বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

পর্যটন : অযুত সম্ভাবনা

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

পর্যটন : অযুত সম্ভাবনা

নানা বৈচিত্র্য ভরা আমাদের এ বাংলাদেশ। প্রকৃতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় এ দেশটিকে সাজিয়েছে। বাংলাদেশের অপার সৌন্দর্য পর্যটকদের হৃদয় স্পর্শ করে। বাংলার সংস্কৃতি সৃষ্টি, কালচার, ঐতিহ্য আর নিসর্গ প্রকৃতি নিঃসন্দেহে আকৃষ্ট করে পর্যটকদের। পর্যটনের অযুত সম্ভাবনার এ দেশের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে কত ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি। রয়েছে বহু পুরাকীর্তি স্মৃতিগাথা। অনুপম সৌন্দর্যের আধার আমাদের এ বাংলাদেশ। বিচিত্র ষড়ঋতুর নানা উৎসব মেলা পার্বণে মুখরিত ঝাউতলা হাটতলা ছোট্ট এ ব-দ্বীপ।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যুগে যুগে বহু পরিব্রাজক এবং ভ্রমণকারী মুগ্ধ হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে এ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন-সম্ভাবনা অপরিসীম। আমাদের রয়েছে সুবিশাল সমুদ্র সৈকত, পাহাড়, অরণ্যঘেরা জলপ্রপাত, প্রত্নতত্ত্বের প্রাচুর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শনসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান, যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে আমাদের এ শিল্প অনেকটা আড়ালে পড়ে রয়েছে। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে আকর্ষণীয় করার অন্যতম উপায় হতে পারে পর্যটন শিল্প। একটি দেশের সুপ্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য আর বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে পর্যটন অপরিহার্য নিয়ামক। ‘পর্যটন’ অর্থনীতির একটি বিশেষ খাত, এমন ধারণার বিকাশ ঘটে পঞ্চাশ-ষাটের দশকে। তবে আমাদের দেশে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটলেও পর্যটন শিল্পের চিত্র এখনো অনেক বিবর্ণ। পর্যটন যে আমাদের অর্থনীতির একটি বিশাল খাত হতে পারে এ ধারণার বিকাশ ঘটে মূলত পঞ্চাশের দশকে। এরপর ১৯৯৯ সালে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার পর্যটন করপোরেশনের মাধ্যমে এ শিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। যার ধারাবাহিকতায় পর্যটন বোর্ড ২০১০ সালে গঠন করা হয়।

নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের দেশকে পরিণত করেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণসমৃদ্ধ অনন্য পর্যটন গন্তব্যে, যা বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছে পর্যটকদের জন্য তীর্থস্থান হিসেবে। আমাদের দেশে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার রয়েছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন রয়েছে, রয়েছে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। শৈবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন, রামুর বৌদ্ধ মন্দির, হিমছড়ির ঝরনা, ইনানী সমুদ্র সৈকত, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, টাঙ্গুয়ার হাওর, টেকনাফ সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ পাহাড়ি অঞ্চল দেখে কেউ কেউ আত্মভোলা হয়ে যায়। আবার আমাদের দেশে অনেক ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানও রয়েছে। বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, ঢাকার লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ, খান জাহান আলীর মাজার, রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর, কুষ্টিয়ার লালন সাঁইয়ের মাজার, রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি শুধু দেশীয় নয়, বরং বিদেশি পর্যটক ও দর্শনার্থীদের কাছেও সমান জনপ্রিয় এবং সমাদৃত।

প্রায় প্রতি বছরই হাওরের ফসল অতল জলে তলিয়ে যাওয়ার দুঃসংবাদ পাই আমরা। এ বছর তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অথচ অসাধারণ প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এ অবহেলিত হাওরে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন পারে টেকসই (ঝঁংঃধরহধনষব) উন্নয়নের পথ দেখাতে। হাওরের পর্যটনের দিকে সরকার তথা পর্যটন বোর্ড, পর্যটন করপোরেশনের সুদৃষ্টি নিক্ষেপ তাদের অভূতপূর্ব পরিস্থিতি উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ভ্রমণপিপাসুদের সৌন্দর্য পিপাসা মেটাবে। ফলশ্রুতিতে তাদের অর্থনীতিকে করে তুলতে পারে গতিশীল ও টেকসই।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি। ধরা হচ্ছে ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটি। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বিপুলসংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোতে। এ ছাড়াও বিশ্ব পর্যটন সংস্থার তথ্যমতে, ২০১৮ সালের মধ্যে এ শিল্প থেকে ২৯ কোটি ৭০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ১০.৫ ভাগ। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজার ধরতে পারে তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি।

পর্যটন সক্ষমতা বা প্রতিযোগিতার (টিটিসিআই) দিক থেকে ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৮। পর্যটনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির বিকাশ ঘটিয়ে ইতিমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশ প্রমাণ করেছে ‘পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি।’ বিশ্ব পর্যটন সংস্থার হিসাব মতে, সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। তাইওয়ানের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ জাতীয় আয়ের ৬৫ শতাংশ, হংকংয়ে ৫৫ শতাংশ, ফিলিপাইনে ৫০ শতাংশ ও থাইল্যান্ডে ৩০ শতাংশ। মালদ্বীপের অর্থনীতি প্রায় পুরোটাই পর্যটন খাতের ওপর নির্ভরশীল। ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলোও মূলত পর্যটননির্ভর। মালয়েশিয়ার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৭ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। এশিয়ার সুইজারল্যান্ড নামে খ্যাত ভুটানও পর্যটনে এখন অনেক এগিয়ে। 

পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল ১০টি পর্যটন কেন্দ্রের একটি হিসেবে ভাবা হচ্ছে। এ শিল্পের যথাযথ সমৃদ্ধির জন্য যথাযথ সরকারি নীতি প্রণয়ন এবং জাতীয় বাজেটে বাস্তবসম্মত অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। পর্যটন শিল্পকে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে, কারণ বেকারত্ব বিমোচন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ব্যাপক সুযোগ এনে দিতে পারে এ শিল্প। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিওটিটিসি) ২০১৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৩ সালে বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পে ১২ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, যা বাংলাদেশের সর্বমোট কর্মসংস্থানের ১.৮ ভাগ। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ওপর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ২৭ লাখ ১৪ হাজার ৫০০টি চাকরির সৃষ্টি হয়েছে, যা সর্বমোট কর্মসংস্থানের ৩.৭ ভাগ। ডব্লিওটিটিসির মতে, এ বছরের শেষে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান দাঁড়াবে ৩৮ লাখ ৯১ হাজার, যা বাংলাদেশের সর্বমোট কর্মসংস্থানের ৪.২ ভাগ। এর ফলে বাংলাদেশের এ শিল্পে বার্ষিক কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি ২.৯ ভাগ। পর্যটন শিল্পের জিডিপিতে প্রত্যক্ষ অবদানের ভিত্তিতে ১৭৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের অবস্থান ১৪২তম। উপরের এ ছোট আলোচনা থেকে বোঝা যায়, এ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে পর্যটন শিল্প বড় নিয়ামক হতে পারে। এ জন্য যথাযথ সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ জরুরি। আমাদের দেশের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃৃতিক বৈচিত্র্যকে কাজে লাগিয়ে লাখো দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করা সম্ভব। এ শিল্পের ওপর ভিত্তি করে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।

পর্যটনে রাজধানী হিসেবে খ্যাত কক্সবাজার বিশ্বের দীর্ঘতম ৮০ কিলোমিটারের মেরিন ড্রাইভ সড়ক নতুন করে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পাশাপাশি কক্সবাজারে বেড়াতে আসা বিদেশি পর্যটকদের জন্য পৃথক ট্যুরিস্ট জোন করা হচ্ছে। সাবরাং অঞ্চলে ঊীপষঁংরাব ঞড়ঁত্রংঃ তড়হব প্রায় ১০০ একর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ২০১৮ সাল নাগাদ দেশে পর্যটকের সংখ্যা ১০ লাখে উন্নীত করার টার্গেট নেওয়া হয়েছে। এ জন্য ‘ঠরংরঃ ইধহমষধফবংয’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে। ‘নীল দিগন্ত’ নামে খ্যাত বান্দরবানের থানচির পাহাড় চূড়ায় একটি নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর পর্যটন স্থাপনা গড়ে উঠেছে। বর্ষায় মেঘের লুকোচুরি ও খেলা পর্যটকদের মায়া কাড়বে নিঃসন্দেহে।

‘দ্বীপের রানী ভোলা’ ব্র্যান্ডকে পর্যটকদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এরই অংশ হিসেবে ভোলার পর্যটন দ্বীপ কুকরী মুকরীকে নতুন রূপে সাজানো হয়েছে।

বিশ্বে দিন দিন ইকোট্যুরিজমের (ঊপড়-ঞড়ঁত্রংস) গুরুত্ব বেড়েই চলেছে। ইকোট্যুরিজম হচ্ছে কোনো এলাকার স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও ব্যবস্থাপনায় প্রকৃতিকে উপভোগ করা। বিশ্বের সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল অঞ্চল চেরাপুঞ্জির খুব কাছেই অবস্থিত রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওর। হাওরের চারপাশে রয়েছে প্রায় শতাধিক গ্রাম। প্রাকৃতিক পরিবেশের আধার এ অঞ্চলটি হতে পারে পর্যটকদের এক অভয়ারণ্য। মূলত বর্ষার পানি এবং শীতকালে হাওর ঘুরে বেড়ানো নতুন রূপে বাংলাদেশকে পরিচয় করে দেওয়া যেতে পারে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মানুষদের সংগ্রামী ও সাহসী জীবনযাপন পর্যটকদের মুখরিত করবে নিঃসন্দেহে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর