রবিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

রাজনীতিতে, নির্বাচনে মুক্ত খালেদা না বন্দী খালেদা?

কাজী সিরাজ

রাজনীতিতে, নির্বাচনে মুক্ত খালেদা না বন্দী খালেদা?

দেশের রাজনীতির মাঠ-ময়দানে এখনো তেমন কোনো সরব কর্মকাণ্ড ও উত্তেজনা না থাকলেও মাঠের বাইরের রাজনীতি মোটামুটি জমতে শুরু করেছে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন উপলক্ষে সরকারি দল ও তাদের ধামাধরারা ছাড়াও সরকারি দলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিসহ ৩১টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সংলাপ জাতীয় রাজনীতির পালে নতুন হাওয়া দিয়েছে। প্রথমে সার্চ কমিটি পরে নির্বাচন কমিশন এবং সবশেষে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন এখন নানামুখী আলোচনায় মুখর। সরকার নানা কৌশলে বিএনপিকে চার দেয়ালের মধ্যে আটকে রাখতে পারলেও মিডিয়ার মাধ্যমে তারা সরকারের ওপর কঠোর সমালোচনার চাবুক মেরে চলেছে। সব পক্ষের লক্ষ্য আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী এখনো প্রায় পৌনে দুই বছর বাকি পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের। কিন্তু মানুষ হিসাব-নিকাশ করতে শুরু করেছে এখন থেকেই। তবে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় রাজনীতির প্রাসঙ্গিক আলোচনার সব বিষয়কে ছাপিয়ে মূল বা প্রধান আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছেন। রাজনৈতিক আড্ডায়, টেলিভিশন টকশোতে তাকে নিয়েই আলোচনার ঝড় বইছে। শাসক দল আওয়ামী লীগসহ তার ঘোর বিরোধীরাও জাতীয় রাজনীতিতে তার এখনো যে বিরাট প্রভাব রয়েছে, তা অস্বীকার করতে পারছে না। আলোচনা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে তার ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার গতি-প্রকৃতি এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই আলোচনা রাজনীতির মাঠে-ময়দানে বেশ উত্তাপও ছড়াচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং দুইবার বিরোধীদলীয় নেত্রী না হলেও বিএনপির মতো একটি বহুল জনপ্রিয় ও দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন হিসেবে আলোচনায় থাকবেন। আওয়ামী লীগের ‘হাইব্রিড’ নেতারা যত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যই করুক না কেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি যে শাসক দলের আবারও ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন পূরণের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক, তা বোঝা যাচ্ছে তাদের সাম্প্রতিক এলোমেলো কথাবার্তায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চের প্রকাশ্য এবং নেপথ্যের মুখ্য চরিত্র। কিন্তু আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপি, শেখ হাসিনার পাশাপাশি বেগম জিয়ার নাম উচ্চারিত হলেই কোনো কোনো আওয়ামী ‘দলদাস’ এমনকি কোনো কোনো প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের অ্যাংকর ও আলোচক ‘তিড়িং’ করে লাফিয়ে ওঠেন। অনেকে বলেই ফেলেন কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা! এ তুলনাকে তারা যেন ‘পূত-পবিত্রের’ সঙ্গে ‘অস্পৃশ্যের’ তুলনা মনে করেন অথবা ‘মহৎ-মহানের’ সঙ্গে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র-তুচ্ছ কিছুর তুলনা মনে করেন। কিন্তু এখন আলোচনার প্রবল ধারা দেখে মনে হয়, বাস্তবতা তারা উপলব্ধি করছেন। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই বেগম জিয়া আলোচনায় চলে আসেন। একইভাবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও। দুজনের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। শেখ হাসিনা রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান, বঙ্গবন্ধুর কন্যা। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট। গভ. ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজের (বর্তমানে সরকারি বদরুন্নেসা কলেজ) তিনি নির্বাচিত ভিপি ছিলেন সেই ১৯৬৬-৬৭ সালে। পরবর্তীকালেও রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার জাতীয় রাজনীতিতে অভিষেক অস্বাভাবিক কোনো বিষয় ছিল না। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া কোনো রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরাধিকার বা অতীত রাজনৈতিক-সংশ্লিষ্টতার ঐতিহ্য বহন করেন না। একজন গৃহবধূ থেকে সরাসরি জাতীয় রাজনীতিতে তার বিস্ময়কর উত্থান ও দৃঢ় অধিষ্ঠান। কাণ্ডারিবিহীন একটি দলের তিনি হাল ধরেন শক্ত হাতে, পরিণত হন দলের হতাশ, পথহারা সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর অসীম প্রেরণার উেস। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আপসহীন নেত্রীর মর্যাদা ও দেশনেত্রীর (চট্টগ্রাম লালদীঘি ময়দানে এক জনসভায় দলের নেতা আবদুল্লাহ্ আল নোমান তাকে এ উপাধি দিয়েছিলেন) অভিধায় ভূষিত হন তিনি। স্বৈরাচার এরশাদের পতনে সাহসী এবং জনগণের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালনের পুরস্কার পান একানব্বইর নির্বাচনে। অনেক পর্যবেক্ষকের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং আওয়ামী লীগের দৃঢ় প্রত্যয়কে মিথ্যা প্রমাণ করে দেয় জনগণ। দুই নেত্রীর মধ্য থেকে জনগণ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বেছে নেয় বেগম জিয়াকে। যতদিন তিনি রাজনীতিতে থাকবেন, আলোচনায় থাকবেন— এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন তাকে নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষিতটা ভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

বিএনপিকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন এবং স্পষ্ট করেই বলছেন, বিএনপির জনসমর্থনকে ছোট করে দেখা ঠিক হবে না। এই বক্তব্যের সঙ্গে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার গতি-প্রকৃতি, মামলার রায়ে বেগম জিয়ার সাজা হওয়ার আগাম আশঙ্কা, বেগম জিয়াকে জেলে ঢোকানোর জন্য হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ শাসক লীগের কোনো কোনো হোমরাচোমরার অতি আকুল অভিপ্রায় এবং এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রায়ে বেগম জিয়ার জেল হলে তাকে বন্দী রেখেই নির্বাচন করার সরকারি পাঁয়তারার বিরুদ্ধে বিএনপির অভিযোগ, বেগম জিয়াকে জেলে রেখে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না বা নির্বাচন হতে দেবে না বলে ঘোষণা আর এরই পাশাপাশি বিএনপির ঘোষণাকে ‘আবদার’ বলে সরকারের উচ্চমহল থেকে প্রচ্ছন্ন ধমক— এসব কিছুই বর্তমানের ও আগামী দিনের জাতীয় রাজনীতিতে বেগম জিয়াকেই আলোচনার শীর্ষে রেখেছে। অর্থাৎ তার অবস্থা ও অবস্থান দেশের রাজনীতির জন্য ফ্যাক্টর। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব তো বটেই, তবে বর্তমানে তার অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পেছনে নিজ দল বিএনপি ‘নেতৃত্বের’ প্রচেষ্টার চেয়ে সরকার ও সরকারি দলের ভূমিকা এবং আচরণই বেশি অবদান রাখছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার ও সরকারি দলে এক ধরনের মাত্রাতিরিক্ত অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

 

 

তাদের সামনে ভিশন টোয়েন্টি-টোয়েন্টি ওয়ান। লক্ষ্য বাস্তবায়নে তাদের মরিয়া বলেই মনে হচ্ছে। গেল আট বছর একনাগাড়ে ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের পারফরম্যান্স, দলের অবস্থা ও জনগণের ওপর আস্থাকে সম্বল করে তারা বোধহয় নিশ্চিত হতে পারছে না যে, একটি স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও অবিতর্কিত নির্বাচন হলে পরিস্থিতি তাদের লক্ষ্য পূরণের অনুকূল থাকবে। অজান্তে হলেও তারা সাধারণের মধ্যে এমন একটি ধারণার জন্ম দিচ্ছে যে, আগামী নির্বাচনে তারা যে কোনোভাবেই হোক না কেন, জিতবে। সরকার ও সরকারি দলের ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাটি এমন একপর্যায়ে আছে যে, তা রায় ঘোষণার একেবারে দ্বারপ্রান্তে এসে সরকারি দলের নানা মহলে আনন্দ ও বিএনপি মহলে একটা আতঙ্কের ভাব সৃষ্টি করেছে। আগামী বছরের (২০১৮ সাল) শেষ দিকে যেখানে নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী নির্বাচন কড়া নাড়ছে, এখন থেকেই প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ৩০০ আসনে প্রার্থী বাছাই থেকে নানামুখী প্রস্তুতি শুরু করার কথা, তখন সরকারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রধান নেত্রী ও ভোটকারেন্সি বলে খ্যাত বেগম খালেদা জিয়া সামনে থেকে দলের নেতৃত্ব দিতে পারবেন কিনা, এ প্রশ্নটি অনেক বড় আকারেই দেখা দিয়েছে। এ প্রশ্ন অতি জরুরি আর একটি বিষয়ে জনমনে সন্দেহ উসকে দিচ্ছে যে, তাহলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি কি সব দলের অংশগ্রহণমূলক, অবিতর্কিত এবং গ্রহণযোগ্য হবে, নাকি আমরা আরেকটি ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি’ দেখব! বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কিছু না বললেও উচ্চ পদবিধারী কিছু ব্যক্তি এরই মধ্যে জনমনে যে ধারণার সৃষ্টি করেছেন, তার গলিতার্থ হচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে তারা নির্বাচনে যাবেন না, এমনকি শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখেও তারা অংশ নেবেন না নির্বাচনে। অপরদিকে সরকার পক্ষ বলছে, মামলায় হারলে বেগম জিয়া জেলে যাবেন, কোনো ব্যক্তির জন্য নির্বাচন বন্ধ থাকবে না এবং শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখেই আগামী নির্বাচন হবে। হ্যাঁ, সরকার চাইলে যেনতেন প্রকারে একটি নির্বাচন করে ফেলতেই পারে— সে অভিজ্ঞতা তো আমাদের আছে। স্বৈরাচার এরশাদের আমলে ১৯৮৮ সালে বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ মূল ধারার সব রাজনৈতিক দলকে ছাড়া চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, খালেদা জিয়ার সরকার আমলে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ বামপন্থি সব দলকে বাদ দিয়ে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টির একটি বড় অংশকে (এরশাদ গ্রুপ) বাদ দিয়ে দশম সংসদ নির্বাচন জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটিও তেমন বিতর্কিত, প্রশ্নবিদ্ধ ও দেশ-বিদেশে প্রত্যাখ্যাত হোক, সে ‘ঝুঁঁকি’ কি এখন বাংলাদেশ নিতে পারে, না নেওয়া উচিত? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কয়েকবার বলেছেন, আগামী নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হোক তা তিনি চান না। তার এ বক্তব্যের তাত্পর্য বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। একটি অবিতর্কিত, প্রশ্নহীন নির্বাচনের অঙ্গীকারে এতদিন বিএনপিকেও দৃঢ় দেখা গেছে। নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় দলটির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ জনগণকে আশান্বিত করেছিল। লীগ-বিএনপি রাজনৈতিক সংলাপের একটি আবেগঘন পরিবেশও সৃষ্টি করেছিল। পরবর্তী সময়ে নির্বাচন কমিশন নিয়ে মৃদু-মন্দ সমালোচনার পরও তা প্রত্যাখ্যান না করায় এটা স্পষ্ট থেকেছে যে, নির্বাচনের মহাসড়ক থেকে বিএনপি সরে যেতে চাচ্ছে না।

কিন্তু সরকার ও সরকারি দল কী চায়? বিএনপিকে নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে নতুন ইতিহাসের অন্তর্গত হতে চায়? বিএনপিসহ অপরাপর বাম প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে নির্বাচনী সড়কের বাইরে রাখার ব্যাপারে উৎসাহ দেখাতে চায়? প্রধানমন্ত্রীর ‘প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চাই না’ বক্তব্যকে যদি আমরা তার নীতিগত অবস্থান হিসেবে ধরে নিই, তাহলে বলতে হবে বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের কথা তিনি ভাবছেন না। এখানেই বেগম খালেদা জিয়া প্রাসঙ্গিক এবং আগামী দিনের জাতীয় রাজনীতির তিনি এক অপরিহার্য ও অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত চরিত্র। এটা পরিষ্কার যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি— উভয়ের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের নিশ্চয়তার জন্য। অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে তা অধরাই থেকে যাবে। তেমন একটি নির্বাচনের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত থাকা জরুরি। মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্য থেকে ক্ষমতায় গেলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, সে ব্যাপারে জনগণের কাছে ধারণা স্পষ্ট করা জরুরি। বিএনপি যদি বেগম খালেদা জিয়াকে সেভাবে দেশবাসীর কাছে উপস্থাপন করতে সংকটে পড়ে এবং যদি মনে হয় যে, সংকটটা সরকারের সৃষ্টি তাতে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ অটুট থাকবে না। তাই ‘খালি মাঠে গোল’ দেওয়ার সরকারি চেষ্টার যে অভিযোগ বিএনপির কেউ কেউ করছেন, তা সত্যি হলে নির্বাচন গণআকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে না। বেগম জিয়ার মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে সরকার যদি আদালতের ওপর ছড়ি ঘোরানোর চেষ্টা করে এবং জনগণ তা বিশ্বাস করে ফেলে যে, বিএনপি যাতে নির্বাচন বর্জনের ভুল পথে যায় তাতে প্ররোচনা দেওয়ার লক্ষ্যে, তথা বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার জন্য সরকার বেগম জিয়াকে নিয়ে কোনো ধুরন্ধর ঘুঁটি চালছে এবং রাজনৈতিক হয়রানির জন্য সরকার সুপরিকল্পিতভাবে এগোচ্ছে, তাতে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। মানুষ ভাববে, সরকার বেগম জিয়াকে ভীষণ ভয় পাচ্ছে। তাতে সরকার ও সরকারি দলের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এর ফলে বেগম জিয়ার প্রতি সাধারণ ও দলনিরপেক্ষ মানুষের সহানুভূতিসূচক সমর্থন বেড়ে যেতে পারে। ফ্যাক্টরটা বেগম জিয়া। বিএনপি কী করতে চায়, তা এখনো স্পষ্ট নয় সত্য, তবে কারও কারও মধ্যে খারাপ বা নেতিবাচক প্রবণতার ব্যাপারেও অনেকে সন্দিগ্ধ। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সরকার ও সরকারি দল কী করছে বা করতে চায়, সে ব্যাপারে পেরেশান না হয়ে আদালতের ওপর তাদের আস্থার ভাবটা প্রকাশ করা উচিত। জনমনে কিন্তু প্রশ্ন আছে, বেগম জিয়ার এই দুই মামলায় তাদের দলের প্রথিতযশা আইনজীবীরা লড়লেন না কেন? এখন মামলার রায় যদি বেগম জিয়ার বিপক্ষে যায়, তাহলে বিএনপি কি সত্যিই নির্বাচন বর্জনের পথে হাঁটবে? তাতে কি তাদের লাভ হবে? পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, নির্বাচন বর্জন বিএনপির জন্য আরও বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। বরং বেগম জিয়া যদি আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন এবং দণ্ডিত হন, তা তাদের জন্য কল্যাণও বয়ে আনতে পারে। মুক্ত বেগম জিয়ার চেয়ে বন্দী বেগম জিয়া অধিকতর শক্তিশালী হয়ে যেতে পারেন। সেই ‘শক্তিশালী বেগম জিয়াকে’ তারা যদি ভোটের রাজনীতির পুঁজি করতে পারেন তাতে শাসকদলের স্বপ্নভঙ্গ হয়ে যেতে পারে। নির্বাচনে থাকলে দেড়-পৌনে দুই বছরে দলের ভিতর প্রাণ ফিরে আসতে পারে, এতদিন দল গোছানোর যে কাজটি হয়নি বেগম জিয়াকে কেন্দ্র করে দলে একটা সাংগঠনিক উন্মাদনা সৃষ্টি হতে পারে, বিভেদ, রেষারেষি ভুলে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনী সাফল্যের লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। ক্ষমতা বা ক্ষমতার বাইরে যেখানেই থাক, বিএনপি দেশের একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণার সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। বিএনপি কী করবে নির্ভর করছে খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তের ওপর। তিনি নিশ্চয়ই বোঝেন, ‘আগরতলা মামলা মিথ্যা মিথ্যা’— এ গগনবিদারী স্লোগান ও দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সেই মামলা প্রত্যাহারে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরকারকে বাধ্য করার মতো সাংগঠনিক শক্তি তার দলের নেই, বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়ানো একজন মওলানা ভাসানীর মতোও কেউ নেই তার পাশে দাঁড়ানোর। মামলার রায় তার পক্ষে না এলে তা কি ঠেকানো যাবে (আমরা জানি না রায় কী হবে)? তার দলের কারও কারও শঙ্কা, তার সাজা হয়ে যাবে। যদি তা হয় বেগম খালেদা জিয়া কি জেলকে ভয় পাবেন? তিনি কি চাইবেন ব্যক্তি বা নেত্রী খালেদা জিয়ার জন্য দল আবারও ভুল করুক। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, খালেদা জিয়া যে কোনো পরিস্থিতিতে তার দলকে নির্বাচনের মহাসড়কেই রাখবেন। নির্বাচনকে তিনি বিবেচনা করবেন আন্দোলনের অংশ হিসাবে। কারণ এর সঙ্গে শুধু তার নিজের বা তার দলের নয়, দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ এবং রাষ্ট্রের মর্যাদা ও স্বার্থও জড়িত। বলতে পারেন, এ ব্যাপারে সব করণীয় কি শুধু খালেদা জিয়ার? প্রধানমন্ত্রী, তার সরকার ও দলের কিছু করণীয় নেই? অবশ্যই আছে এবং জনগণ সে হিসাব রাখছে। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, নিকট ভবিষ্যতের জাতীয় রাজনীতির গতিপথে খালেদা জিয়ার উজ্জ্বল উপস্থিতি থাকছেই— হয় মুক্ত খালেদা, নতুবা বন্দী খালেদা।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর