বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

কোরবানির চামড়া ছাড়ানো ও সংরক্ষণ পদ্ধতি

ডা. সফিউল আহাদ সরদার স্বপন

কোরবানির চামড়া ছাড়ানো ও সংরক্ষণ পদ্ধতি

কোরবানির সময় অদক্ষ লোকজন কোনো নিয়ম-কানুন না মেনে ইচ্ছামতো পশুর চামড়া ছাড়ানোর কাজ করে। ফলে অনেক চামড়া ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়। এ জন্য চামড়া ছাড়ানোর জন্য সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। কোরবানির পশুকে কোরবানির আগের রাত থেকে দানাদার খাবার (খড়, ভুসি, ঘাস) দেওয়া বন্ধ রাখতে হবে। তবে কোরবানির দিন সকালে পশুকে পর্যাপ্ত পরিষ্কার পানি পান করতে দিতে হবে। এতে জবাইয়ের পর চামড়া ছাড়ানো সহজ হয়। কোরবানির দিন ভোরে পশুকে ভালোভাবে গোসল করাতে হবে। শরীরের ময়লা পরিষ্কার করে দিতে হবে। পশু কোরবানির স্থান হিসেবে সমতল জায়গা বেছে নেওয়া উচিত। কংক্রিটের মেঝে অথবা এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় গরু জবাইয়ের ব্যবস্থা করা ঠিক নয়। কারণ এতে গরু আহত হতে পারে এবং চামড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পাড়া বা মহল্লার সব কোরবানির পশুকে এক জায়গা অথবা এক মাঠে কোরবানি করা যেতে পারে। কোরবানির সময় পশুর যেন কষ্ট না হয় সে জন্য জবাইয়ের সময় অত্যন্ত ধারালো ছুরি ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু চামড়া ছাড়ানোর জন্য ব্যবহার্য ছুরি অপেক্ষাকৃত কম ধারালো হতে হবে কারণ ধার বেশি হলে চামড়া কেটে যেতে পারে। কোরবানির জন্য শোয়ানো অবস্থায় পশুটিকে যেন টানাহিঁচড়া না করা হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। জবাইয়ের পর পশুর শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। পশুর দেহের প্রাণস্পন্দন একেবারে থেমে যাওয়ার পর চামড়া ছাড়ানো শুরু করতে হবে। পশুকে শিরদাঁড়ার ওপর চিৎ করে শুইয়ে দুই পাশে ঠেস দিতে হবে। এরপর ছুরির মাথা দিয়ে গলার জবাই করার স্থান থেকে গলা, সিনা ও পেটের ওপর দিয়ে মলদ্বার পর্যন্ত সোজাভাবে হালকা করে কাটতে হবে। সামনের দুই পায়ের গোড়ার কাটা থেকে পায়ের ভিতর অংশ দিয়ে সোজা চামড়া ফাড়া দিয়ে ঊরু ফলকের ওপর দিয়ে কেটে বুকের লম্বা কাটার সঙ্গে সংযোগ করতে হবে। পেছনের দুই পায়ের ক্ষেত্রেও একইভাবে চামড়া কাটতে হবে।

এরপর পায়ের গোড়া থেকে সম্পূর্ণ পা এবং পেটের চামড়ার কিছু অংশ ছাড়িয়ে নিতে হবে। পরে চার পা এবং নাড়িভুঁড়ি ছাড়াতে হবে। ছাগল ও ভেড়ার চামড়া ছাড়ানোর সময় যদি উঁচুতে কোনো কিছুর সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া যায় তাহলে চামড়া ছাড়ানো সহজ ও সুবিধাজনক হবে। ছাগল ও ভেড়ার চামড়া ছাড়ানোর সময় ছুরি ব্যবহার না করে কাঠ বা পিতলের মুণ্ডু অথবা হাতের মুঠি দিয়ে ঠেসে ঠেসে মাংস হতে চামড়া আলাদা করা যায়। চামড়া সঠিকভাবে ছাড়ানোর পর তা সংরক্ষণ জরুরি। পশুর চামড়া ছড়ানো ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ যদি অনভিজ্ঞ লোক দ্বারা সম্পন্ন করা হয় তাহলে চামড়ার গুণগতমান নষ্ট হয়ে যায়। সাধারণত জবাই করার পর ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, পোকামাকড় ইত্যাদির আক্রমণে চামড়ার ক্ষতি বা গুণগতমান নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এসব জীবাণু থেকে চামড়াকে রক্ষা করতে বর্তমান বিশ্বে ড্রাই ট্রিটমেন্ট, সল্ট ট্রিটমেন্ট ও ফ্রিজিং করে চামড়া সংরক্ষণ করা হয়।  উন্নত দেশগুলোতে চামড়া সংরক্ষণে ড্রাই ট্রিটমেন্ট ও ফ্রিজিং পদ্ধতি করা হলেও তা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ। তাই আমাদের দেশে সল্ট ট্রিটমেন্ট বা লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করা হয়। চামড়া ছাড়ানোর পর তা শিগগিরই সম্ভব বিক্রয় কেন্দ্রে পাঠাতে হবে। ৫ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে চামড়া বিক্রি না হলে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে চামড়া ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। চামড়ায় লেগে থাকা অতিরিক্ত গোশত, চর্বি ও ঝিল্লি ভালোভাবে ছুরি দিয়ে উঠিয়ে ফেলতে হবে। এটা সঠিকভাবে না করলে ওইসব স্থানে লবণ প্রবেশ করবে না। চামড়া সমান মেঝেতে বিছিয়ে চামড়ার ভিতরের দিকে সর্বত্র লবণ ছিটিয়ে ভালোভাবে লেপে দিতে হবে। প্রথমবার দেওয়া লবণ শুষে নিলে পুনরায় একইভাবে লবণ মাখাতে হবে। একটি মাঝারি সাইজের গরুর চামড়ার জন্য চার-পাঁচ কেজি এবং একটি ছাগলের চামড়ার জন্য এক কেজি পরিমাণ লবণ দরকার হয়। কোরবানির মাংস প্রক্রিয়ার কাজ শেষ হয়ে গেলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ওই স্থান খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করা। সব বর্জ্য পদার্থ ঠিকভাবে অপসারণের পর ওই স্থানের রক্ত ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে সেখানে জীবাণুনাশক বা ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগ করতে হবে। পরিবেশ যেন সব সময় সুন্দর, পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যসম্মত থাকে সেদিকে আমাদের সবাইকে দৃষ্টি দিতে হবে। জবাইকৃত স্থানে যাতে কুকুর, বিড়াল, বন্য কোনো প্রাণী না আসতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। চামড়া আমাদের দেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ যা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আনয়ন করে। কোরবানির সময় এ জাতীয় সম্পদের সুষ্ঠু প্রক্রিয়াজাত, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দিকে দৃষ্টি রাখা আমাদের সব নাগরিকের দায়িত্ব।

লেখক : কৃষিবিদ, ভেটেরিনারিয়ান ও সাবেক যুগ্ম মহাসচিব কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর