বৃহস্পতিবার, ২ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন : ‘এসব দেখি কানার হাটবাজার’

মুহাম্মদ সামাদ

পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন : ‘এসব দেখি কানার হাটবাজার’

মূল প্রশ্নটি আত্মপরিচয়ের, অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ার। বাঙালি ও আমাদের অন্য জাতি-গোষ্ঠী হাজার বছর ধরে যে জীবন সংগ্রামে ব্রতী তার অমানবিক বিনাশ কী করে মেনে নেওয়া যায়? আমরা নিত্যদিন জ্ঞানভিত্তিক, আরও এগিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের কথা বলি। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো জাত-ধর্ম কেউ কি কখনো দেখে বা মানে? সক্রেটিস থেকে রুমী, রুমী থেকে রবীন্দ্রনাথ বা কোপার্নিকাস-গ্যালিলিও থেকে ইবনেসিনা; আইনস্টাইন-লুই পাস্তুর থেকে জগদীশ চন্দ্র বসু— সবার জ্ঞান ও আবিষ্কার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কল্যাণকর ও সর্বজনীনভাবে গ্রহণীয়।  তাই আজ সূর্য নয়, পৃথিবী ঘুরে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রসারে শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, যাতায়াত ও যোগাযোগের সুবিধা ভোগ করতে গিয়ে ধর্মের পরিচয়ে কেউই লেখক-দার্শনিক বা আবিষ্কর্তাকে খুঁজে না। সাহিত্য-দর্শন ও ধর্মের প্রবক্তাদের সমাজহিতকর উপদেশবাণী সবার নৈতিক উন্নতি সাধনে নিবেদিত। সে পথেই মানুষের জীবনপ্রণালি বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের জায়গায় পৌঁছেছে। যেমন— গুহার আঁকাআঁকি থেকে লেখাজোখা ও চিত্রকলার এমন উত্তরণ। মানুষ এগিয়েছে আর এগিয়েছে। পেছনে যে তাকায়নি তা নয়। তাকিয়েছে ঐতিহ্যের সন্ধানে, যে ঐতিহ্যে মানবের মঙ্গল নিহিত।

অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে শিশু-কিশোরদের পাঠ্যপুস্তকে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী। কিন্তু বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ও দীর্ঘমেয়াদে এই পরিবর্তনে শনৈঃশনৈঃ শক্তিশালী হবে বর্বরতা। দুর্বল হবে সত্য, ন্যায় ও মানবিক বোধ। বিঘ্নিত হবে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও শান্তির পরিবেশ।

পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তনে মোটাদাগে প্রাচীন ভারতের কথা কাহিনী, সনাতন ধর্মাবলম্বী লেখকদের কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ ও বাংলাদেশের শুভবাদী কবি-সাহিত্যিকদের রচনা বাদ দেওয়া হয়েছে। আমার প্রশ্ন— সেসব কবিতা, গল্প ও কথা কাহিনীতে কি শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা ও ন্যায় শিক্ষার পরিপন্থী কিছু ছিল? সেগুলো পাঠ করে শিক্ষার্থীরা কি হলি আর্টিজানের জঙ্গিদের মতো অসহিষ্ণু, হিংস্র ও বর্বর হয়ে উঠত? নাকি অন্য ধর্মের সহপাঠীদের মানবসন্তান পরিচয়ে বন্ধুত্বের অমলিন বন্ধনে আবদ্ধ না হয়ে ক্ষুদ্র ধর্মীয় পরিচয়ে বিদ্বেষপূর্ণ আচরণে উদ্বুদ্ধ হতো? নিশ্চয়ই নয়। বরং আমরা নিশ্চিত জানি যে, বাদ দেওয়া রচনাগুলোতে কোনো ধর্মের প্রতি কটাক্ষ বা মানুষকে হেয় করার মতো কিছু তো ছিলই না, বরং সব ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ ও সম্প্রীতিময় জীবনের মুক্তধারা প্রবহমান ছিল।

এমনিতেই আমাদের শিক্ষব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই বৈষম্যপূর্ণ। একমাত্র প্রাইমারিতেই রয়েছে দশ/এগার ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম। এতদিন কচি ও কোমলমতি শিশুদের শেখানো হয়েছে মনো-সামাজিক বিভক্তি ও বিভাজন। এখন আবার পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন এনে তাদের মনে ও মননে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ। এ দ্বিধাবিভক্ত ও বিভ্রান্ত প্রজন্ম নিজেরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আর আমাদের আবহমান সংস্কৃতিকে নিয়ে যাবে কোন পথে?

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমি পথের পাশের ধানক্ষেতে, জলাশয়ে ও যমুনাতীরের বধ্যভূমিতে গুলিবিদ্ধ নিহত মানুষদের দেখেছি। নদীতে ধর্ষিত নারীর বীভৎস মৃতদেহ ভেসে যেতে দেখেছি। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে গরু-ছাগলের সঙ্গে দড়িতে বেঁধে আনা নিরীহ সরল কৃষক ও নারী-শিশুদের মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত মুখমণ্ডল দেখেছি। নিমিষে হিন্দু জনগোষ্ঠী ও আওয়ামী লীগের লোকজনের বাড়িঘর, চাল-ডাল, ঘটি-বাটি লুণ্ঠিত হতে দেখেছি। দিনের আলোতে ধরে নিয়ে যাওয়া স্বজনকে লাশ হয়ে নদীতে ভেসে উঠতে দেখেছি। রাইফেল, এসএমজি ও এলএমজি কাঁধে খালি গায়ে লুঙ্গি পরা, সামান্য চিড়ামুড়ি বা চালভাজা খেয়ে যুদ্ধ করা অকুতোভয় শীর্ণকায় মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেছি। পাকহানাদার আর আলবদর-রাজাকারদের হাতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার দেহ থেকে উরু আলাদা করা দুই খণ্ড মৃতদেহের পৈশাচিক ও হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখেছি। পাড়ার লোকদের পরামর্শে পরিচয় গোপন রেখে শেষবারের জন্য দেখতে আসা শহীদ পুত্রের রক্তমাখা মুখমণ্ডলে ঝরে পড়া পিতার চোখের জল আর কম্পমান হাতের আদর দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রম হারানো ‘বীরাঙ্গনা’, শহীদজায়া ও শহীদের পুত্র-কন্যাদের এখনো দিন কাটে বুকে অপার বেদনা ও দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে। আর এ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত, পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘ কারাবরণকারী ঋষিতুল্য লেখক রণেশ দাশগুপ্তের গল্প ‘মাল্যদান’ পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে!

আমরা তো দেখছি, একাত্তরে শোচনীয়ভাবে পরাজিত পাকিস্তান এখন নতুন করে তাদের দূতাবাস ও নানান মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির কী ভয়ানক চিত্র তুলে ধরছে। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকহানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যার শিকার রিকশার ওপরে পড়ে থাকা লাশের যে ছবিগুলো নৃশংস গণহত্যার নিদর্শন হিসেবে দুনিয়াজুড়ে প্রকাশিত ও প্রচারিত রয়েছে, সেই ছবিগুলো ‘মুক্তিযোদ্ধাদের বর্বরতার নিদর্শন’ হিসেবে অপপ্রচার করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। এহেন অপকর্ম রোধে নতুন প্রজন্মের পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাবিরোধী পরিবর্তন কী সর্বনাশ ডেকে আনবে তা কি নতুন করে বলার প্রয়োজন আছে?

পশ্চিম এশিয়ার সিরিয়া ও ইরাকের বিশাল এলাকা নিয়ে ইসলামী স্টেটের হত্যা-ধর্ষণ ও সন্ত্রাসের রাজত্ব; পৃথিবীজুড়ে জঙ্গিবাদীদের চলমান বর্বরতার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের হলি আর্টিজানের হত্যাকাণ্ড ও নির্দয়তা সমাজকে বাকরুদ্ধ করলেও থেমে নেই তাদের নিষ্ঠুর অপতত্পরতা। আরও ভয়াবহ যে, বাংলাদেশে এখন ছোট ছোট দলে ভাগ করে দেওয়া দায়িত্বপ্রাপ্ত নারী জঙ্গিদের ‘হিজরতে’ থাকার খবর কাগজে বেরোচ্ছে প্রতিদিন। যখনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো জঙ্গি আস্তানার খোঁজ পায়, সেখানেই দেখা যায় অস্ত্র ও বোমার সঙ্গে তথাকথিত ‘জিহাদি’ বইয়ের স্তূপ। আর এসব ‘জিহাদি’ বই-ই আমাদের সন্তানদের অন্ধ করে দেওয়ার মোক্ষম অস্ত্র; তাদের জীবন চলার পথ বন্ধ করে দেওয়ার পাহাড় সমান বাধা; প্রতিদিন পিতা-মাতাদের ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে এসব বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী বই। অথচ পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ভাষাবিজ্ঞানী-কবি হুমায়ুন আজাদের ‘বই’ কবিতাটি। আসুন একবার দেখি কী আছে কবিতাটিতে : ‘বইয়ের পাতায় প্রদীপ জ্বলে/বইয়ের পাতা স্বপ্ন বলে।/যে-বই জুড়ে সূর্য ওঠে/পাতায় পাতায় গোলাপ ফোটে/সে-বই তুমি পড়বে।/যে-বই জ্বালে ভিন্ন আলো/ তোমাকে শেখায় বাসতে ভালো/ সে-বই তুমি পড়বে।/ যে-বই তোমায় দেখায় ভয়/ সেগুলো কোনো বই-ই নয়/ সে-বই তুমি পড়বে না।/যে-বই তোমায় অন্ধ করে/যে-বই তোমায় বন্ধ করে/সে-বই তুমি ধরবে না।’ তাই, ভেবে দেখতে বলি— আমাদের শিশু-কিশোরদের পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত এ নিটোল কবিতাটির কী অপরাধ ছিল? এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তনের এহেন আত্মঘাতী পশ্চাত্গমনের জন্য দায়ী কারা? লাখ মানুষের অমূল্য জীবন, নারীর সম্ভ্রম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মূল্যে অর্জিত বাংলাদেশে, ভূতের পায়ে ভর দিয়ে পিছন দিকে ফিরে যাওয়ার অপচেষ্টায় কারা কলকাঠি নেড়ে চলেছে? হাজার বছরের শ্রমে-ঘামে-সংগ্রামে উজ্জ্বীবিত একটি মুক্ত, সম্প্রীতিময় ও সুন্দর সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ রোপণ করে দিচ্ছে কারা? আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রধান ভিত্তিমূল স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার কোনো তোয়াক্কা না করে, পাঠ্যবই সম্পাদনায় যুক্ত বিশেষজ্ঞদের মতামত না নিয়ে, ধর্মান্ধ-কূপমণ্ডূক গোষ্ঠীকে তুষ্ট করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ রচনাগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। এটি কখনো কি কাম্য হতে পারে?  এত রক্তেভেজা পথ পাড়ি দেওয়ার পরেও রাজনীতিক, সমাজপতি ও আমাদের নিজেদের উদ্দেশ্যে আবারও উচ্চারণ করতে হয় মরমি সাধক লালন শাহের অমর পঙিক্তমালা : ‘এসব দেখি কানার হাটবাজার।/বেদবিধির পর শাস্ত্র কানা.../পণ্ডিত কানা অহংকারে, সাধু কানা অনবিচারে/মাতব্বর কানা চোগলখোরে/ আন্দাজী এক খুঁটো গেড়ে/জানে না সীমানা কার।’

     লেখক : কবি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

সর্বশেষ খবর