সোমবার, ৩ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

মধ্যপ্রাচ্যে কলকাঠি নাড়ছে ইসরায়েল

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

মধ্যপ্রাচ্যে কলকাঠি নাড়ছে ইসরায়েল

ইসরায়েলের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনের একটা উদ্ধৃতির মাধ্যমে আজকের লেখাটির শুরু করতে চাই। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের পৌরোহিত্যে ১৯৯৩ সালে ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে অসলো শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর রবিন বলেছিলেন— ‘To everything there is a season and a time to every purpose under heaven. A time to be born and a time to die, a time to kill and a time to heal... a time of war and a time of peace. The time for peace has come.’ (সূত্র : বিল ক্লিনটন, মাই লাইফ, পৃ-৫৪৪)। রবিনের এই বক্তব্যকে বিল ক্লিনটন অভূতপূর্ব এবং অসামান্য বক্তব্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তখনকার পরিস্থিতি মূল্যায়নে রবিন হয়তো ভেবেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্বের শান্তির জন্য এক নম্বর হুমকি হিসেবে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংকট সমাধানের এটাই বোধ হয় উপযুক্ত সময়। বিল ক্লিনটন তখন বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে সবেমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় এসেছেন। ধরেই নেওয়া হয়েছিল তিনি দুই মেয়াদে ২০০০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন এবং তার ক্যারিশমা, জনপ্রিয়তা ও মধ্যপন্থা নীতির ওপর ভর করে দুই পক্ষ একটা চূড়ান্ত মীমাংসায় পৌঁছতে পারবে। তখন সবপক্ষ মোটামুটি একমত হয়েছিল, ইসরায়েলের পাশাপাশি প্যালেস্টাইনও একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র হবে এবং তাতে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগে ইসরায়েলের যে সীমানা ছিল, সেটাই হবে দুই রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সীমান্ত। কিন্তু অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের দুই বছরের মাথায় এক ইহুদি চরমপন্থির গুলিতে রবিন নিহত হওয়ায় সবকিছু উল্টে যায়। এরপর ইহুদিবাদী প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারনের দুই মেয়াদ (২০০১-২০০৬) ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর আগের এক মেয়াদ (১৯৯৬-১৯৯৯) এবং বর্তমানে ২০০৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত একনাগাড়ে তিন মেয়াদে পশ্চিমতীরে ব্যাপক হারে নতুন নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন করে চলেছেন। যাতে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ব সীমানা নয়, বরং সম্পূর্ণ জেরুজালেমসহ পশ্চিমতীরের আরও অতিরিক্ত জায়গা দখল করে তারপর এমন একটা প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রকে ফিলিস্তিনিদের মেনে নিতে বাধ্য করা, যা হবে হাত-পা ভাঙা বিকলাঙ্গ, নীরব, নিথর, অকার্যকর ও ভঙ্গুর একটা রাষ্ট্র। যাতে আগামীতে প্যালেস্টাইনের জনগণ তাদের প্রতি চরম অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়ার সক্ষমতা কোনো দিন আর অর্জন করতে না পারে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই পরোক্ষভাবে নানা অজুহাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ইসরায়েল এটাই বোঝাতে চাচ্ছে যে, নিজেদের রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রকে মেনে নেবে না। কিন্তু ২০০৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার যথার্থ সাড়া না পাওয়ার কারণে জেরুজালেমে রাজধানী স্থানান্তর করা সম্ভব হয়নি এবং পশ্চিমতীরে আরও অতিরিক্ত জায়গা দখল করে পরিকল্পনা মাফিক ইসরায়েলের চূড়ান্ত সীমানা ঘোষণা করতেও পারেনি। ফলে শেষের দিকে বারাক ওবামার সঙ্গে নেতানিয়াহুর সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইসরায়েল ও ইহুদিবাদের প্রতি প্রকাশ্য পক্ষপাতিত্বমূলক অবস্থান এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি বার্তা ইত্যাদি এবং তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু কর্তৃক পশ্চিমতীরে আরও নতুন বসতি স্থাপনের যুদ্ধংদেহী ঘোষণা দেখে মনে হয়, বর্তমান সময়টাকেই ইসরায়েল হয়তো তাদের চরম লক্ষ্য বাস্তবায়নের উপযুক্ত মনে করছে। আইজ্যাক রবিনের বক্তব্যের সঙ্গে আজকের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর দৃষ্টিভঙ্গির শব্দগত কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু দুইয়ের ফল ও পরিণতির মধ্যে বিশাল আকাশসম পার্থক্য বিদ্যমান। রবিন তখন দুই রাষ্ট্রকেই সম-মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার উপযুক্ত সময় বলে মনে করেছিলেন আর এখন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনের অবাধ সমর্থন ও অস্ত্রের জোরে প্যালেস্টাইনকে একটি বিকলাঙ্গ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য বর্তমানকেই নেতানিয়াহু উপযুক্ত সময় মনে করছেন। নেতৃত্ব ও সময়ের ব্যবধানে একই বক্তব্যের ফল ও পরিণতির মধ্যে কত বড় পার্থক্য হতে পারে, সেটা দেখাবার জন্যই লেখার শুরুতে রবিনের ওই বক্তব্যটা উল্লেখ করেছি। সুতরাং ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার মধ্য দিয়ে সৃষ্ট সুযোগ ও সময়কে ইসরায়েলের স্বার্থ উদ্ধারের ক্ষেত্র প্রস্তুতার্থে যুক্তরাষ্ট্রের কূট-কৌশলের আওতায় হিজবুল্লাহ ও হামাসকে ক্ষমতাহীন ও নিষ্ক্রিয় করার উদ্দেশ্যেই কি কাতারকে একঘরে ঘোষণা করা হয়েছে কিনা সেটাই এখন বিচার-বিশ্লেষণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কারণ কাতার সৌদি আরবের সঙ্গে গালফ সহযোগিতা কাউন্সিলের সদস্য হলেও বরাবরই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে ইরান এবং শক্তিশালী যুদ্ধবাজ দুই সংগঠন লেবাননের হিজবুল্লাহ ও প্যালেস্টাইনের হামাসের সঙ্গে, যারা সব সময় ইসরায়েলের সব দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থেকেছে এবং প্রয়োজনে যুদ্ধে নেমেছে। একই সঙ্গে তারা ইরান ও সিরিয়ার আসাদের সহযোগী। তারপর সৌদি আরব, মিসরসহ অন্যান্য কয়েকটি রাষ্ট্র যে অভিযোগ তুলে কাতারকে বয়কট এবং অবরোধ আরোপ করেছে, তার মধ্যে যতটুকু সত্য আছে তা থেকে অনেক বেশি অসত্য আছে। আইএস, আল-কায়েদা ও এদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উগ্র ওয়াহাবি তন্ত্রের সালাফিবাদে বিশ্বাসী বিশ্বব্যাপী জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে কাতারের জড়িত থাকার অকাট্য কোনো প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে হিজবুল্লাহ, হামাস ও ব্রাদারহুডের প্রতি কাতারের সমর্থন বহু আগে থেকে আছে। এর মধ্যে হিজবুল্লাহ ও হামাস ইসরায়েল ও ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে সব সময়ই কঠোর যুদ্ধংদেহী অবস্থান বজায় রেখেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আইএস,

আল-কায়েদা অথবা তত্সংলগ্ন জঙ্গিদের সঙ্গে এই দুই সংগঠনের জড়িত থাকার কোনো অভিযোগ এ পর্যন্ত নেই। ব্রাদারহুডের বিষয়টি ভিন্ন। আইএস, আল-কায়েদা, তালেবান এবং ভারতীয় উপমহাদেশে জামায়াতের জিহাদিতন্ত্রের উৎপত্তি হয়েছে ব্রাদারহুড থেকে, যার গুরু ছিলেন ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা মিসরের হাসান বান্না ও সাঈদ কুতুব। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের পরিণতিতে একজন নিহত এবং আরেকজন ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলেছেন। তবে ক্ষমতাচ্যুত ব্রাদারহুড মিসরে শক্তিহীন হয়ে এখন দৌড়ের ওপর এবং তাদের টপ নেতৃত্বের মাথার ওপর ফাঁসির রশি ঝুলছে। ব্রাদারহুডের আরেক প্রতিভূ তুরস্কের একেপি পার্টি ও তার নেতা প্রেসিডেন্ট তায়েপ এরদোগান সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও ইউরোপ ও আমেরিকার চাপে ছদ্মবেশ খুুলে আপাতত ব্রাদারহুডের পরিপূর্ণ রূপ ধারণ করতে পারছে না। সুতরাং ব্রাদারহুড বর্তমান পরিস্থিতিতে গৌণ। তাই বোঝাই যায়, অভিযোগের মূল লক্ষ্য হলো হিজবুল্লাহ ও হামাসের ওপর থেকে সমর্থন সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে কাতারকে বাধ্য করা এবং ইরান থেকে কাতারকে আলাদা করে ফেলা। এটা হলে তাতে এক স্ট্রোকে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের উদ্দেশ্য সফল হওয়ার পথ সুগম হয়। কাতারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় সামরিক ঘাঁটি রয়েছে এবং মিয়ামিতে অবস্থিত তাদের সেন্ট্রাল কমান্ড সদর দফতরের আঞ্চলিক সদর দফতরের অবস্থানও কাতারে। সুতরাং কাতারের গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কম নয়। কিন্তু রহস্যজনক হলো, কাতারকে একঘরে করার ঘটনাকে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমে উত্ফুল্লচিত্তে সমর্থন জানিয়েছেন, আবার কাতারের আমিরকে টেলিফোন করে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন। এর পরপরই দেখা গেল আমেরিকা থেকে ১২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনতে কাতার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। কাতার যদি সত্যিকার অর্থে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং হিজবুল্লাহ ও হামাস থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তার পূর্ণ সুযোগ নেবে ইসরায়েল। আমেরিকার বর্তমান প্রশাসনের মেয়াদে আগামী চার বছরের মধ্যে ইসরায়েল তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য পূরণের পথে মূল কাজটি সেরে ফেলার চেষ্টা করবে। পশ্চিমতীরে আরও চার থেকে ছয় লাখ নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন করে ফেলবে। তাতে পশ্চিমতীরের অর্ধেকেরও বেশি এলাকা ইহুদিদের দখলে একবার চলে এলে তখন দুই রাষ্ট্রের সীমান্ত নির্ধারণের বেলায় নতুন বাস্তবতার সৃষ্টি হবে। ইসরায়েল তখন সেই বাস্তবতার পক্ষে অনড় ভূমিকা গ্রহণ করবে। এ কাজে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যে আমেরিকার নতুন প্রশাসনের পূর্ণ সহায়তা পাবেন তার ইঙ্গিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের আগেই পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সৌদি আরব সফরের জেল্লা এবং ইরানের বিরুদ্ধে তাড়িত হুঙ্কার দেখে বোঝা গিয়েছিল, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কোনো সংকট আসন্ন। সেই আশঙ্কারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সৌদি আরব, মিসরসহ কয়েকটি আরব রাষ্ট্র কর্তৃক কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা ও তার পরবর্তী ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে। এই ঘটনার জের কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা দেখার জন্য হয়তো আরও অপেক্ষা করতে হবে। সৌদি আরবের নেতৃত্বে কাতারকে বয়কটকারী দেশগুলোর পক্ষ থেকে প্রদত্ত ১৩ দফা দাবির চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সংকট সহসা মিটছে না। কারণ, ১৩ দফা মেনে নিলে কাতারের সার্বভৌমত্ব বলতে আর কিছু থাকে না। তবে উপসংহারে এ কথা বলা যায়, যা ঘটেছে তার দৃশ্য-অদৃশ্য কারণ যা-ই থাকুক না কেন, তাতে লাভবান হবে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসায়ী এবং চরমপন্থি ইহুদিবাদী ইসরায়েল। আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ এবং শেষ বিচারে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত সংঘর্ষ আরও বাড়াবে বই কমবে না।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর