শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মানিকগঞ্জের হাজারি গুড়

শাইখ সিরাজ

শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মানিকগঞ্জের হাজারি গুড়

কথায় আছে মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে! কিন্তু এবার মাঘে তেমন শীত ছিল না। আর এখন তো ফাল্গুন। এই লেখাটি যখন লিখছি তখন বেশ গরম অনুভূত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এক কঠিন সময়ে আমরা এখন, এই মুহূর্তে। আমাদের কৃষি, আমাদের পরিবেশ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। প্রত্যন্ত কোনো গ্রামেও হয়তো এখন আর শীতের দেখা পাওয়া যাবে না। কিছুদিন আগের কথা। এই তো দুই-তিন সপ্তাহ হবে। ঢাকার একদম কাছেই মানিকগঞ্জের এক গ্রামে গিয়ে কুয়াশা আর শীতের দেখা পেলাম। হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকার শিকদারপাড়া গ্রামবাসী তখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। সাড়ে পাঁচটা বাজছে ঘড়িতে। ভোর। নিশ্চুপ, সুনসান পরিবেশ। তবে এই সাতসকালে দেখা মিলল শুধু কয়েকজন গাছি ও গাছিবউয়ের। এরাই শীত সকালে প্রথম কাজে যাওয়া কৃষকের দল। গাছিরা ইতিমধ্যে শুরু করেছেন রস পাড়া। বউয়েরা অন্যদিকে ব্যস্ত চুলা তৈরি ও অন্যান্য গৃহস্থালি নিয়ে। এখানে রস জ্বাল দেওয়ার পাত্রগুলো অন্যরকম। একটি ঢিবির ওপর চারটি পাত্র। অনেকটা স্টোভের মতো বিশেষ ধরনের চুলা। কেউ কেউ বলে দেড়শ বা দুইশ বছর আগ থেকে শিকদারপাড়ায় বিখ্যাত হাজারি গুড় তৈরি করছেন চাষিরা। এই শিকদারপাড়ায় যারা হাজারি গুড় করতেন, সবাই এখন আর এই পেশার সঙ্গে নেই। তবে কেউ কেউ ধরে রেখেছেন এই ঐতিহ্য। গ্রামীণ পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। সামনে এগিয়ে আধো আলোয় প্রথম দেখা গাছি জাহিদ হাজারির সঙ্গে। দারুণ পারদর্শিতায় ১০টি গাছ থেকে রস পাড়লেন তিনি। ৩০ বছর ধরে এই কাজ করছেন। ৩০ বছর তার পরিবার তৈরি করছে হাজারি গুড়। চারদিকের কুয়াশা কাটতে শুরু করল। সূর্যের আলো বাড়ছে, শিকদারপাড়ার বাড়িতে বাড়িতে শুরু হচ্ছে রসকেন্দ্রিক ব্যস্ততা। গাছিরাও ঠিলা কাঁধে নিয়ে রস পাড়া শেষে যে যার বাড়ির পথে ছুটছেন। ৪০ বছর ধরে হাজারি গুড় তৈরি করছেন আবদুস সালাম নামের এক চাষি। মাত্র তিন ঠিলা রস নিয়ে তিনি তাড়াহুড়া করে ছুটছেন বাড়ির দিকে। জানলাম, ২০টি গাছ থেকে পাওয়া গেছে এই তিন ঠিলা। আবদুস সালামের মতে, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে এমনটি হচ্ছে। অথচ ছোটবেলায় দেখেছি সাতসকালে অনেক ঠিলা ভরে রস নামাতেন গাছিরা। ২০০ বছরের পুরনো হাজারি গুড়ের ঐতিহ্য যে এই চাষিরা টিকিয়ে রেখেছেন তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। একটু আগে আলো-আঁধারিতে এখানেই চুলা প্রস্তুত করার কাজ চলছিল। সেখানেই শুরু হয়ে গেছে রস জ্বাল দেওয়ার কাজ। কোনো কোনো বাড়িতে খোলার ওপরে রস জ্বালানো শুরু হয়েছে। স্থানীয়ভাবে সেই খোলাকে বলা হয় তাফাল। কেউবা বিশেষ ধরনের চারমুখী মাটির চুলায় রস জ্বাল দেওয়ার সব প্রস্তুতি সেরেছেন ততক্ষণে। স্থানীয়ভাবে এ ধরনের চুলাকে বলা হয় বাইন। এ পদ্ধতিতে রস জ্বাল দিয়ে যে গুড় হচ্ছে সেটিই প্রকৃত হাজারি গুড়। এর স্বাদ ও গুণ ইতিমধ্যেই খ্যাতি ছড়িয়েছে দেশ-বিদেশে। আর সেই গুড় তৈরি হচ্ছে চারমুখী চুলাতেই। মাত্র তিন মাস গুড়ের মৌসুমে যা আয় আসে, তাতেই খুশি হাবিবা খাতুন। প্রতিদিন সাত থেকে আট কেজি গুড় তৈরি করছেন তিনি। রস জ্বালানো থেকে গুড় উপযোগী হতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। একজন চাষি অবশ্য জানালেন, নতুন করে খেজুরের গাছ আর লাগায় না কেউ। পুরনো গাছগুলো নিয়ে এই তিন মাসের যত ব্যস্ততা আর বাণিজ্য। শিকদারপাড়ায় তখন দারুণ কর্মব্যস্ততা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপট পাল্টাচ্ছে। সকালে নিত্যকার কাজে ব্যস্ত সবাই। পাঠক! এরই ফাঁকে জানিয়ে রাখি হাজারি গুড়ের এক মজার ইতিহাসের কথা। কথিত আছে এই গুড় খেয়ে ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথও মুগ্ধ হয়েছিলেন। উপহার পাওয়া গুড়ের একটি খণ্ড রানী হাতে তুলতেই তা ভেঙে হাজার টুকরো হয়েছিল বলেই সেদিন এ গুড়ের নামকরণ হয়েছিল হাজারি গুড়। আর এই গুড় যে পরিবারগুলো বানাত তারাই হাজারি পরিবার নামে পরিচিত। এসব পরিবারের সবাই এখন পেশার সঙ্গে যুক্ত নয়। আর দশটি ঐতিহ্যের মতো এটিও আজ অনেকটাই বিলুপ্তির পথে।

 

 

জ্বাল দিতে দিতে দানা পড়তে শুরু করেছে গুড়ে। অদ্ভুত ঘ্রাণও ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। আহা! খেজুরের গুড়ের এমন সুঘ্রাণ সত্যিই আজকাল বিরল। এই এলাকার প্রধান ফসল পিয়াজ। সরিষাও করেন অনেকে। বাইনে রস জ্বাল দেওয়ার দৃশ্যটার বিবরণ না দিয়ে পারছি না পাঠক। খড়ি দেওয়া হচ্ছে একদিক দিয়ে। তাপ বেরোচ্ছে অন্যদিক দিয়ে। রস চারটি পাত্রে একটু পরপর সরানো হচ্ছে। নতুন কাঁচা রস এসে পড়ছে প্রথম পাত্রে। এভাবে এক-দুই-তিন-চার করে প্রতিটি পাত্রে একটু একটু করে পরিণত হচ্ছে হাজারি গুড়। রমজান আলীর বাড়িতে গিয়ে নিজ চোখে দেখলাম এই দৃশ্য। এ কৌশলটি রপ্ত করেছে গ্রামের অন্য পরিবারও। প্রায় ৪০-৫০টি পরিবার এখনো এ গুড় তৈরির কাজে যুক্ত। অবশেষে ঐতিহ্যবাহী হাজারি পরিবারে হাজির হলাম। যাদের হাতের ছোঁয়ায় খেজুরের রস থেকে তৈরি হয়েছে অমৃত মধুর স্বাদের হাজারি গুড়। হাজারি উঠানে গিয়ে দেখলাম জাহিদ হাজারি এবং স্ত্রী রেশমা হাজারি গুড় বানানোর প্রক্রিয়ায় বেশ তত্পর। খেজুরের রসের পাত্র থেকে শুরু করে গুড় তৈরির প্রতিটি পর্বে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কঠিনভাবে অনুসরণ করা হয় এখানে। গুড় বসানোর প্রস্তুতি শেষ। মাটির ছোট ছোট পাত্রের ওপর কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা গর্তে ঢালা হলো ঝোলা গুড়। কিছুক্ষণেই সেগুলো পরিণত হলো জমাটবাঁধা গুড়ে। যার ওপর প্রকৃত হাজারি গুড়ের সিল দিয়ে চিহ্নিত করা হলো। হাজারি পরিবারের ভাষায়, পিতলের তৈরি বাংলায় লেখা ‘হাজারি’ সিলটি রানী এলিজাবেথ গুড় খেয়ে খুশি হয়ে ইংল্যান্ড থেকে বানিয়ে তাদের জন্য পাঠিয়েছিলেন। শামীম হাজারি জানালেন, তার সাত পুরুষ আগে থেকেই হাজারি গুড় তৈরির কাজটি চলে আসছে। তবে অনেকে এখন হাজারি গুড় তৈরির চেষ্টা করলেও সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। যদিও অনেকেই সিল দিয়ে বিক্রি করছেন বাজারে।

তবে কৃষক বলছেন, এই হাজারি গুড়ের কাজে তাদের সন্তানরা সেভাবে যুক্ত নয়। এত পরিশ্রম তাদের সন্তানরা করুক, তাও চান না তারা। তবে কোনো কোনো সন্তান তাদের বাবার দেখানো পেশার পথে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে। যে কারণে ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার একটা প্রয়াস চালু রয়েছে। অবশ্য রমজান আলী আক্ষেপ করেই বললেন, তার পরিবারের আর কেউ নেই যে, হাজারি গুড়ের হাল ধরবে। আর এটিই প্রকৃত চিত্র। ব্যক্তি পর্যায়ের এসব উদ্যোগকে সরকারি সহায়তা দিয়ে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে বলে মনে করছেন শামীম হাজারি। রানী এলিজাবেথের যে সিলের কথা বলছিলাম একটু আগে, তার আসল পিতলের সিলটি আছে জহিরউদ্দিন হাজারির কাছে। গুড়ে সিল দেওয়ার কথা ভাবাটাই কাল্পনিক। কিন্তু রানী এলিজাবেথের দেওয়া সিলটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে আগলে রেখেছেন জহিরউদ্দিন। এরপর গেলাম স্থানীয় গুড়ের হাট ঝিটকা বাজারে। বহু মানুষ আসেন এখানে গুড় কিনতে। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার গুড় বেচাকেনা হয় এই হাটে। তবে তা সবই হাজারি গুড় নয়। হাজারির মতো দেখতে, তবে অন্য গুড়। আর আসল হাজারি গুড়ের উপস্থিতি খুঁজতে বেশ বেগ পেতে হলো। এ প্রসঙ্গে ক্রেতা এবং পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। খাঁটি হাজারি গুড়ের দাম প্রতি কেজি ৮০০ টাকা। আর নকল গুড় ঝিটকা বাজারে দাম মাত্র ৯০ টাকা কেজি। দেখতে হুবহু হলেও নকল গুড়ে চিনি মেশানো হয় অতিরিক্ত। প্রিয় পাঠক! আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে স্বাদে, আনন্দে ও ভালোবাসায়। প্রাকৃতিক উপাদান থেকে উত্কৃষ্ট খাদ্যপণ্য তৈরিতে বাঙালির তুলনা নেই। আমাদের আছে আখের গুড়, খেজুরের গুড়, গোলপাতার গুড়ের ঐতিহ্য। এত কিছুর মধ্যেও ঢাকার একেবারে কাছে মানিকগঞ্জের ঝিটকায় খেজুরের গুড়ের অদ্ভুত সুঘ্রাণ ছড়ানো ‘হাজারি গুড়’-এর যে ঐতিহ্য কয়েকটি পরিবার ধরে রেখেছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। ঢাকার ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এই হাজারি গুড়ের। এই গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হাজারি পরিবারের পাশাপাশি সরকারি প্রশাসন থেকে শুরু করে বেসরকারি উদ্যোক্তারাও যত্নবান হবেন, আশা করি। জেলা ব্র্যান্ডিং কার্যক্রমে উঠে আসতে পারে মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী হাজারি গুড়।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

     [email protected]

সর্বশেষ খবর