে দেশের শীর্ষ আদালতে বিজেপির বাঘা বাঘা নেতার নামে এখনো মামলা চলছে। এই মামলার নিষ্পত্তির আগে নির্বাচনী ফায়দা তোলার জন্য বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ ও আরএসএস প্রধান মোহন ভগবতসহ মোদি মন্ত্রিসভার সদস্য এবং বিজেপি নেতারা প্রচার অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিরোধী দলগুলো বলছে, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার নিটফল কী ছিল। নিটফল ছিল দাউদ ইব্রাহিম নামক এক সমাজবিরোধীর উত্থান। দাউদ মুম্বাই থেকে পালিয়ে গিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। সেই দাউদকে ধরার জন্যই সাউথ ব্লক যখন হন্যে হয়ে পৃথিবীব্যাপী ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন গেরুয়া বাহিনী পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা দেশে জোরদার প্রচার শুরু করেছে, তারা ভগবান রামের নামে মন্দির বানাবেনই। এই দুঃসাহস যদি তারা দেখায়, তাহলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার উপরে এক বিরাট আঘাত আসবে।

বাবরি মসজিদ মোগল আমলে তৈরি হয়েছিল। বিজেপি-আরএসএসের দাবি ওই স্থানেই রামের জন্মস্থান। অতএব সেখানেই রামমন্দির বানানো হবে। ওই জায়গায় রাম সত্যি জন্মেছিলেন কিনা, তার প্রমাণ দিতে পারেননি ইতিহাসবিদরা। ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত বিজেপি ক্ষমতায় থাকার সময় লৌহমানব বলে পরিচিত লালকৃষ্ণ আদবানি উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি কমিটির পর কমিটি নিয়োগ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, বাবরি মসজিদের জায়গাতেই রাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

’৯২ সালে দিল্লির মসনদে ছিল কংগ্রেস। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন পিভি নরসিমা রাও। তিনি আগে খবর পেয়েছিলেন করসেবকরা ইট নিয়ে গিয়ে রামের নামে পুজো করবেন। নরসিমা রাও আদবানিকে ডেকে অনেক বোঝান, মসজিদে যদি আঘাত করা হয়, তাহলে বিপর্যয় ঘটতে পারে। তাই ঘটেও ছিল। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর দেশব্যাপী দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গও বাদ যায়নি। একটা অঘটন ঘটতে পারে এই আশঙ্কা করে নরসিমা রাও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতিবসুকে দিল্লিতে ডেকে পাঠান। জ্যোতিবসু তৎকালীন বিজেপি সভাপতি আদবানির সঙ্গে দেখা করেন। জ্যোতিবাবু তার স্বভাবসুলভ কায়দায় আদবানির বাড়িতে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কী করে জানলেন মিস্টার রাম ওখানে জন্মেছিলেন? আদবানি তাকে বলেছিলেন, এটা আমার ভাবনা। এই কথা কলকাতা ফিরে জ্যোতিবসু সাংবাদিকদের বলেছিলেন। কিন্তু আরএসএস-বিজেপির যৌথ উদ্যোগে যখন মসজিদের কিছু অংশ ভেঙে ফেলা হলো, তার প্রতিবাদে বোম্বে ও কলকাতাসহ বড় বড় শহরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সামরিক বাহিনী ডাকতে হয়। আর কলকাতায় পার্কসার্কাস, খিদিরপুর, গার্ডেন রিচ এলাকায় দাঙ্গা দেখা দিলে জ্যোতিবাবুু সামরিক বাহিনী নামিয়ে কঠোরভাবে তা দমন করেছিলেন। সেই খেলায়ই আবার মেতে উঠেছে বিজেপি। উদ্দেশ্য একটাই। নির্বাচনে জয়লাভ করা। কংগ্রসের সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী বিজেপির ইশতেহার দেখে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, সাহস থাকলে রামমন্দির বানিয়ে দেখাও। আমরা তা রুখবই। একই সুরে কথা বলেছেন অখিলেশ যাদবও। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার, লালুপ্রসাদ যাদব থেকে শুরু করে বিজেপি ছাড়া সব রাজনৈতিক দল রামমন্দির তৈরির উদ্যোগ নেওয়ার কড়া সমালোচনা করলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এখনো একটা কথাও বলেননি।

উত্তর প্রদেশ নির্বাচনে এর প্রভাব কতটা পড়বে এই মুহূর্তে তা বলা সম্ভব নয়। উত্তর প্রদেশ নির্বাচনে কংগ্রস ও সমাজবাদী পার্টি, যাদের নীতি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করা। তারা বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, মন্দির-মসজিদ নিয়ে এদেশে রাজনীতি করা চলবে না। চলতে দেওয়া হবে না। আমরা তা রুখবই। এদিকে ভারতবর্ষের বর্তমান রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর নাতি তথা পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী কড়া মন্তব্য করেছেন। গোপালকৃষ্ণ গান্ধী নরেন্দ্র মোদিকে লেখা এক চিঠিতে বলেছেন, শাসনের কুটকচালি তো দূর-অস্ত। আপনার এবং আপনার দলের ভারতের মতো দেশের শাসনভার সামলানোর মতো জনমতই নেই। মোদি নিজেকে বেশি প্রচারের আলোয় না এনে যতটা চেপে রাখতে পারেন ততটাই তার পক্ষে ভালো। দেশবিরোধী শক্তিগুলোকে গোপনে এবং অত্যন্ত সুচতুরভাবে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন তিনি।

সরাসরিই তিনি বলেছেন, মোদিকে তিনি কখনই প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে দেখতে চাননি। প্রধানমন্ত্রীকে লেখা খোলা চিঠিতে তিনি লিখেছেন, আপনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় লাখ লাখ অনুরাগী যেমন উত্ফুল্ল, আপনি মনে রাখবেন, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ আপনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় রুষ্ট এবং ক্ষুব্ধ।

উল্লেখ্য, ২০১৪-এর সাধারণ নির্বাচনে মাত্র ৩১ শতাংশ মানুষের ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসে বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেন নরেন্দ্র মোদি। গোপালকৃষ্ণ গান্ধী তাই স্পষ্ট করেই বলেছেন, ৬৯ শতাংশ মানুষ আপনাকে ভোট দেননি। অর্থাৎ এই বিশাল সংখ্যক মানুষ নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চাননি। আর যত দিন যাচ্ছে, এই সংখ্যাটা তত বাড়ছে।

তিনি বলেছেন, একটা ব্যাপার স্পষ্ট হওয়া দরকার। ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থায় একটা ভগ্নাংশ ভোটের ব্যবধানেই কোনো দল ভারতের ক্ষমতায় চলে আসতে পারে। নরেন্দ্র মোদির দল সেই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে। ভোটের হিসাবে এই ৬৯ শতাংশ কোনোভাবেই ৩১ শতাংশকে প্রভাবিত করতে পারে না। কিন্তু বাস্তব হলো— এই ৬৯ শতাংশ মানুষ নরেন্দ্র মোদির শাসনকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। অর্থাৎ তাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। দেশের সংখ্যালঘু ক্ষেত্রের আস্থা অর্জন করতে হলে নরেন্দ্র মোদির সরকারকে অনেক কিছু করতে হবে।

গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর এই খোলা চিঠির কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। কিন্তু দেশের ৬৯ শতাংশ লোকের একটা বড় অংশ মনে করে, মোদি যেভাবে দেশ শাসন করছেন, তাতে দেশের সার্বিক কল্যাণ হতেই পারে না। মোদি যতই প্রচার করুক, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে যতই উসকানি দিক না কেন, দেশের ইতিহাস তাকে ছেড়ে কথা বলবে না। তিনি যা ভাবেন তা-ই করেন। ব্রিটিশ আমল থেকে রেলের আলাদা বাজেট হতো। এবার তিনি সেটাও তুলে দিয়েছেন। তার দলেরও এ ব্যাপারে কোনো হেলদোল নেই। তাই ভোট এলেই রামমন্দির, রামমন্দির বলে দেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াতে থাকেন। এর পরিণাম কী হতে পারে, তা তিনি নিজেও জানেন। তার নিজের রাজ্য গুজরাটেই দুই হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। তারও অনেক মামলা এখনো ঝুলে রয়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে যত মদদ দেওয়া হবে, ততই ভারতের সর্বনাশ ডেকে আনা হবে। এ কথা গেরুয়া বাহিনী বুঝতে পারছেন না।  মানুষকে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস দিতে না পেরে তিনি সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঝুঁকছেন।

            লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর