রবিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

জাতীয় নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে কথা

রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী

প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত হওয়ার পর কে এম নূরুল হুদাকে তার পটুয়াখালীর বাউফলের বাড়িতে গিয়ে তাকে ফুলের তোড়া দিয়েছেন, মিষ্টিও খাইয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। ব্যাপারটা অনেকের কাছে ‘খুব সুন্দর’ মনে হয়নি। তবুও আমরা আশাবাদী হতে চাই, হুদা কমিশনের নেতৃত্বে সামনে একটি সুষুম, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন হবে।

সুষ্ঠু নির্বাচন মানুষ কেন চায়? চায় এই জন্য যে, সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া শক্তিশালী বিরোধী দল হয় না। আর সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্রও মজবুত হয় না। মনে পড়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, সত্তর দশকের শেষভাগে তখনকার পরিস্থিতিতে নতুন করে আওয়ামী লীগকে রেজিস্ট্রেশন দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রের একমাত্র রাজনৈতিক দল ‘বাকশাল’ সিস্টেমের পরে সব রাজনৈতিক দলকেই নতুন করে রেজিস্ট্রেশন নিতে হয়েছিল জিয়ার আমলে। তিনি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তাদের স্বপক্ষ-শক্তিকে জোটবদ্ধ হয়ে জেনারেল ওসমানীকে প্রার্থী করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। দেশে এখন যে অবস্থা তাতে কি আশা করা যায় আওয়ামী লীগও বিএনপির জন্য ওরকম সুযোগ তৈরি করে দেবে? না, তা মনে হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কারও কারও বোলচাল দেখে মনে হয়— বিএনপিকে রাজনীতি করতে দেওয়াটাই যেন করুণা করা। এই ভঙ্গি ঠিক নয়। শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যাওয়া যায়, বিব্রতমুক্ত থাকা যে যায় না, আশা করি সেই অভিজ্ঞতা এতদিনে আওয়ামী লীগের হয়েছে। নইলে আগামীতে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন পরিহারে শাসকদল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতো না।

জেনারেল আইয়ুবের আমলে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আদালতে শাস্তি দিয়ে নির্বাচনের বাইরে রাখার অপচেষ্টা কম হয়নি। জেনারেল ইয়াহিয়া তো তাকে দুনিয়া ছাড়াই করতে চেয়েছিলেন। ওই দুই একনায়ক কি প্রাতঃস্মরণীয় হয়েছেন? এখন বাতাসে একটা কথা ঘুরে বেড়াচ্ছে, ‘খালেদা জিয়াকে মামলায় সাজা দিয়ে নির্বাচনের বাইরে রাখার ব্যবস্থা হচ্ছে’।

জানিনা কী হবে? তবে রাজনৈতিক মহল বলছে, মাইনাস খালেদা ফর্মুলা একটি ব্যর্থ ফর্মুলা। যেমন ব্যর্থ ফর্মুলা মাইনাস হাসিনা। বর্জ্য ফর্মুলার ব্যবহার কখনো রাজনৈতিক সুফল দেয় না। আশার কথা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপির রাজনৈতিক শক্তিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপি কোনো দুর্বল দল নয়, তাকে হেলাফেলা করা যাবে না। তার এই সততাপূর্ণ স্বীকারোক্তিকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের একটা অংশের মধ্যে একটা বদ্ধমূল ধারণা— বিএনপি তার প্রধান মিত্রদল জামায়াতে ইসলামী এবং আওয়ামী লীগবিরোধী অন্যসব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন বিসর্জন দিতে চলেছে। এই বাংলাদেশকে তারা পাকিস্তানি ভাবধারার রাষ্ট্রে পরিণত করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির সবাইকে চিরতরে উচ্ছেদ করে দিতে চাচ্ছে। এসব অভিযোগের ‘কনভিনসিং’ জবাব বিএনপিকে দিতে হবে। তবে এমনিতে বিএনপি বলছে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেই চলছে এবং চলবে। তবে চলার জন্য যে দৃঢ়তা দরকার তা এখন অনুপস্থিত বলে মনে করেন এই দলের শুভার্থীরা। অপ্রিয় সত্য হচ্ছে এই দলটির ভিতরে নেতিবাচক শক্তিগুলো এমনভাবে ভিত্তি গেড়ে বসেছে যে, তার সাংগঠনিক ক্ষমতা এখন তলানিতে ঠেকেছে। কেবল নেতা আর নেতা, কর্মী নেই, সংগঠক নেই। আর সংগঠিত কর্মীবাহিনীর শক্তি ছাড়া এই দলটিও এখন কেবল আওয়াজসর্বস্ব দলে পরিণত হতে চলেছে। তাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি অর্জন। জিয়াউর রহমানের আমলের কর্মীদের, সংগঠকদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সংস্কৃতি আবার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে সুচারুরূপে। সেই লক্ষ্যে আদর্শবাদী রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন দরকার।

অনেক দেরি হয়ে গেছে, সময়ক্ষেপণের আর সময় নেই। এক্ষুনি শুরু করে বিএনপিকে সাংগঠনিক শক্তিতে সবল হওয়ার অবিরাম প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বিএনপির সামনে আন্দোলনের পথ অপেক্ষমাণ, তাই এই দলটির জন্য সামনের পরীক্ষাটিও কঠিন। আন্দোলন ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব একচুলও ছাড় দেবে না কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে।

তাই বিএনপিকেই নিজের আন্দোলন শক্তি দ্বারা কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করে নিতে হবে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে-গড়া সত্যিকার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শভিত্তিক একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল বিএনপি। তাকে দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার, প্রকৃত গণতন্ত্র কায়েম করার ক্ষমতায় পুষ্ট হতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এই দলটি সময়ের বিবর্তনে জিয়াউর রহমানের আদর্শের সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার বাইরে বহু ভুঁইফোড় নেতার দলে পরিণত হয়েছে। একইভাবে আওয়ামী লীগও অনেক হাইব্রিড নেতার আবির্ভাব ঘটেছে বলে ওই দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিকবার উচ্চারণ করেছেন।

বিএনপি এখন কর্মীর দল নয়, বহু নেতার দল। এখন যদি বিএনপিকে শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তির ওপরে দাঁড় করানো না যায়, তাহলে এই দলটির অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। সাংগঠনিক প্রক্রিয়া মানে নতুন নতুন কর্মী সংগ্রহ, সংগঠককে তৈরি করা ও তাদের প্রশিক্ষিত করে তোলা— তাদের প্রকৃত দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করাই এখন সবচেয়ে বড় কাজ বিএনপির। জিয়াউর রহমান কীভাবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের দর্শনকে দলের মূল আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন সেই বিষয়ের বিস্তারিত নতুন প্রজন্মের কর্মীদের উপলব্ধি করাতে হবে। মনে রাখতে হবে দলের শীর্ষপর্যায়ের কয়েকজন নেতার নামে গলা ফাটিয়ে ‘জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দেওয়ার মধ্যেই আন্দোলনের সাফল্য নিহিত নয়। দলটির প্রকৃত গণতন্ত্র-চর্চার কেন্দ্রে পরিণত করা দরকার, সেটি কোনো অসম্ভব কাজ নয়। কর্মী ও সংগঠকরা, বিশেষভাবে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ তৈরি আছেন, কিন্তু তৈরি নন শীর্ষপর্যায়ের মূল নেতৃত্ব, মধ্যপর্যায়ের নেতারা। 

বিএনপির মধ্যপর্যায়ের নেতারা, কর্মীরা ও সংগঠকরা যাতে একটা পরিচ্ছন্ন রাজনীতির ধারায় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয় সেই লক্ষ্যে একটা বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে, সেটি হবে একটি টেস্ট-কেসেরই মতো। যারা সত্যিকার অর্থেই বিএনপির বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শে বিশ্বাসী, যারা সেই আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হবে, তারা টিকে থাকবেন, তারাই দলে পদোন্নতি পাবেন, সেই নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে। এখানে কোনো ছাড় দেওয়া চলবে না।

লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক

সর্বশেষ খবর