রবিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভাষার বাঁচা-মরা

তসলিমা নাসরিন

ভাষার বাঁচা-মরা

পৃথিবীতে ভাষা আছে প্রায় সাত হাজারের মতো। অর্ধেকই মরে যাবে। প্রতি দু’সপ্তাহে একটি করে ভাষার মৃত্যু হচ্ছে, বাংলা ভাষারও মৃত্যু হবে। ভাষাকে গায়ের জোরে টিকিয়ে রাখা যায় না। ভাষাকে ভালোবাসা দিয়ে টিকিয়ে রাখা যায়। বাংলা ভাষাকে ভালোবাসার জন্য খুব বেশি বাঙালি অবশিষ্ট নেই। যে বাঙালির বাংলা ভাষা ছাড়া আর কোনও ভাষা জানা নেই, সেই বাঙালিই বাধ্য হয়ে বাংলা  ভাষাটি বলে। একে বিকৃত করার চেষ্টা অনেক আগে থেকেই চলছে। অনেক বাঙালি আছেন, যারা ইংরেজি ভালো জানলে ইংরেজিটাই বলতেন, হিন্দিটা, উর্দুটা, আরবিটা ভালো জানা থাকলে ওগুলোই বলতেন, বাংলা বলতেন না। প্রচুর বাঙালিকে আমি দেখেছি ইংরেজি কম জেনেও সাহেব সাজার জন্য ইংরেজি বলেন। আরবি কম জেনেও ইসলাম বিশেষজ্ঞ সাজার জন্য আরবি বলেন। বাংলাকে ভালো আসলে কজন বাসে? ইংরেজি মাধ্যমে পড়া শহরের ছেলেমেয়েরা পারতপক্ষে বাংলা বলতে চায় না। এরাই যদি দেশের ভবিষ্যৎ হয়, তবে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ ঠিক কী, তা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারি।   

ভাষার বিবর্তন  প্রতিনিয়ত  হচ্ছে। ২০১৭ সালে প্রকাশিত উপন্যাসের ভাষার সঙ্গে ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত প্যারিচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলালের ভাষার বিস্তর পার্থক্য। বিবর্তিত হয়ে বাংলা শেষ অবধি কোথায় পৌঁছোবে, জানি না। তবে বাংলা ভাষায় নানা ভাষা থেকে শব্দ এসেছে, কিছু শব্দ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এসেছে, কিছু শব্দকে আনা হয়েছে জোর করে। জোর করে শব্দ ধরে আনলে পুলক জোটে হয়তো, আপাতত ভাষাকেও কিঞ্চিৎ মেদবহুল করা যায়, কিন্তু আখেরে ভাষার লাভ কী দাঁড়ায় সেটাই দেখার বিষয়। ভাষা ক্রমশ হাড্ডিসার হচ্ছে, ভাষার গায়ে  রকমারি অলংকার চড়ানো হচ্ছে। বাংলার বৈজ্ঞানিক পরিভাষার হাল দেখলে চোখে জল আসে।  প্রতিশব্দ কি রচিত হচ্ছে যতটা রচিত হওয়া উচিত? একসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছেন বৈজ্ঞানিক পরিভাষা। অভিযোজন (Adaptation), প্রজননতত্ত্ব, আঙ্গিক (Technique) এসব রবীন্দ্রনাথের তৈরি শব্দ। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ শিক্ষার জন্য পারিভাষিকের প্রয়োজন আছে। কিন্তু পারিভাষিক চর্ব্য জাতের জিনিস। দাঁত ওঠার পরে সেটা পথ্য। সেই কথা মনে করে যতদূর পারি পরিভাষা এড়িয়ে সহজ ভাষার দিকে মন দিয়েছি’। সহজ ভাষায় লিখতে গিয়ে অনেক সহজ পরিভাষা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, যেমন লাল উজানি আলো ((infra red light), বেগনি পারের আলো (ultra violet light),  গ্রহিকা (asteroid), আঙ্গারিক গ্যাস (কার্বন ডাই অক্সাইড)। তাঁর তৈরি   প্রতিশব্দ প্রচলিত হয়নি। অনেক বিদেশি বৈজ্ঞানিক শব্দকে রবীন্দ্রনাথ  সে কালেই  বাংলায় গ্রহণ করেছেন, যেমন হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, প্রোটন, নিউট্রন, পজিটিভ, নেগেটিভ। আজকাল টেকনোলজি সম্পর্কিত ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ কোনও কবি বা সাহিত্যিক তৈরি করার চেষ্টা করেন বলে মনে হয় না। প্রতিশব্দ তৈরি হলেও আমার মনে হয় না আদৌ কেউ ব্যবহার করতে চাইবে সেসব। শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলছে দাদি নানীরা, মা মাসিরা। হাই টেক জীবন তাদের না হলেও চলে। হাই টেক জীবন যাদের, তারা একটি বাংলা বাক্য বললে বাক্যের দশটির মধ্যে পাঁচটি  শব্দই থাকে ইংরেজি। তারা পরিভাষা পছন্দ করে না।  

 

 

অঞ্জন বন্দোপাধ্যায় সুন্দর লিখেছেন ‘বাংলাকে আমরা কিন্তু শুধু অন্দরমহলের ভাষা করেই রাখলাম এ যাবৎ। কর্মজগতের ভাষা বা গুরুতর চর্চার ভাষা হিসেবে বাংলাকে বেছে নেওয়ার চেষ্টাই করলাম না সে ভাবে। একটু ঘরোয়া কথকতা, একটু রোয়াকি আড্ডা, একটু ভালবাসা, একটু বিতণ্ডা, একটু খুনসুটি, একটু রং-তামাশা এর বাইরে সে ভাবে কোনও ভূমিকাই নিতে দিলাম না বাংলা ভাষাকে। বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে, গল্পে-গানে-বিনোদনেও বাংলাকে আমরা রেখেছি ঠিকই। কিন্তু এইটুকু ব্যবহারিক পরিসর ভাষার কাঙ্ক্ষিত বিকাশের জন্য যথেষ্ট নয়। সে বিকাশের জন্য জীবনের গূঢ়তর এবং গুরুতর ক্ষেত্রগুলিতেও বাংলার ব্যবহার সুনিশ্চিত করা জরুরি ছিল। সে চেষ্টা আমরা করলাম না। বাংলাকে আমার খিডকি-পুকুর বানিয়ে রাখলাম, যেখানে শুধু বাসন মাজি। বাংলাকে সেই মহাসমুদ্র হয়ে উঠতে দিলাম না, যে জলভাগে বাণিজ্য তরী ভাসিয়ে আমি বিশ্বজয় করতে পারি। বাণিজ্যের জন্য আমরা বেছে নিলাম ধার করা জলভাগকে।

ভাষা ক্রমবিবর্তনশীল, ভাষা ক্রমবিকাশশীল। সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী, কোনও ভাষাই আজ পর্যন্ত সর্বাঙ্গীণ পূর্ণতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেনি। আদান-প্রদানের ঘাত-প্রতিঘাতেই ভাষার বিকাশ হয়, ভাষার শব্দকোষ বাড়ে, ভাষা বলিষ্ঠ হয়, ভাষা প্রসার পায়। কিন্তু বাংলাকে অন্দরমহলে কুক্ষিগত করে রেখে সেই ঘাত-প্রতিঘাতটা থেকেই বঞ্চিত করলাম আমরা’।

দরিদ্রের ভাষার এই-ই হাল হয়। রাজনীতিতে, শিক্ষায়, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, বাণিজ্যে বাংলা পিছিয়ে আছে বলে বাংলা ভাষার কোনও মূল্য নেই বাইরের দুনিয়ায়। একসময় মানুষ ইংরেজি ফরাসি শিখেছে ওই ভাষা ঔপনিবেশিক প্রভুদের ভাষা ছিল বলে। পর্তুগিজ, স্প্যানিশ, ওলন্দাজ ভাষা বাণিজ্যের কারণে শিখতো। দুর্বলের এবং দরিদ্রের  ভাষা কেউ শিখতে চায় না। বাংলা শিখে চাকরি পাওয়া যায় না বলে বাঙালিরা বাংলা শেখে না, সেখানে বিদেশিরা কেন শিখবে বাংলা। এশিয়ার যে ভাষা শিখতে মানুষ আগ্রহ প্রকাশ করে, তা জাপানি অথবা চৈনিক।

আক্ষেপ করা মানে সময় নষ্ট করা।  আর সব কিছুর মতো করে বাংলা ভাষাও নিজের মতো বেঁচে থাকবে। ভালোবেসে এটিকে উচ্চারণ যত করবো, ভাষা তত বেঁচে থাকবে। একে যত দূরে সরাবো,  তত  দূরে সরবে।  সত্যি কথা বলতে কী, বাংলা ভাষাটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে বিদেশিদের বাংলা ভাষা জানার দরকার নেই, বাঙালিকেই বাংলাটা জানতে হবে। তাহলেই টিকে থাকবে। ভালোবাসলে আর সবকিছু যেমন টিকে থাকে, ভাষাও তেমনি টিকে থাকে। আর তা না হলে পরিণতি তো আমরা জানিই, মৃত্যু। মরলেও সহজে মরছে না, দীর্ঘ সময় নেবে। পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম ভাষা বাংলা। একুশ কোটি মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। একুশ কোটি মানুষের মুখের ভাষা খুব শীঘ্র কেড়ে নেওয়ার মতো বড় স্বৈরাচারী এখনও তৈরি হয়নি কোথাও। তবে এটা ঠিক, পৃথিবীতে এই  বাঙালিই  তার ভাষাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে, আবার এই বাঙালিই তার ভাষাকে প্রাণপণে ঘৃণা করে। বাঙালিই এই ভাষাকে বাঁচিয়েছে, বাঙালিই এই ভাষাকে মারবে। বাইরের কোনও বহিরাগত আঁততায়ীর দরকার হবে না এ কাজে।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর