রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
মুক্তিযুদ্ধ

একাত্তরের পাকিস্তানি হানাদারদের ‘টর্চার সেল’গুলো ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করুন

জেড এ এম খায়রুজ্জামান

একাত্তরের পাকিস্তানি হানাদারদের ‘টর্চার সেল’গুলো ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করুন

শহীদ ক্যাপ্টেন বাশার

আপনি যদি বাসে চেপে বনানী ফ্লাইওভার দিয়ে এয়ারপোর্ট রোডে অবস্থিত কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের দিকে অগ্রসর হন তাহলে আপনার বাঁয়ে অবস্থিত ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ বাশার রোডের প্রবেশমুখে অবস্থিত মার্বেল পাথরে গড়া দৃষ্টিনন্দন বিশাল স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ভটি আপনার নজরে পড়বে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে এ স্থাপনাটি স্বাধীনতা-উত্তরকালে নির্মাণ করেন। Heroes Live Forever (বীরেরা চিরকাল বেঁচে থাকেন) এই স্লোগান সংবলিত স্মৃতিস্তম্ভটি শত শত বাশার (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্বাধীনতার শহীদ সদস্যদের) স্মরণে নির্মিত হয়। পাকিস্তান আমলে শহীদ বাশার রোডটি স্টাফ রোড হিসেবে পরিচিত ছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে স্বদেশ মুক্ত হওয়া পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ নতুনভাবে এই সড়কটি স্বাধীনতার শহীদ বিএ-৬৯৬৬ ক্যাপ্টেন আর এ এম খায়রুল বাশারের নামে নামকরণ করেন। শহীদ ক্যাপ্টেন বাশার একজন অকুতোভয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধকালে চট্টগ্রাম সেনানিবাসস্থ স্টেশন সাপ্লাই ডেপোর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

ঢাকা সেনানিবাসের প্রতি ইঞ্চি ভূমি ঐতিহাসিক নিদর্শন। প্রকৃতপক্ষে ইতিহাস এখানে জীবন পেয়েছে। এখানে একটি টর্চার সেলে ক্যাপ্টেন বাশার হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর হাতে বর্বর নির্মমতার শিকার হয়ে ১৯৭১ সালের ২৯ মে তারিখে শাহাদাতবরণ করেন। তার সমাধিটি আজও অনাবিষ্কৃত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তখনকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেলুচ রেজিমেন্ট ক্যাপ্টেন বাশারের অধিনায়কত্বাধীন স্টেশন সাপ্লাই ডেপোটি আক্রমণ করে। উদ্দেশ্য ছিল একটাই— বাঙালি সেনা অফিসারের অধিনায়কত্বাধীন সাপ্লাই ডেপোটি দখল করা। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কোনো বাঙালি সেনা অধিনায়কের অধীন কোনো ইউনিটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এটাই সর্ব প্রথম হামলা। ক্যাপ্টেন বাশারের নেতৃত্বাধীন বাঙালি সেনারা পাকিস্তানিদের এই কাপুরুষোচিত আক্রমণ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে প্রতিহত করেন এবং স্টেশন সাপ্লাই ডেপো থেকে দখলদার বাহিনীকে দক্ষতার সঙ্গে তাড়িয়ে দেন। তখন থেকেই ক্যাপ্টেন বাশার পাকিস্তানি সামরিক জান্তার আক্রোশের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন।

পাকিস্তানি জান্তা ক্যাপ্টেন বাশারকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রস্তাবিত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় রাষ্ট্রের পক্ষে রাজসাক্ষী হওয়ার প্রস্তাব করে। কিন্তু তিনি প্রস্তাবকারীদের মুখের ওপর এই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। সঙ্গে সঙ্গে বাংলার এই সূর্য সন্তানের ওপর নেমে আসে বর্বরোচিত নিপীড়ন। এমনকি সে সময় ক্যাপ্টেন বাশারের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী যিনি প্রথমে ঢাকা সেনানিবাসে এবং পরবর্তীতে ঢাকার ধানমন্ডিতে ক্যাপ্টেন বাশারের খালাম্মা বিশিষ্ট নারী মুক্তি আন্দোলন নেত্রী বেগম আয়শা জাফরের বাশায় অন্তরীণ ছিলেন তার ওপরও নেমে আসে ভয়াবহ অত্যাচার। ক্যাপ্টেন বাশারের স্ত্রী নূরুন্নাহার বাশার সে সময় সন্তানসম্ভবা থাকার পরেও তাকে কোনো হাসপাতালে ভর্তি হতে দেওয়া হয়নি। তার বাইরে যাওয়ার ওপর সামরিক জান্তা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এমনকি প্রসব বেদনা ওঠার পরও তাকে কোনো হাসপাতালে ভর্তি হতে দেওয়া হয়নি। এভাবেই ক্যাপ্টেন বাশারের স্ত্রী একটি মরণোত্তর পুত্রসন্তান জন্ম দেন।

অপরদিকে দীর্ঘ দুই মাস ঢাকা সেনানিবাসের একটি টর্চার সেলে ক্যাপ্টেন বাশারের ওপর চলতে থাকে অমানবিক এবং বর্বরতম নির্যাতন। এই নির্যাতন এতই বীভৎস ছিল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিতে ইহুদিদের ওপর নিষ্ঠুরতম অত্যাচারকেও হার মানায়। শ্রুতি আছে যে শহীদ ক্যাপ্টেন বাশারের মুখমণ্ডল দখলদার সেনা কর্মকর্তারা সিগারেটের ছাইদানি হিসেবে ব্যবহার করত। যখনই যে ধূমপান করতে আসত সে শহীদ বাশারের মুখমণ্ডলে জ্বলন্ত সিগারেটটি ঠেসে ধরে নির্বাপিত করত। চলত আরও নানা ধরনের নির্যাতন। ঢাকা সেনানিবাসের বিমান বাহিনীর সদর দফতরের একটি অস্ত্র ভাণ্ডারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কক্ষকে টর্চার সেলে রূপান্তরিত করা হয়। প্রতিটি কক্ষে ৫-৬ জন করে যুদ্ধবন্দীকে রাখা হতো। সেখানে ছিল না কোনো বিদ্যুৎ, আলো, বাতাস প্রবেশের কোনো ভেনটিলেশন। এ রকম একটি টর্চার সেলে ক্যাপ্টেন বাশারকে রাখা হয় এবং শতাব্দীর নিষ্ঠুরতম নির্যাতন চালিয়ে তিল তিল করে খুন করা হয়। পার্শ্ববর্তী টর্চার সেলগুলোতে বাঙালি যুদ্ধবন্দীরা প্রতিদিনই ক্যাপ্টেন বাশারের আর্তনাদ শুনতে পেতেন। ইতিহাসের বর্বরতম ও নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডে খোদার আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিপীড়নের বীভৎসতা এদেশের জনগণ কখনই ভুলবে না। এসব টর্চার সেলে পাকিস্তানি হানাদাররা যে অত্যাচার চালিয়েছিল তা কখনই ভোলার নয়। এই টর্চার সেলগুলো আজও দাঁড়িয়ে আছে যা পাকিস্তান বাহিনীর নির্মম বর্বরতার প্রতীক যা আমাদের কখনই ভুলে গেলে চলবে না।

 

শহীদ বাশারের পরিবারের আকুতি সরকার তথা সেনা কর্তৃপক্ষ যেন এসব টর্চার সেল যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেন যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এগুলো দেখতে পারেন। জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য এসব বন্দীশালা ও টর্চার সেল উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক যাতে জনগণ অন্তত অনুভব করতে পারেন দেশের স্বাধীনতার অর্জনের জন্য এখানে কত গভীরভাবে মানবতা পদদলিত হয়েছিল। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এসব বন্দীশালা ও টর্চার সেলগুলো দেখে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের কষ্ট ও ত্যাগ কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারবেন।

লেখক :  শহীদ ক্যাপ্টেন বাশারের ছোট ভাই ও ডেইলি সান-এর  সিনিয়র সাব-এডিটর।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর