বৃহস্পতিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধু

তোফায়েল আহমেদ

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধু

প্রতি বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি দিনটি গভীরভাবে স্মরণ করি। এদিনটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। ১৯৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি ইতিহাসের মহামানব জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। প্রিয় নেতা তার যৌবনের চৌদ্দটি মূল্যবান বছর পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছেন। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে যে নেতা প্রিয় মাতৃভূমি বাংলার ছবি হৃদয় দিয়ে এঁকেছিলেন, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন, সেই নেতাকে সেদিন জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। তিনি শুধু বাঙালি জাতিরই মহান নেতা ছিলেন না, সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয় নাই। একদিন বাঙালিকে বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা হতে হবে। সেই লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে ’৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ এবং ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারপর সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথে নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংগঠিত করার মধ্যদিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন।

আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৬৮-৬৯ এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কালপর্বটি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ‘ড্রেস রিহার্সেল।’ জাতির মুক্তিসনদ ৬ দফা দেওয়ার অপরাধে বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ সর্বমোট ৩৫ জনকে ফাঁসি দেওয়ার লক্ষ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করা হয় এবং নির্বিঘ্নে পুনরায় ক্ষমতায় আরোহণের এক ঘৃণ্য মনোবাসনা চরিতার্থে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান। আগরতলা মামলার বিচার যখন শুরু হয় তখন আমরা উপলব্ধি করি বঙ্গবন্ধুকে যদি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয় তাহলে চিরদিনের জন্য বাঙালি জাতির কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যাবে। তাই আমরা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ’৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ১১ দফা কর্মসূচি জাতির সামনে পেশ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডাকসু’ কার্যালয়ে আমার সভাপতিত্বে এবং চার ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন এবং ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি ১১ দফা ঘোষণা করা হয়।

১৭ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জমায়েত অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় এবং পূর্ব ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়। ’৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি যে আন্দোলন আমরা শুরু করেছিলাম, ২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদের রক্তাক্ত জামা হাতে নিয়ে যে শপথ নিয়েছিলাম, ২৪ জানুয়ারি মতিয়ুর-মকবুল-রুস্তম-আলমগীরের রক্তের মধ্যদিয়ে সেই আন্দোলন সর্বব্যাপী গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছিল। ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে শপথ দিবসে স্লোগান দিয়েছিলাম ‘শপথ নিলাম শপথ নিলাম মুজিব তোমায় মুক্ত করব; শপথ নিলাম শপথ নিলাম মাগো তোমায় মুক্ত করব।’ ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করে সান্ধ্য আইন জারি করা হলে সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল করি। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে পাকিস্তানি সেনারা বেয়োনেট চার্জে নির্মমভাবে হত্যা করে পুনরায় সান্ধ্য আইন জারি করলে যথারীতি আমরা সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখি। ২০ ফেব্রুয়ারি সমগ্র ঢাকা নগরীকে মশাল আর মিছিলের নগরীতে পরিণত করলে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে পল্টনের মহাসমুদ্রে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক সবার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম প্রদান করি। সমগ্র দেশ গণবিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়। জনরোষের ভয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান সব রাজবন্দীকে বিনা শর্তে মুক্তি দিলে দেশজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। প্রিয় নেতাকে কারামুক্ত করার মধ্যদিয়ে শপথ দিবসের স্লোগানের প্রথম অংশ ‘মুজিব তোমায় মুক্ত করব’, এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে হাতিয়ার তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদার মুক্ত করে স্লোগানের দ্বিতীয় অংশ ‘মা-গো তোমায় মুক্ত করব’ বাস্তবায়ন করেছিলাম।

বস্তুত, ’৬৬-এর ৮ মে’র গভীর রাতে ৬ দফা কর্মসূচি প্রদানের অভিযোগে দেশরক্ষা আইনে যে মুজিব গ্রেফতার হয়েছিলেন,- ৩৩ মাস পর ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি যে মুজিব মুক্তিলাভ করেন- নাম বিচারে এক হলেও, বাস্তবে ওই দুই মুজিবের মধ্যে ছিল গুণগত ফারাক। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি ছিল সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য অগ্নিপরীক্ষার মতো। সেই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বন্দীদশা থেকে মুক্তমানব হয়ে বেরিয়ে আসেন। ২২ তারিখ আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেই যে, আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে আমরা সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানাব। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারেই রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়।

শুরুতেই বলেছি এদিনটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান যারা দেখেননি তাদের বলে বোঝানো যাবে না সেই জনসমাবেশের কথা। আমরা যখন সেখানে পৌঁছেছি, তখন রেসকোর্স ময়দানে মানুষ আর মানুষ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রেন, বাস, ট্রাক, লঞ্চ-স্টিমার বোঝাই হয়ে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, কৃষক-শ্রমিক, সাধারণ মানুষ ছুটে এসেছে। ঢাকার মানুষ তো আছেই। অভিভূত হয়ে পড়লাম। এর আগে এতবড় জনসভা দেখিনি। এটা জনসভা না, জনসমুদ্র। সেই জনসমুদ্রে লাখ লাখ লোক এসেছে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে একনজর দেখতে। প্রিয় নেতাকে নিয়ে আমরা মঞ্চে উঠলাম। তখন একটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল যে, আমি প্রতিটি সভায় সভাপতিত্ব করতাম এবং সভা পরিচালনা করতাম। কে বক্তৃতা করবে সেই নামটিও ঘোষণা করতাম। সেদিন ওই মঞ্চে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রেখেছিলেন। চিরাচরিত প্রথা ভঙ্গ করে আগেই সভাপতির ভাষণ দেওয়ার জন্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে লাখ লাখ মানুষকে অনুরোধ জানিয়ে বলেছিলাম, ‘সবার শেষে বক্তৃতা করার কথা থাকলেও আপনাদের অনুমতি নিয়ে আমি আগেই বক্তৃতা করতে চাই।’ দশ লাখ লোকের সম্মতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আগেই বক্তৃতা করি। আমার জীবনে এই বক্তৃতাটির কথা চিরদিন মনে থাকবে। সেদিন যে ভালোবাসা মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি তা বলে বোঝাতে পারব না। বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে বলেছিলাম, ‘প্রিয় নেতা তোমার কাছে আমরা ঋণী, বাঙালি জাতি চিরঋণী। এই ঋণ কোনোদিনই শোধ করতে পারব না। সারা জীবন এই ঋণের বোঝা আমাদের বয়ে চলতে হবে। আজ এই ঋণের বোঝাটাকে একটু হালকা করতে চাই জাতির পক্ষ থেকে তোমাকে একটা উপাধি দিয়ে।’ ১০ লাখ লোক ২০ লাখ হাত তুলে সম্মতি জানিয়েছিল। তখনই ঘোষিত হয়েছিল, ‘যে নেতা তার জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন সেই নেতাকে জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হলো।’ ১০ লাখ লোক তুমুল করতালির মধ্যদিয়ে এই প্রস্তাব গ্রহণ করে প্রিয় নেতাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে লাখ লাখ কণ্ঠে ধ্বনি তুলেছিল, ‘জয় বঙ্গবন্ধু।’

এমন একটি মধুর দিন আমার জীবনে আর কোনোদিন আসবে না। বছর ঘুরে দিনটি যখন ফিরে আসে হৃদয়ের মানসপটে কত স্মৃতি ভেসে ওঠে। এদিনের প্রতিটি মুহূর্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে মনে পড়ে। সেদিন বক্তৃতায় আর বলেছিলাম, ‘৬ দফা ও ১১ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের রক্তের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আমরা ফিরে পেয়েছি। তাদের সে রক্ত যেন বৃথা না যায়, তার জন্য জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাই। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রসহ সব মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য এই আন্দোলন শুরু হয়েছে। প্রিয় নেতা, মানুষ তোমার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে। যদি এই বিশ্বাসের বরখেলাপ কর, তবে বাংলার মানুষ তোমাকে ক্ষমা করবে না।’ বক্তৃতা শেষ করে ঘোষণা করেছিলাম, ‘এখন বক্তৃতা করবেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।’ তুমুল করতালির মধ্যে তিনি বক্তৃতা করতে দাঁড়ালেন। চারদিকে তাকিয়ে উত্তাল জনসমুদ্রের উদ্দেশে বললেন, “রাতের অন্ধকারে সান্ধ্য আইনের কঠিন বেড়াজাল ছিন্ন করে যে মানুষ ‘মুজিবকে ফিরিয়ে আনতে হবে’ বলে আওয়াজ তুলে গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে তাদের দাবির সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না।” সংগ্রামী ছাত্র সমাজকে আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ছাত্রদের ১১ দফা শুধু সমর্থনই করি না, এর জন্য আন্দোলন করে আমি পুনরায় কারাবরণে রাজি আছি। ছাত্রদের ১১ দফার মধ্যে আমার ৬ দফা দাবিও নিহিত রয়েছে। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি যদি এদেশের মুক্তি আনতে ও জনগণের দাবি আদায় করতে না পারি, তবে আন্দোলন করে আবার কারাগারে যাব।’ পরিশেষে তিনি স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কৃতজ্ঞস্বরে বলেন, ‘ভায়েরা আমার, তোমরা যারা রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছ, যদি কোনোদিন পারি নিজের রক্ত দিয়ে আমি সেই রক্তের ঋণ শোধ করে যাব।’ তিনি একা রক্ত দেন নাই- ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতির রক্তের ঋণ তিনি শোধ করে গেছেন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দিন। যতদিন বেঁচে থাকব হৃদয়ের গভীরে লালিত এদিবসটিকে স্মরণ করব।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, মন্ত্রী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর