বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাঁচাও রোহিঙ্গা, জাগো আনিস, রুখো ধর্ষক

পীর হাবিবুর রহমান

বাঁচাও রোহিঙ্গা, জাগো আনিস, রুখো ধর্ষক

এবার ঈদুল আজহার আনন্দ কতটা স্পর্শ করেছে দেশের মানুষকে বলতে পারি না। তবে ঈদের এই আনন্দ আমাকে স্পর্শ করেনি। ঈদের আগেই টাঙ্গাইলের বাসে রূপা নামের তরুণীটিকে বাসচালক ও হেলপাররা যেভাবে ধর্ষণ ও ঘাড় মটকে হত্যা করেছে তা সাম্প্রতিককালের একের পর এক ঘটে যাওয়া ধর্ষণের চরম, মর্মান্তিক ও বর্বরোচিত চিত্রকে উন্মোচন করেছে। একের পর এক ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে না পারার ব্যর্থতা শুধু প্রশাসনের নয়, সমাজেরও।  সর্বগ্রাসী সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে যেখানে আজ পিতার হাতে কন্যা, চাচার হাতে ভাতিজি, শিক্ষকের হাতে ছাত্রী, মাদ্রাসা শিক্ষক ও ইমামের হাতে কিশোরী ধর্ষিত হচ্ছে—তখন লজ্জা, ঘৃণা, ক্ষোভে দ্রোহের আগুন জ্বলে।

এদিকে, বিশ্ব রাজনীতির অশান্ত, অস্থির সময়ে পৃথিবীজুড়ে এক ধরনের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা চলছে। মিয়ানমারে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে স্বাধীন আরাকান রাজ্যের স্বপ্নবান মানুষকে যে হারে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, বসতবাড়ি থেকে নির্দয় উচ্ছেদ অভিযান চলছে তা বিশ্ব বিবেককে ব্যথিত, ক্ষুব্ধ করলেও অতীতের মতো বিশ্ব মোড়লরা কিংবা জাতিসংঘ এই রক্তপাত রুখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বার্মার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দীর্ঘ অবরোধ, কারারুদ্ধ, সংগ্রামমুখর বর্ণাঢ্য জীবনের বিস্ময়কর চরিত্র নিয়ে যিনি বিশ্ববাসীর কাছে নন্দিত হয়েছিলেন, ব্যালট বিপ্লবে অভিষিক্ত সেই অন সাং সু চিও আজ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বর্বর আক্রমণে সমর্থন দিচ্ছেন। এমন অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত। পাকিস্তানের ধর্মান্ধ সন্ত্রাসবাদের গুলি খেয়ে বেঁচে থাকা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মালালা এই গণহত্যার প্রতিবাদ করে যথার্থই বলেছেন, শিশুদের কেন হত্যা করা হচ্ছে, তারা তো কোনো অন্যায় করেনি। রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব দিন। পাগলের মতো অসহায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। এবারের আক্রমণে দেড় লাখ শরণার্থী প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। পাকিস্তান ফিরিয়ে না নেওয়া বিহারিদের চাপ এমনিতেই বইছে বাংলাদেশ। নতুন করে রোহিঙ্গাদের চাপ বাড়ছে। মালদ্বীপ মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করে সঠিক প্রতিবাদ করেছে। দেশে দেশে মুসলমানরা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আর ধর্মান্ধ বৌদ্ধদের মানুষ হত্যার প্রতিবাদে ঝড় তুলেছে।

‘জোর যার মুল্লুক তার’ এমন নীতিতে ফের অশান্ত হয়ে উঠেছে পৃথিবী। ফোর্বস ম্যাগাজিনে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অ্যান্ডার্স কর এক নিবন্ধে লিখেন, মিয়ানমার মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ অধ্যুষিত। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজ সরকারের অত্যাচারের কারণে ১৭৮৪ সাল থেকে শুরু করে ২০১৬ সাল পর্যন্ত লাখ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্য ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেছে। যুগে যুগে এই নির্যাতনের ধারা অব্যাহত রেখে তাদের জীবন কেড়ে নেওয়া হয়েছে, নারীর সম্ভ্রম লুটেছে—এমনকি শিশুদেরও বাঁচতে দেওয়া হয়নি, দেশছাড়া করেছে। প্রাণের ভয়ে অজানা উদ্দেশ্যে এবারের মতো অতীতেও তারা নৌকায় চড়ে সাগরে ভেসেছে।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সরাসরি রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণ চালায়। তাদের বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। হত্যা করে বহু রোহিঙ্গাকে। নিপীড়ন চালাতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে অংশ নেয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা। এভাবে মিয়ানমার সরকারের অত্যাচার-নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের বাংলাদেশে পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নেয়। ১৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিশ্বব্যাপী রয়েছে। ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এখনো সেখানে নির্যাতনের মুখে পতিত। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমার সরকারের আক্রমণের শিকার হলেও তাদের সেনাবাহিনী এটাকে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ বলে অ্যাখ্যা দিয়েছে। তিন মাস ধরে চালানো বর্বর আক্রমণকে জাতিসংঘ ‘জাতিগত গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করছে।

বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক গৌতম বৌদ্ধ অহিংসা পরম ধর্ম বলে যে শান্তির বাণী ছড়িয়েছিলেন, রোহিঙ্গা মুসলমানদের রক্তে আজ তা ভেসে যাচ্ছে। গৌতম বুদ্ধের সেই বৌদ্ধরা ২০১২ সালে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালালে এক লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। সেই সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনী আক্রমণাত্মক বৌদ্ধদের সহযোগিতা করে। সেটিকে টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ বলে আখ্যায়িত করেন। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। দাবি উঠেছে, বিশ্ব সম্প্রদায় শান্তিপূর্ণ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে এ সমস্যার সমাধান না করলে মানবাধিকারই লঙ্ঘিত হচ্ছে না, সন্ত্রাসবাদও নতুন করে সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য একদিকে শরণার্থীদের মানবিক স্বার্থে আশ্রয় দিলেও ভবিষ্যতে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, জাতীয় স্বার্থে সবাইকে উপলব্ধি করে জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছা দরকার। সব কিছু নিয়ে রাজনীতি করা যায় না, কোনো কোনো বিষয় রাজনীতির জন্য আগুন নিয়ে খেলার শামিল।

রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণের মুখে ধর্ষিতা ও নিহত নারীর বুকে দুগ্ধপোষ্য শিশুর লাশের চিত্র সবার হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। নাফ নদীতে ভেসে আসা শিশুটির মর্মান্তিক পরিণতি ভূমধ্যসাগর পাড়ে সিরীয় শিশু আয়নালের প্রাণহীন ছবিটির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। যে ছবির দিকে তাকানো যায় না, যে ছবির দিকে তাকালে বোধহীন মানুষেরও ক্রন্দন আসে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কেবল বাংলাদেশই নয়, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, চীনেও আশ্রয় নিয়েছে। যে পৃথিবী অবাক-বিস্ময়ে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সু চির দিকে অবনত মস্তকে তাকাত তাদের অনেকেই আজ তার পদক কেড়ে নেওয়ার দাবি তুলেছেন। মানুষের জন্য মানুষের এই সহানুভূতি চিরন্তন সত্য। বিশ্ব মোড়লদের মানুষের হৃদয়ের শক্তিকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

একদিকে হৃদয়স্পর্শী রোহিঙ্গা ইস্যু, অন্যদিকে দেশে একের পর এক জেলা যেভাবে বন্যাকবলিত হয়েছে, মানুষ যেভাবে প্রকৃতির বৈরী পরিস্থিতির মুখে পড়েছে, যেভাবে হারিয়েছে ফসল, হারিয়েছে ঘরবাড়ি, পানির দরে বিক্রি করেছে হালের বলদ; সেখানে সরকার, রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি যতই মানবিকভাবে সাড়া দিক না কেন, বানভাসি মানুষের হৃদয়কে ঈদ-আনন্দ স্পর্শ করেনি। ঈদের উৎসব ছিল প্রাণহীন। যদিও এ বছর আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য নানা ঝক্কি-ঝামেলা সয়ে হাজীরা নিরাপদে হজ সম্পন্ন করেছেন। বিশাল জনগোষ্ঠীর এই নগর থেকে রীতিমতো যুদ্ধ করে নাড়ির টানে মানুষ বাড়ি গেছেন। যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব তারা তা সম্পন্ন করেছেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে কোরবানির পশুর সরবরাহ যেমন ছিল অপ্রতুল তেমনি দাম ছিল চড়া। তবে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও আল্লাহর করুণা লাভের আশায় হাট থেকে কেনা চড়া দামের কোরবানির পশু যারা অতীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মূল্যসহ নিজের ছবি দিতেন দম্ভের সঙ্গে তারা এবার সংযত হয়েছেন। যারা সেই ভাবগাম্ভীর্য ক্ষুণ্ন করে পশু কোরবানির রক্তাক্ত দৃশ্য ও গোশত কাটার ছবি দিতেন তারাও এবার নিবৃত থেকেছেন।

ছেলেমেয়েরা আগেই সুনামগঞ্জে ঈদ করতে গিয়েছিল। সুনামগঞ্জের দাদু বাড়ির জন্য তাদের টান তীব্র। আমি যাই ঈদের আগের দিন সন্ধ্যা ৭টার বিমানে ঢাকা থেকে সিলেট। সেখান থেকে সড়কপথে সুনামগঞ্জ। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (অভ্যন্তরীণ) শুক্রবার বিমান কাউন্টারে বোর্ডিং পাস দিচ্ছিলেন এক নারী। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের নারীদের দুখি দুখি চেহারা দেখলে আমার খুব মায়া হয়। বোর্ডিং পাস নিতে গিয়ে আমি ওই কাউন্টারের নারীকে অনুরোধ করি, শরীরটা বেশি ভালো নেই, আমার সিটটি যদি সামনের দিকে দেন, আমি খুশি হই। আমার সিট ছিল, ৫-এ। বিরক্তমুখে বোর্ডিং পাস ইস্যু করা মহিলাটি বললেন, আজকের ফ্লাইট ওভারলোডেড। আপনার অনুরোধ রাখা যাচ্ছে না।

বিমানবন্দরে ছিল ঘরমুখো মানুষের ভিড়। কেউ যাচ্ছেন যশোর, কেউ যাচ্ছেন চট্টগ্রাম। মাথা ভনভন করছিল। কোকিলের ডাক পছন্দ হলেও কানে বাজছিল কাকের ডাক। সুখবর হচ্ছে বিমানের ফ্লাইটটি বেশি বিলম্ব হয়নি, দেরি করেছিল মাত্র ৩০ মিনিটের মতো। কিন্তু বিমানে উঠেই অবাক হলাম আমিসহ যাত্রী মাত্র নয়জন। আমার সামনের সব আসন ফাঁকা, পাশে ও পেছনে বাকি আটজন। একপর্যায়ে বিমানের কেবিন ক্রুরা পেছনের যাত্রীদের সামনে নিয়ে এলেন বিমানের ওজনের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য। আমি শুধু নীরবে দেখলাম।

যাক, মধ্য রাতে যখন বাড়ি পৌঁছলাম, তখনো শরীরটা ভালো লাগছিল না। খাওয়া-দাওয়ার পর ঘুমাতে গিয়ে ঘুম আসছিল না। শরীরটা এতটাই বিগড়ে গেল যে, রীতিমতো শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। এমনিতেই সাহারা মরুভূমির মতো শুকিয়ে যাওয়া হৃদয়ে হৃদয় শুধু রিং চায়। হার্টে দুটি রিং আছে। এত রাতে বাড়ির কাউকে অস্থির, অশান্ত করব না বলে অনুজ প্রতিম মোজাম্মেল হক মুনিমকে ফোন করলাম। বলল সে সিলেটে। আমার অবস্থা জানালে, তার পরামর্শ মতো ভাতিজা হেলালকে খবর দিলে সে ছুটে আসে রিকশা নিয়ে। তার সঙ্গে বাড়ির পাশেই সুনামগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালে যাই। প্রবেশ করতে গিয়ে দেখি লোকসমাগম, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, জরুরি বিভাগের শয্যায় এক তরুণের রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। মধ্য রাতেই গুপ্ত ঘাতকরা ছুরিকাঘাতে কৃষক লীগ কর্মী জুনায়েদকে হত্যা করেছে। ভিতরটা আরও অস্থির ও অশান্ত হয়ে উঠল।

যে শহরের বুক-চিরে সুরমা কলকল ধ্বনিতে বয়ে যায়, যে শহর গভীর মমতায় অঙ্গাঙ্গীভাবে রাত জাগে, ঘুম যায়; সেই শান্তির শহরে আজকাল খুনির হাত রক্তাক্ত হয় স্বজনের প্রাণহানিতে। এর আগে মুক্তিযোদ্ধা খোকা চৌহানের ছেলে নিহত হয়েছে। যে শহর ছবির মতো সাজানো, যে শহর আমার আত্মাজুড়ে হাওরবেষ্টিত জল-জোছনার বাস্তব চিত্রপটে আঁকা বৃষ্টি, কবিতা, গান, প্রেম ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শহর হিসেবে মানুষে মানুষে আত্মীয়তা ও আত্মার বন্ধনে বাঁধা সে শহর এমন বিষণ্ন, বিবর্ণ হয়ে গেল কেন? সেই শহরে আজ রক্ত ঝরে কেন? অকাল বৃষ্টি ও বন্যায় হাওরের বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে গেছে। প্রকৃতির বৈরী আচরণের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ড, একদল ঠিকাদারের দুর্নীতির রাহুর আগ্রাসনে কৃষকের বুক ভেঙে যায়। আমরা প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠি। কিন্তু বিস্মিত হই, দুদকের মামলায় চেনা দুর্নীতির বরপুত্রদের সঙ্গে শহরের একদল চেনামুখ যারা কাজ করে খায়, তাদের নামও এক পাল্লায় উঠে যায়। এ নিয়ে কেউ কথাও বলে না। সৎ আর অসৎ যদি এক পাল্লায় উঠে সাজা পায়, তাহলে ভবিষ্যতে হাওর রক্ষা বাঁধে কাজ করার লোকবল তো পাওয়াই যাবে না; ন্যায়বিচার পাওয়াও দুরূহ হয়ে পড়বে।

যাক, সদর হাসপাতালে ডিউটি ডাক্তারের রুমে ঈদের আগের গভীর রাতে যখন শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে ঢুকলাম, তখন যে চিকিৎসকের মুখোমুখি হলাম; তার পরিচয় জানতে চেয়ে দেখলাম তিনি জামালগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ঈদের জন্য ডেপুটেশনে এসেছেন। হাসপাতালে স্রোতের মতো রোগীরা আসছেন। সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তারা সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমার শ্বাসকষ্টের নেবুলাইজার নেওয়া ছাড়া শরীরের অবস্থা তারা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না। ততক্ষণে শহরের তরুণ সমাজসেবী ও ব্যবসায়ী সৈয়দ মনোয়ার, সৈয়দ তারিক হাসান দাউদ, দেওয়ান সুমন রাজা, সুশান্ত রায়সহ অনেকেই হাজির। একজন চিকিৎসক এসে ইঞ্জেকশন দিলে ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মাহবুবুর রহমানকে ফোনে ধরিয়ে দেই। ততক্ষণে সিভিল সার্জন ও আমার স্কুলের অগ্রজ মেধাবী ছাত্র আশুতোষ দা এসে হাজির। ডা. মাহবুবের প্রেসক্রিপশন ফলো করে আমার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে রবিবার সকাল ১০টার ফ্লাইটে ঢাকায় চলে আসি। সদর হাসপাতালে অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে, ডাক্তার, নার্স সংকট কমেছে। আমার ছোটভাই হাসপাতালের চিকিৎসার উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু সব ধরনের রোগীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালটি এখনো নিরাপদ নয়। ডিউটি ডাক্তারের কক্ষের ওয়াশরুমে সকালে প্রবেশ করে আমার বমি আসার জোগাড়। হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা কোনো কঠিন কিছু নয়। কর্তৃপক্ষ তার সমাধান কেন করতে পারে না, বুঝি না। একজন সুইপার বা ক্লিনার ডাকলে যেখানে হয়, সেখানে কী স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে গিয়ে দেখতে হবে?

আমি বুঝতে পারি না, প্রতিষ্ঠানে যারা কর্মরত তারা কী তাদের কাজ করার পরিবেশটা পরিচ্ছন্ন রাখতে পারেন না?

ফেরার পথে বিমানে দেখা হয় জাতীয় অধ্যাপক ডা. শাহলা খাতুন ও ড. আবুল মোমেন, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের দুই ভাইবোন। বিমান ঢাকায় পৌঁছে গেলেও বিমানের সিঁড়ি আসতে বিলম্ব। তাই যাত্রীদের অনেকক্ষণ বিমানেই বসে থাকতে হয়। বিমানের ভাগ্যবদল আদৌ হবে কিনা, জানি না। তবে সিলেট এয়ারপোর্টে একজন বিমানকর্মী রয়েছেন আবদুল আজিজ। গোপালগঞ্জ বাড়ি হওয়ায় অনেকে তাকে শেখ হাসিনার আজিজ বলে ডাকেন। কী ধনী, কী গরিব, কী ভিআইপি, কী সাধারণ; সব মত-পথের যাত্রীকে নিরলসভাবে সেবা দিতে তিনি ছুটে বেড়ান। সিলেটের মানুষের হৃদয় জয় করে বসে আছেন।

এতসব ঘটনার বাইরেও ঈদের আগে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী রায় বাতিল ঘিরে রাজনীতিতে যে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল সেটি স্তিমিত হওয়ায় কিছুটা উদ্বেগ কমেছে। নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে বিরোধ কাম্য নয়। কাম্য নয় প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে লাগামহীন, দায়িত্ব-জ্ঞানহীন আক্রমণাত্মক কথাবার্তা। ঈদের দিন বঙ্গভবন ও গণভবনে ঈদের দাওয়াতে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার উপস্থিতি ছিল সপ্রতিভ।

ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক নিরাময়যোগ্য ব্রেইনের বিরল রোগে চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে লন্ডনের একটি হাসপাতালে শুয়ে আছেন। তার স্ত্রী অত্যন্ত মেধাবী, যোগ্য ও বিদুষী রমণী রুবানা হক দেশের সব মানুষের কাছে প্রবল জনপ্রিয় এক সময়ে টিভি উপস্থাপক থেকে শীর্ষ ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা এবং সর্বশেষ ঢাকা উত্তরের নির্বাচিত মেয়র, সৃজনশীল, মেধাবী, চিরসবুজ আনিসুল হকের রোগমুক্তির জন্য দোয়া চেয়েছেন। ঢাকায় কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণে দক্ষিণের সিটি মেয়র সাঈদ খোকন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। দুই সিটি করপোরেশন এ ক্ষেত্রে অনেকটাই সফল হয়েছে। আনিসুল হক ঢাকা উত্তরের মেয়র হয়ে উন্নয়নের যে কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন, অবৈধ দখল উচ্ছেদ থেকে, তেজগাঁওয়ের মাফিয়া নিয়ন্ত্রিত ট্রাকস্ট্যান্ড সাহসিকতার সঙ্গে সরিয়ে দেওয়া, রাস্তাঘাট বর্ধিত করে উত্তরের ভোটারদের মনে ব্যাপক আশার সঞ্চার করেছেন। আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা অর্জন করেছেন। তার কর্মোদ্যম, সততা, সৃজনশীলতা নগরবাসীকে নাগরিক সেবাসহ একটি ক্লিন সিটি উপহার দেওয়ার কর্মযজ্ঞ যখন তুঙ্গে উঠিয়েছেন, বলা যায় কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে সবার সঙ্গে গভীর সম্পর্কের সমঝোতার সূচনা ঘটিয়ে যেভাবে কাজ করছেন, তাতে মানুষ বলছেন, তাকে দিয়েই হবে। তার অসুস্থতার সংবাদে গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হৃদয় দিয়ে আল্লাহর কাছে তার জন্য মোনাজাত করছেন। সমস্যাকবলিত ব্যাপক জনসংখ্যার প্লাবনে প্লাবিত নগরবাসীকে নিয়ে স্বপ্নের দৌরগোড়ায় পৌঁছাতে সবার আকুতি, মেয়র আনিসুল হক ফিরে আসুন।

ঈদের দুই রাত আগে একজন অকপটে যুক্তিনির্ভর কথা বলায় ও লেখায় দর্শক ও পাঠককে জয় করা সিনিয়র সাংবাদিক কাজী সিরাজের মৃত্যুতে দেশের অসংখ্য মানুষ আমার মতো শোকাহত। একই সঙ্গে আরেক সিনিয়র সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরীর আকস্মিক পরলোকগমনে স্তম্ভিত। দুজন অগ্রজের মৃত্যুর বেদনা শেষ হতে না হতেই প্রিয় সালেহ ভাই, মানে প্রবীণ সাংবাদিক সালেহ চৌধুরীর মৃত্যু আমাদের বেদনাহত করেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, দাবাড়ু ও দেশসেরা শীর্ষ সাহিত্যিকদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের বাঁধনে আটকে পড়া এই অভিজাত মানুষটিও চলে গেলেন। যুক্তরাষ্ট্রে বেড়াতে গেলে তার ক্যান্সার ধরা পড়ে। দেশে ফিরে এক মাসও সময় পাননি। এতটাই স্নেহ করতেন যে, তার বাড়িতে মাঝে-মধ্যে না যাওয়ার কারণে দেখা হলেও গভীর স্নেহে ডেকে তার অভিমানের দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন। হাতে শৌখিন লাঠি, শ্বেত শুভ্র চুল, পুরো লেন্সের চশমা, বনেদি গোঁফের মিষ্টি হাসিতে আমাদের সেকেন্ড হোম খ্যাত জাতীয় প্রেস ক্লাবে আর কোনো দিন তিনি কাছে ডাকবেন না আমাকে।  আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দিন। কাজী সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে অনেক টকশো করেছি। অনেক দিনের সম্পর্ক।  বিভিন্ন জায়গায় মতের অমিল হয়েছে। কখনই কেউ পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের জায়গাটি হারাননি।  এসব মিলিয়ে এবারের ঈদ হৃদয়কে স্পর্শ করেনি।

            লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর