সোমবার, ১২ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

অর্থলোভ ও চক্রান্ত কি বিএনপিকে বিনাশ করবে?

কাজী সিরাজ

অর্থলোভ ও চক্রান্ত কি বিএনপিকে বিনাশ করবে?

বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কর্নেল (অব.) এম আনোয়ারুল আজিম পদত্যাগ করেছেন। গত ৮ জুন সাংবাদিক সম্মেলন করে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তার পদত্যাগের খবরে আমি মোটেও বিস্মিত হইনি। বিস্মিত হব না তার মতো আরও কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতা যদি দলের সঙ্গে দীর্ঘদিনের দুঃখ-সুখের সব সম্পর্ক চুকিয়ে বুকিয়ে ফেলেন। তবে আত্মমর্যাদা ও অতীত রাজনৈতিক গৌরব বিসর্জন দিয়েও ‘কদমবুচির’ রাজনীতি করার কিছু লোক যে থাকবে না তা নয়। আছে তো! রাজনীতিতে, ত্যাগ-তিতিক্ষায় পরীক্ষিত কিছু কেরিয়ার রাজনীতিবিদের ঘাড় ধরে মাথাটা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার পর, এমনকি রাজনীতিতে পায়ের কাছে ঠাঁই পাওয়ারও অনুপযুক্তদের পায়ের নিচে তাদের সাংগঠনিক অবস্থান নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও যারা অপমানবোধ না করে পদলেহন করছেন, তেমন কিছু পরিচিত লোক এখনো পাওয়া যায়। কী ‘মধুর’ আশায় যেন লাথি-গুঁতো খেয়ে হলেও তারা দলে থাকতে চান, ঢুকতে চান। কিছুদিন আগে দলটির নীতিনির্ধারণী কমিটি ও কেন্দ্রীয় কমিটি করার পর তা লক্ষ্য করা গেছে। কয়েকজন অপদস্থ রাজনীতিবিদ আছেন, তাদের অপমানে ভক্ত-অনুসারী অনেকে দল ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু ‘ওনারা’ এখনো ‘মুলোর’ পিছে ছুটছেন। এরা এমপি ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন, সচ্ছলতাও অর্জন করেছেন; তারপরও আরও চাই, আরও কি জানি চাই। ভোগবাদী চিন্তার কাছে মান-সম্মানের দাম তো কমই হবে! আনোয়ারুল আজিমরা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এর আগে আরও দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা আছে। বিএনপির একজন সম্মানিত ও গ্রহণযোগ্য নেতা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী। তাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী নেতা ভাবা হতো বিএনপির। আদতে ছিলেনও পার্টি চেয়ারপারসনের খুব কাছের লোক। দলের জন্য তার সৎ ও আন্তরিক ভূমিকাই তাকে দলের ও দেশের রাজনীতিতে উজ্জ্বল করেছে। দলের ভুলের তিনি সমালোচক ছিলেন, দল সুপথে চলে লক্ষ্য অর্জন করুক তা চেয়েছিলেন। রাজনীতিতে লুটেরা সংস্কৃতি ও দুর্বৃত্তায়নের বিরোধিতা করতেন; শিক্ষিত, মার্জিত ও মেধাবীদের হঠিয়ে পেশিবাজির রাজনীতি পছন্দ করতেন না। তার আচরণ ও ভূমিকা ‘দল-মালিকদের’ পছন্দ হয়নি। দুঃখে এবং ক্ষোভে তিনিও দল ছেড়েছেন বেশ আগে। কেন দল ছেড়েছেন প্রকাশ্যেই বলেছেন। অতি সম্প্রতি দলের কমিটি ঘোষণার পর ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে মিডিয়ায় জানিয়ে পদত্যাগ করেছেন দলের দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রাম, উত্থান-পতনের প্রায় সব ঘটনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং পার্টি চেয়ারপারসনের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সহচর মোসাদ্দেক আলী ফালু। তিনি দলত্যাগ করেছেন কিনা তা স্পষ্ট না করলেও তার পদত্যাগের ঘটনাটি রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি ঘটনা। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করলেও বিএনপিকে এবং বিএনপির সঙ্গে মোসাদ্দেক আলী ফালুর সম্পর্ক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণকারীদের অভিমত, দারুণ মনোকষ্ট ও ক্ষোভে তিনি ভাইস চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দিয়েছেন। তার কী প্রত্যাশা ছিল জানি না, তবে তার অপমান বোধ করার মতো ঘটনা ঘটেছে কমিটি গঠনে। মোসাদ্দেক আলী ফালু যখন প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বেগম খালেদা জিয়ার পিএসের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখন কক্সবাজারের সালাহউদ্দিন আহমদ ছিলেন এপিএস। এপিএস মূলত পিএসের তত্ত্বাবধানেই কাজ করেন। প্রধানমন্ত্রীর পিএস আর এপিএসের দায়িত্ব ও ক্ষমতার ফারাক এখন অনেকেই বোঝেন। প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীর দীর্ঘদিনের পিএস হিসেবেই শুধু নয়, দলের একজন নিষ্ঠাবান ‘কর্মী’ হিসেবেও তিনি দলের অনেক ‘নেতার’ চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাকে বলা হতো দলের সব স্তরের নেতা-কর্মী এমনকি সমর্থকদের সঙ্গে পার্টি চেয়ারপারসনের যোগাযোগের ‘সেতুবন্ধন’। এখন প্রায়ই বেগম খালেদা জিয়াকে দলের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীদের থেকে বিছিন্ন করে রাখার নানা অভিযোগ শোনা যায়। মোসাদ্দেক আলী ফালুর সময় তেমন কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি। সে ক্ষেত্রে সালাহউদ্দিন আহমদকে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য করে তাকে ভাইস-চেয়ারম্যান করার অর্থ তো দাঁড়ায় ওসি-কে কনস্টেবল বানিয়ে অধীনস্থকে ওসি বানিয়ে দেওয়া। কোনো কোনো প্রবীণ নেতা এমন অপমানজনক অবনতি হজম করে নিলেও ফালু সাহেব তা পারেননি বলেই পর্যবেক্ষণকারীদের ধারণা। এ ধরনের পদত্যাগ ও দল ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা প্রকৃত রাজনীতিবিদদের মর্যাদা বাড়ায়। সাহসী হতে প্রেরণা জোগায়।

আবার আনোয়ারুল আজিম প্রসঙ্গেই ফিরে আসি। পদত্যাগ ঘোষণাকালে সংবাদ সম্মেলনে তিনি তার এ সিদ্ধান্তের পেছনে যে কারণ বর্ণনা করেছেন তা প্রণিধানযোগ্য বিধায় উল্লেখ করতে চাই। তিনি বলেছেন, ‘দলীয় গঠনতন্ত্রের বাইরে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতামত না নিয়ে কোনো সম্মেলন ছাড়াই রাতের আঁধারে লাকসাম উপজেলা, পৌরসভা ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা যুবদল, ছাত্রদলের পকেট কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে (এটি তার নির্বাচনী এলাকা। একাধিকবার তিনি এমপি হয়েছেন এ আসন থেকেই)। আমি বিষয়গুলো বিএনপির হাইকমান্ডকে বারবার জানিয়েছি। ম্যাডামের সঙ্গে দুবার দেখা করেছি। কিন্তু তিনি কোনো সদুত্তর দেননি। যার দল করি, তার যদি ইনসাফ না থাকে সেই দল করে লাভ কী? এসব পকেট কমিটি করার পর থেকেই আমি দলের তৃণমূল ও ত্যাগী নেতা-কর্মীদের কাছে বারবার প্রশ্নের মুখে পড়েছি। কিন্তু কোনো উত্তর দিতে পারছি না। ১৮ বছর পর প্রতিবাদস্বরূপ দল ছাড়লাম’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৯ জুন ২০১৭)। কোন পদ্ধতিতে, কাকে বশ করে কে বা কারা ঢাকা থেকে এভাবে পকেট কমিটি করিয়ে নেয় তার একটা অকাট্য প্রমাণও তিনি দিয়েছেন। কর্নেল (অব.) আজিমের দলত্যাগে কেন বিস্মিত হইনি বা আরও কেউ একই পথ অনুসরণ করলে কেন বিস্মিত হব না তার একটা ব্যাখ্যা আজিম সাহেবের বক্তব্যে অনেকটাই পরিষ্কার হয়েছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এমন যে অবস্থা সারা দেশেই বিরাজ করছে তা জানা বা জানানোর পরও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের নাম নেই। ফলে ফ্রিস্টাইলে এ ধরনের গণতন্ত্র, গঠনতন্ত্র ও সংগঠনবিরোধী কাজ চলছে নিয়মিত। সর্বত্র একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, বিভিন্ন কমিটি ও পদ বাণিজ্যের পাইকাররা দলের খুব সুউচ্চ মহলের ঘনিষ্ঠ বলেই বিনাবাধায় দলের স্বার্থবিরোধী এসব কাজ করেও থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। দলত্যাগী বা পদত্যাগী যে কজনের নাম উল্লেখ করলাম এর বাইরেও আরও অনেককে অকারণে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে দল থেকে হয় বের করে দেওয়া হয়েছে অথবা কাউকে বাধ্য হয়ে চলে যেতে হয়েছে। বিএনপির অনেক তারকা পুরুষ অপমানিত হয়ে দল ও পদত্যাগ করার পরও কারও হুঁশ নেই। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপির প্রথম মহাসচিব। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের তিনি কত ঘনিষ্ঠ ছিলেন তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। তিনি দলের পছন্দেই দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। কী ন্যক্কারজনকভাবে তাকে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তা সবারই জানা। তারপর নতুন দল ‘বিকল্প ধারা’ গড়তে গিয়ে তিনি কীভাবে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন তা-ও সবার জানা। বি. চৌধুরীদের মতো লোক একটি দলের অলঙ্কার শুধু নন, অহংকার। এ ধরনের ব্যক্তিদের পেয়ে যে কোনো দল ধন্য হয়। বিএনপি গঠন প্রক্রিয়ায় অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালনকারী একজন সৎ, শিক্ষিত, সমাদৃত, দক্ষ নেতাকে বের করে দিয়েও নাকি অনেকে অট্টহাসি হেসেছে ক্ষমতার দর্প দেখিয়ে। কর্নেল (অব.) অলি ছিলেন জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের নিত্যসঙ্গী। সর্বদা ছায়ার মতো ছিলেন তাকে কেন্দ্র করে। বিএনপি গঠনে যাদের নেপথ্য ভূমিকা ইতিহাসের অন্তর্গত, তিনি তাদের একজন। তিনি শহীদ জিয়ার আমলেই সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে যোগ দেন এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বেগম খালেদা জিয়ার আমলেও একাধিকবার এমপি হন, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীও ছিলেন। পরে তার একটি আসনে বেগম জিয়া জামায়াত প্রার্থীকে জোট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে দলনেত্রীর সঙ্গে তার চরম বিরোধ বাধে এবং তিনি দল ত্যাগে বাধ্য হন তার একটি আসন জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়ায়। সেই আসনে এমপি হয়ে তিনি দ্বিতীয় আসন হিসেবে তা ছেড়ে দিলে উপ-নির্বাচনে তার স্ত্রী এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাজনীতি বিক্রির মতো অন্যায়ের প্রতিবাদ করে তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন। যে জামায়াতের সঙ্গে বিরোধের কারণে দল ছেড়ে দিয়েছিলেন কর্নেল (অব.) অলি, এখন অবশ্য সেই জামায়াতের নেতাদের তার দলীয় ইফতার মাহফিলে তার পাশে হেড টেবিলেই বসাতে দেখা যায়! অবাক না হয়ে পারা যায় না। মেজর জেনারেল (অব.) তালুকদার, আলমগীর কবির, অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম, রেদোয়ান আহম্মদ, মনি স্বপন দেওয়ানসহ অনেকেই দল ছেড়েছেন ভুল রাজনীতি, অবমূল্যায়ন এবং রাজনীতিকে নষ্ট করার প্রতিবাদে। আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ছিলেন দলের দুঃসময়ের কাণ্ডারি। প্রায় একযুগ সাফল্য ও সুনামের সঙ্গে তিনি মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। দলের উপরতলা-নিচতলার অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির এত অভিযোগ থাকার পরও ওয়ান-ইলেভেন সরকার তন্নতন্ন করে খুঁজেও মান্নান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ পায়নি। তাকে কারাবাস করতে হয়েছে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত একটি দুর্নীতির মামলায় পারচেজ কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে। মন্ত্রিসভা পারচেজ কমিটির সদস্য হিসেবে একই মামলায় কারারুদ্ধ করা হয় সাইফুর রহমান, খোন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, মতিউর রহমান নিজামী প্রমুখকেও। কথিত আছে, বিএনপির একটি উঁচু মহলের চাপেই মান্নান ভুঁইয়াকে গ্রেফতার করা হয়। ২০০৭ সালে বিপথগামিতা থেকে দলকে সঠিক পথে আনার জন্য নেতৃত্বে পারিবারিক ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা বাতিল, সরকার ও দলকে পৃথকীকরণ, দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি পরিহার, দল ক্ষমতায় গেলে প্রশাসনে নোংরা দলবাজি বন্ধ, দলীয় গঠনতন্ত্রের সাত দফা অনুযায়ী খারাপ ও দুর্নীতিবাজদের বিতারণসহ বেশ কিছু সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন পরবর্তী জাতীয় কাউন্সিলে উত্থাপনের জন্য। কিন্তু তাকে ভুল বোঝা হয়। মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও দলের দুর্নীতিপরায়ণরা তার বিরুদ্ধে একজোট হয়ে তাকে দল থেকে বহিষ্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং কোনো প্রকার কারণ দর্শানোর নোটিস ছাড়াই পার্টি চেয়ারপারসনের কলমের এক খোঁচায় দল থেকে তাকে বহিষ্কার করে দেওয়া হয়। তার অনুসারী শতাধিক সাবেক এমপি ও বিভিন্ন স্তরের অসংখ্য নেতা-কর্মীর কপালে জোটে সীমাহীন লাঞ্ছনা-গঞ্জনা। যারা দল ছেড়েছেন বা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন বা যাদের ন্যক্কারজনকভাবে দল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে সর্বদিকে তাদের মতো উজ্জ্বল নেতা-কর্মী বিএনপিতে এখন কষ্ট করে খুঁজে বের করতে হয়। এসব ক্যারিয়ার রাজনীতিবিদকে হারিয়ে দলটি এখন বিবর্ণ। এখনো যে কজন প্রবীণ নেতা দলের বিভিন্ন স্তরে আছেন তাদের রাখা হয়েছে অলঙ্কার হিসেবে। দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের কার্যত কোনো ভূমিকাই নেই বলে শোনা যায়। অনেকে তাদের বলেন, ‘নেতায়ে-খামাখা’। অনেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অবস্থান নিয়েও সমালোচনা করেন। বলেন ‘বিবৃতি সচিব’ বিবৃতি দেওয়াই যেন তার কাজ। মহাসচিব দলের (যে কোনো দলের) নির্বাহী প্রধান। কিন্তু নির্বাহী প্রধানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মূল ভূমিকা পালন করেন একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও একজন যুগ্ম-মহাসচিব। তারা কাজ করেন ‘দল-মালিকদের’ স্টাফ অফিসারের ‘ক্ষমতা’ নিয়ে। বিভিন্ন জায়গায় কমিটি গঠন, পদ-পদবি বণ্টনের কাগজে মহাসচিবের সই থাকলেও ওই সই করা পর্যন্তই নাকি তার ক্ষমতা। ফলে চলছে ব্যাপক অরাজকতা। ক্লিন ইমেজের একজন ক্যারিয়ার রাজনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও বাইরে তার যে সম্মান ও স্বীকৃতি আছে দলে তা আছে বলে মনে করেন না দলটির কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণকারীরা।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের সর্বস্তরে একটা প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচনের পক্ষে অনুকূল অবস্থান সাধারণ মানুষের মধ্যে আশা জাগালেও জনগণের এ মনোভাবকে ক্যাশ করার কোনো সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না বিএনপিকে। ৫১টি সাংগঠনিক কমিটি করে সারাদেশ সফরের মাধ্যমে দল গোছানো, নির্বাচনের জন্য দলকে প্রস্তুত করা এবং সহায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করার ঘোষণা এখন ‘গল্পই’ হয়ে রইল। ১০টি জেলায়ও সফর করা হয়নি এখনো। যে কটিতে সফর করেছেন কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্তরা, দুই/একটি ছাড়া বাকি সবকটিতেই গোলযোগের খবর পাওয়া গেছে। কোন্দলে জর্জরিত দলটি। সব জেলা ও থানার ঢাকাইয়া কমিটির বিরুদ্ধে মাঠের লড়াকুদের দারুণ ক্ষোভ। দলে নিঃস্বার্থ, সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীর, এখনো ‘আকাল’ পড়েনি দলটিতে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের কোনো মূল্যায়ন হয় না বলে অভিযোগ শোনা যায়। ভুলভ্রান্তি ও দুর্নাম কাটিয়ে একটি দলকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে প্রয়োজন সব বৈরিতা, দ্বন্দ্ব পরিহার করে দলকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত করা, শক্তি আহরণ করা, শিক্ষিত, মেধাবী ও যোগ্যদের মূল্যায়ন করা, আবর্জনা সব সাফসুফা করে ফেলা। ১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করে প্রথমেই দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জর্জরিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নেন এবং চার খণ্ডে খণ্ডিত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তার নেতৃত্বাধীন অংশ (যে অংশের নেতা ছিলেন আবদুল মালেক উকিল), মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন অংশ, দেওয়ান ফরিদ গাজীর নেতৃত্বাধীন অংশ এবং আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন বাকশাল একীভূত হয়ে যায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন এক আওয়ামী লীগে। অভূতপূর্ব সাফল্যও অর্জন করেন তিনি। ক্ষমতায় ফিরে আসতে একুশ বছর সময় লেগেছে। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ ও দুরন্ত গতির এক শক্তিশালী ‘সংগঠন ইমারত’ তিনি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। সে ফল এখন ভোগ করছেন। বঙ্গবন্ধুর আমলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল সাড়ে তিন বছরের মতো আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশ শাসন করছে সাড়ে তের বছর। এ শিক্ষাটা বিএনপি গ্রহণ করছে না। ধুরন্ধর, স্বার্থবাজরা দলের ভিতর দ্বন্দ্ব ও বিরোধ উসকে দিচ্ছে, দলকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করার পরিবর্তে বিভক্ত ও দুর্বল করছে। একে একে দলের তারকা পুরুষরা দল ছাড়ছেন বা কাউকে দল ছাড়তে বাধ্য করছে দলে অনুপ্রবেশকারী ‘বসন্তের কোকিলরা’। এতে দলের লাভ-ক্ষতি বোঝার বোধশক্তিও যেন দলটিতে লোপ পেয়েছে। আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য কর্নেল (অব.) আনোয়ারুল আজিমদের মতো উপযুক্ত ও শক্তিশালী প্রার্থীরা দলের সাংগঠনিক কাঠামোর বাইরে চলে গেলে বা বাইরে থেকে গেলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাস্ত করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন কি পূরণ হবে? দলীয়ভাবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য নির্বাচনী লড়াইয়ে লড়বে কারা? ঢাকা থেকে উড়ে গিয়ে জুড়ে বসা ‘নমিনেশন ক্রেতারা’? কিছু লোকের অর্থলোভ ও চক্রান্তের কাছে কি বিএনপির সব সম্ভাবনা বিনাশ হবে? লোভ ও চক্রান্ত কিন্তু সর্বদাই সর্বনাশা।

     লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর