রমজান মাস একটি মহিমান্বিত, রহমত, বরকত, মাগফেরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস। চরিত্র গঠন করার মাস। জীবনের চাকা পরিবর্তনের মাস। পবিত্র কোরআন অবতরণের মাস। এ মাসটি বছরে একবার আসে। এ মাসকে যে যত বেশি সম্মান করবে মহান রব্বুল আলামিন তার মর্যাদা তত বাড়িয়ে দেবেন। মাসটি যেহেতু কোরআন অবতরণের মাস, তাই দিনে রোজা রাতে খতবে তারাবি আদায় করার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক খতম কোরআন তেলাওয়াত করার সংকল্প করতে হবে। অনেক ভাইকে দেখা যায় তারা কাজ কারবার করে ঠিক কিন্তু একটু সময় পেলেই কোরআন তেলাওয়াতে বসে যায়। আমি বহু লোককে দেখেছি তারা গাড়িতে বসে বসে কোরআন তেলাওয়াত করতে থাকেন। অহেতুক সময় নষ্ট করে না। কোরআন তেলাওয়াত দ্বারা বান্দার সম্পর্ক আল্লাহর সঙ্গে গভীর থেকে গভীর হয়। আর যে বান্দার সম্পর্ক আল্লাহর সঙ্গে গভীর থেকে গভীর হবে, আল্লাহপাক তার জীবনের গুনাহগুলো ক্ষমা করে নিজের প্রিয় বান্দাদের তালিকায় তাকে স্থান দেবেন। ‘রমজান’ শব্দের অর্থ বুঝলেই রমজান মাসের গুরুত্ব ও ফজিলত খুব সহজে বুঝে আসবে। আরবি ভাষায় ‘রমজান’ শব্দের অর্থ জ্বালিয়ে দেওয়া, ভস্ম করে দেওয়া। উলামায়ে কেরামগণ লিখেছেন রমজানকে রমজান এ জন্য বলা হয় যে, এ মাসে মহান রাব্বুল আলামিন স্বীয় বান্দাদের পাপ ও গুনাহ একেবারে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেন। এ মহান উদ্দেশ্যেই রমজানকে রমজান বলা হয়ে থাকে। কারণ বাকি এগারোটি মাস দুনিয়াবি কাজ-কারবার করতে গিয়ে বান্দার অন্তরকে অনেক সময় পাপ কার্য আচ্ছন্ন করে ফেলে। পাপ কার্য কীভাবে মানব আত্মাকে গ্রাস করে তার কিছুটা নমুনা হাদিসে রয়েছে। মিশকাত শরিফের ৫১৪৭নং হাদিস— হজরত হোজাইফাতুল ইয়ামান রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, মানুষের অন্তরে ফিতনাসমূহ এমনভাবে প্রবেশ করে যেমন-আঁশ একটির পর আরেকটি বিছানো হয়ে থাকে এবং যে অন্তরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা প্রবেশ করে তাতে একটি কালো দাগ পড়ে। আর যে অন্তর তাকে স্থান না দেয় তাতে একটি সাদা দাগ পড়ে। ফলে মানুষের অন্তরসমূহ পৃথক পৃথক দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক প্রকার অন্তর হয় মর্মর পাথরের মতো শ্বেত, যাকে আসমান ও জমিন বহাল থাকা পর্যন্ত অর্থাৎ কেয়ামত পর্যন্ত কোনো ফিতনাই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় প্রকার অন্তর হয় কয়লার মতো কালো। যেমন— উপুড় হওয়া পাত্রের ন্যায়, যাতে কিছুই প্রবেশ করার ক্ষমতা থাকে না। সে ভালোকে ভালো জানার ও মন্দকে মন্দ জানার ক্ষমতা রাখে না। ফলে কেবল সে তা গ্রহণ করে যা তার প্রবৃত্তির চাহিদা হয়। মূলত পাপ বা গুনাহ একটি ময়লা বা কালো দাগসদৃশ। কাপড়ে ময়লা লাগলে তা যদি সঙ্গে সঙ্গে উঠানো না হয় পরে আরও ময়লাযুক্ত হয়ে কাপড়টি ব্যবহার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। অনুরূপ মানুষ পাপ কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে একটি কালো দাগ পড়ে। তওবা করার সঙ্গে সঙ্গে দিল থেকে গুনাহের দাগটি উঠে যায়। মাহে রমজান এ কথাটিই শিক্ষা দেয়। বান্দা তুমি সারা বছর যে অপরাধ করেছ, যদি অপরাধের সঙ্গে সঙ্গে তওবা না করে থাক, তওবা কবুলের মাস মাহে রমজান। এখনই সময় তওবা করে নিজের পাপগুলো সম্পূর্ণ ক্ষমা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির ফায়সালা করে নাও। আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত বান্দা হিসেবে নিজের নাম লিখিয়ে নাও। মাহে রমজান সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা পরহেজগারী অর্জন করতে পার। (সূরা বাকারা : ১৮৩)। আলোচ্য আয়াতে মাহে রমজানের প্রয়োজনীয়তা, তাত্পর্য ও গুরুত্ব সংক্ষিপ্তভাবে আল্লাহপাক তুলে ধরেছেন। রমজানের রোজা পালন দ্বারা মানুষ মুত্তাকি হয়। মানুষকে মুত্তাকি বানানোই মূলত রোজার আসল উদ্দেশ্য। সারা বছরের পাপ ক্ষমা করানো এবং গাফিলতির পর্দা দিল থেকে দূর করে সেখানে আল্লাহর ভয় বা তাকওয়া সৃষ্টি করানো। তাই পবিত্র রমজানে শুধু রোজা রাখা ও তারাবি নামাজ পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং মাসজুড়ে পুরো সময় ইবাদতে কাটানোর চেষ্টা করা। বান্দা চেষ্টা করলে আল্লাহপাক তৌফিক দান করেন। প্রিয় পাঠক! আল্লাহতায়ালা খুব ভালোভাবেই জানেন যে তার সৃষ্টি মানুষ যদিও তাদের আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা বানানো হয়েছে। এক সময় এ মর্যাদার কথা তাদের মনে থাকবে না। তারা নিচে নামতে নামতে তাদের সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্য পর্যন্ত ভুলে যাবে। তখন তাদের জন্য প্রয়োজন কালিমায়ে তইয়্যেবার। আবার অনেক মানুষ এমনও হবে যারা দুনিয়ার কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়বে এবং ধীরে ধীরে তার অন্তরে গাফিলতির পর্দা পড়তে থাকবে এবং দুনিয়ার কাজ-কারবারে লিপ্ত থাকবে। এক পর্যায়ে তারা আসল মনিবকে ভুলতে থাকবে। তখন মানুষের এ নাজুক অবস্থা দূর করার জন্য প্রয়োজন কিছু সময়, দিন ও মাসের। সেই নাজুক অবস্থা দূর করার মাস হলো পবিত্র মাহে রমজান। মাহে রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত অতি মূল্যবান। রমজানের একটি মুহূর্তও যাতে হাসি তামাশায় নষ্ট না হয় সেদিকে আমাদের এখন থেকেই খেয়াল রাখতে হবে। দিনে রোজা রাতে ইবাদত এভাবেই রমজান মাস কাটাতে হবে। আমাদের কিছু মুসলিম বন্ধু আছেন যাদের অন্তরে শয়তান এমনভাবে জায়গা করে নিয়েছে তাদের মরার বা জাহান্নামে আজাবের সামান্যতম ভয় পর্যন্ত নেই। তারা রমজানে রোজা তো রাখেই না বরং রমজানের সামান্যতম মর্যাদা পর্যন্ত করে না। প্রকাশ্যে দিবালোকে পানাহার করে বেড়াচ্ছে। তাকে রোজার কথা বললে উত্তরে বলে আমার পেট খারাপ বা পেটে গ্যাস হয় ইত্যাদি অহেতুক কারণ দেখায়, যার কোনোই ভিত্তি নেই। কিন্তু এ লোকের শরীর বা অবস্থা দেখলে মনে হয় না যে সে কোনো রোগে আক্রান্ত। বাস্তবিকভাবে অসুস্থ হলেও তো এভাবে প্রকাশ্যে দিবালোকে পানাহার শরিয়তে নিষেধ করা হয়েছে। প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোনেরা! মনে রাখতে হবে আমি আপনি মুসলিম। মুসলমানের ঘরে আমাদের জন্ম। পিতা-মাতা বরকতের জন্য ইসলামী নাম রেখেছেন। তাই আমাদের জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে ইসলামী নাম রাখার স্বার্থকতা বজায় রাখতে হবে। পিতামাতা যে সুন্দর নাম রেখেছেন তার মর্যাদা রাখতে হবে। মানব জাতির সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য স্মরণ রাখতে হবে। পবিত্র মাহে রমজান মানব সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্যের দিকে ফিরে আসার মাস। আগত মাহে রমজানকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করার আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব বারিধারা, ঢাকা।