বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঈদের দিনও ভাদ্র-আশ্বিন : পুরুষ না মানুষ?

মোস্তফা কামাল

ঈদের দিনও ভাদ্র-আশ্বিন : পুরুষ না মানুষ?

ঈদের দিনেও ক্ষ্যান্ত দেয়নি ওরা। ত্যাগ-মহিমার ঈদের দিন ১৮ ভাদ্র ঈদের নামাজ-কোরবানি বাদ দিয়ে পটুয়াখালীর বাউফলে পাঁচ মর্দের অবদান গণধর্ষণ কর্মে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মাকে দেখতে যাওয়ার পথে মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে নির্জনে নিয়ে এক তরুণীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে এরা। ধর্ষণের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো একটির চেয়ে আরেকটি আরও জঘন্য, বীভৎস।  মা-বাবার সামনে মেয়েকে, মেয়ের সামনে মাকে ধর্ষণের সিরিজে এখন যোগ হয়েছে বাস-ট্রাক। হোটেলে, পার্টিতে, জন্মদিনে বা গান গাইতে দাওয়াত দিয়ে একের পর এক ধর্ষণের বর্ষণ নিয়ে মিডিয়ায় কদিন ধরে তোলপাড়। এরপর যোগ হলো চলন্ত ট্রাক-বাসে গণধর্ষণ। পরে ঘাড় মটকে মেরে ফেলা। চালু হয়েছে কেটে টুকরা টুকরা করে ড্রামভর্তি করার আরেক সংস্করণও। নারীর ওপর, জাতির ওপর এ কোন শনি?

ভাদ্র মাসে কোন জন্তুর বৈশিষ্ট্য ভর করেছে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের ওপর? ভাদ্র-আশ্বিন কুকুরের বিশেষ মৌসুম। এ দুই মাসে মাদি কুকুর দেখলেই হামলে পড়ে মর্দ কুকুর। এ সময়টায় কুকুরের কামড়ের বিষও বেশি। সচেতন মানুষ তাই নিজ গরজেই সতর্ক থাকে কুকুর থেকে। বাঁচার রাস্তা থাকে মাদি কুকুরেরও। সে অসুস্থতা বা অন্য কোনো ওজর দেখালে মর্দ কুকুরটা শরমে লেজ গুটিয়ে সাইড কেটে চলে যায়। কিন্তু মানুষ মর্দগুলোর শরমিন্দা হয় না। থামছেও না। ঈদ, রোহিঙ্গা নিপীড়ন, বন্যা, ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে ক্যাচালের কারণে অনেকটা ঢাকাই পড়ে যাচ্ছে ঘটে চলা ধর্ষণের খবরগুলো। গণমাধ্যমে এগুলো ঠাঁই পায় অন্য সংবাদের আশপাশে, মাঝে, পেছনে-ভিতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আবার সব খবর যে গণমাধ্যমে আসে এমনও নয়। এলেই বা কি?

ধর্ষণের নিউজ ভ্যালু মানুষের কাছেও এখন আগের মতো নেই। এসব সংবাদে কদিন ক্ষোভের মাতমে গরম প্রতিক্রিয়ায় ঘৃণার জানান দেয় বিভিন্ন মহল। তাতে কী? ধর্ষণ এখন গুরুতর সাজাযোগ্য অপরাধ নয়। আজ পর্যন্ত একটি ধর্ষণের ঘটনায় উদাহরণ হওয়ার মতো বিচার কি হয়েছে? তবে কেন ক্ষণিকের জন্য হলেও কেউ ধর্ষণ করতে ভয় পাবে? ধর্ষণের ঘটনার বিচার হয় এমন আস্থা-বিশ্বাস সাধারণ মানুষের মধ্যে নেই। সেই বিশ্বাস-ভরসা জন্ম দেওয়ার দায়িত্বটি সরকার, রাষ্ট্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। সর্বোপরি বিচার ব্যবস্থার। কিন্তু ধর্ষণের বিচার ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়া ধর্ষিতের জন্য খাঁড়ার ঘায়ের মতো বেদনার। আর ধর্ষকের জন্য নিস্তারের। ধর্ষণের বিচারপ্রার্থী হওয়ার যন্ত্রণা হাড়ে হাড়ে টের পান ভুক্তভোগী ও তার স্বজনরা। এ বিচার চাওয়া যেন আরও ধর্ষণের আমন্ত্রণ। বিচারের পথে পদে পদে ধর্ষণেরই হাতছানি। এর হালনাগাদ উদাহরণ বগুড়ায়। নিজে ধর্ষণের পর যুবতীকে বন্ধুদের হাতে তুলে দেয় প্রতারক প্রেমিক লিমন। তারা করে গণধর্ষণ। এসব ধর্ষণের বিচারের আশায় বগুড়ার ধুনটে ইউপি চেয়ারম্যান লাল মিয়ার কাছে যায় বেচারি। সেখানে  আবারও ধর্ষণ। বিচার? এরই মধ্যে ঘটনাকে মিথ্যা প্রমাণের যাবতীয় আয়োজন শেষ করে এনেছেন চেয়ারম্যান সাহেব। বরগুনার বেতাগীতে স্কুলের ক্লাসরুমে এক শিক্ষিকাকে গণধর্ষণের অভিযোগও মিথ্যা প্রমাণের তেমন বাকি নেই। শেষ হাসিও গণধর্ষকদেরই। বেতাগীর কদমতলা গ্রামের হিরন বিশ্বাসের ছেলে সুমন বিশ্বাস, আবদুল বারেক মিয়ার ছেলে রাসেল, কুদ্দুস কাজীর ছেলে সুমন কাজী, সুলতান হোসেনের ছেলে রবিউল, রহমানের ছেলে হাসান, রহমান হাওলাদারের ছেলে জুয়েল শিনা টান করে ঘুরছে। সোনার টুকরারা জানান দিচ্ছে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের হিম্মত। পাবনার সুজানগরে দুই স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণের পর সেই দৃশ্য ইন্টারনেটে ছড়ানোর বিচারের আলামতও দুর্বল। ধর্ষণের বিচারের পথঘাট ও কেস স্টাডি কম-বেশি এমনই।

বাংলাদেশে ধর্ষণের বিচারের ভিত্তি ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারার ৪ উপধারা। এর শাস্তি যাবজ্জীবনসহ কারাদণ্ড ও জরিমানা। কিন্তু কটা ধর্ষকের তা হয়? শতে একজনেরও না। পুলিশ সদর দফতর এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, বছরে ধর্ষণ মামলায় সাজা হয় হাজারে বড় জোর চারজনের। শতকরা দশমিক ৪০। বিচারের সময় নাস্তানাবুদ হতে হয় ধর্ষণের শিকার নারীকে। তার স্বভাব-চরিত্র এবং ইতিহাস নিয়ে এন্তার প্রশ্ন তোলা যায়। কিন্তু ধর্ষককে তা করা হয় না। ধর্ষকের আইনজীবী এই সুযোগটা ষোলোআনাই নেন। ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্র হরণ করে তার ছোড়া প্রশ্নগুলো ওই নারীকে আরেকবার ধর্ষণের মতোই। এই উপধারাটি বাতিলের পক্ষে বহুবার বহু মতামত দেওয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতিসহ আইন-সংশ্লিষ্টরা এটি বাতিলের সুপারিশও করেছেন। এরপরও তা অক্ষতভাবে বহাল রাখা ধর্ষকদের জন্য স্বস্তির। বিকৃত আনন্দেরও। বিচারের সঙ্গে বিবেচনায়ও ধর্ষণের যত দোষ ছোড়া হয় ধর্ষিতের ওপরই। এত রাতে বাইরে কেন, পোশাক কেন এত উত্তেজক— এমন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ধর্ষিতাকে নাকানিচুবানি খেতে হয় আদালতে। পুলিশের কাছে গেলেও এমন রুচির প্রশ্নবাণ। সে সঙ্গে মুখ টিপে হাসি, লোলুপ দৃষ্টি, কাছে যাওয়ার ইশারা। প্রমাণ হিসেবে সাক্ষী হাজির করার তাগিদ। আর ধর্ষকের অনুকূলে টাকার খেলা, জোর তদ্বির। এ অবস্থায় অবশিষ্ট ইজ্জত-সম্ভ্রমের ভয়ে সব ধর্ষণের অভিযোগ পুলিশ পর্যন্ত গড়ায় না। এরপরও যারা জেদের চোটে অগ্রসর হন তাদের পরিণতি বড় নির্মম। ধর্ষকের শাস্তির ব্যাপারে সংশয় নিয়েই ছুটতে হয় আইন-আদালতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ধর্ষকরা গড়পড়তা সবাই কোনো না কোনোভাবে প্রভাবশালী। দু-একটা নিজে অক্ষম হলেও প্রভাবশালীর দোয়া বা দয়া হাসিল করতে সক্ষম। ধর্ষিত, তার পরিবার ও মামলাকে আয়ত্তে এনে সমঝোতার ঠকবাজিতে সফল হয় এরা। অন্যদিকে, ধর্ষণের শিকার নারী অথবা শিশুর পরিবার সামাজিক কারণে ঘটনাটি চেপে যেতে চায়। এতে সুযোগ পুরোটাই ধর্ষকের। শাস্তির ধারেকাছেও যেতে হয় না তাকে।

আইনের ফাঁকটা ছিদ্রের মতো নয়। গণধর্ষক বা ধর্ষকদের র‌্যালি করে যাতায়াতের মতো প্রশস্ত। মামলায় তাদের প্রমাণ করতে হয় না সে বা তারা ধর্ষণ করেছে। বরং মামলা দায়ের থেকে শুরু করে প্রতিটি জায়গায় নারীকেই প্রমাণ দিতে হয় যে তিনি ধর্ষিত। এ প্রমাণ দিতে গিয়ে ওই বেচারিকে দফায় দফায় ‘ধর্ষিত’ই হতে হয়। কখনো কখনো ধর্ষণের অভিযোগ তুলে নিয়ে নিজেকেই আসামি হতে হয়। পেনাল্টির মতো তখন গোলটা দেয় ধর্ষকই। আইনে আছে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে। বিশেষ ক্ষেত্রে কারণ দেখিয়ে বাড়তি সময় নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে মামলা শেষ হতে ১০-২০ বছরও লেগে যাচ্ছে। আর তদ্দিনে ধর্ষিতকে ধর্ষণের বিবরণ ও প্রমাণ দিতে দিতে বার বার ধর্ষণের দিকেই এগোতে হয়। শারীরিক পরীক্ষায়ও ধর্ষণ প্রমাণ করা কঠিন। সেখানেও টাকার খেলা। মেডিকেল টেস্টের জন্য যাওয়ার পর ‘ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি মর্মে সার্টিফিকেট হাত করা খুব কঠিন নয়। আসামির ধর্ষণের ক্ষমতাই নেই— এমন প্রমাণও দাঁড় করানো যায়।’ এর অব্যাহত পরিণতিতে ধর্ষণ অনেকটা মামুলি ব্যাপারে এসে ঠেকেছে। কদিন মাতামাতির পর আলগোছে ঘটনাটি চাপা পড়ে যায়। আরেকটি না ঘটা পর্যন্ত আর চেতন আসে না। এখন আর শুধু ধর্ষণের নিউজ ভ্যালুও তেমন নয়। গণধর্ষণও তেমন আইটেমের গুরুত্ব পায় না। যেন কিছুই হয়নি, এ আর এমন কি! ধর্ষণ বা গণধর্ষণের পর মেরে ফেললে বা ধর্ষক বিশেষ শ্রেণির হলে ঘটনার যোগ্য হচ্ছে। সাভার, বগুড়া, সিরাজগঞ্জসহ কয়েকটি ঘটনাদৃষ্টে ধর্ষণে ক্ষমতাসীন দল এগিয়ে থাকলেও এই পশুত্বের স্টিয়ারিংয়ে অন্যরাও পিছিয়ে নন। কেউ কেউ বেশ সম্মানীয়ও। চন্দ্রবিন্দু ( ঁ) দিয়ে সম্মান করতে হয় তাদের। পুলিশ, শিক্ষক, গণমাধ্যম কর্মী, বাস-ট্রাক ড্রাইভার, হেলপার কে নেই এ কাজে? কাকে পায়নি কুকুরের ভাদ্র-আশ্বিনের রোগে? আইনে তো তারা মানুষ।

ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার রেকর্ড কুকুরেরও নেই। বেশ কটি ঘটনায় কিছু মানুষের চেয়ে কুকুরের বেশি বোধবুদ্ধি প্রমাণিত। এ অবস্থায় কুকুর বা জন্তু সোসাইটির কেউ যদি মানবকুলকে মানুষের বাচ্চা বলে গালাগাল শুরু করে কী দাঁড়াবে অবস্থাটা? আবার গালি যে দিচ্ছে না সেটাই বা বলি কী করে? আমরা তো ওদের ভাষা বুঝি না। কুকুররা না হলেও নারীরা কিন্তু সমানে গাল-মন্দ ছুড়ছে পুরুষ জাতকে। আক্রান্ত নারীকুলের চোখে এরা শুধুই পুরুষ, মানুষ নয়। নারী হয়ে জন্ম নেওয়াটাই পাপ মনে করে তারা। অন্যদিকে, পুরুষদের কারও কারও মানুষরূপী কিছু জীবের কারণে আজন্মের পাপী-তাপী ভাবতে হচ্ছে। মনুষ্যত্বের বিচারে এগুলো কি পুরুষ? না মানুষ? মানুষের মধ্যে আবার ভাবভঙ্গিতে পুরুষরাই সেরা। শুধু সেরা নয়, সেরারও সেরা। এই সুখ ভাবনার কিছু পুরুষের কব্জায় ধর্ষণের লাইসেন্সও। কাণ্ডকীর্তিতে তারা মানুষকে পশুরও নিচে নামিয়ে ফেলছে।

পুরুষ নামীয় এই প্রাণীগুলো মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব থেকে কান ধরে নামানোর ফন্দি করে ছাড়ছে। পশু বা অন্য প্রাণীদের প্রতিষ্ঠান থাকলে সেই দাবি কোথায় গিয়ে ঠেকত? মানুষকে তখন আশরাফুল মাখলুকাতের হকদার রাখার পক্ষে কী সাফাই মিলবে? অথচ পশুসহ জগতের অন্য সবাই মানুষের বশ্য। অন্য কোনো প্রাণী এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ারই অযোগ্য। একদম ডিসকোয়ালিফাই। ফিট-আনফিটের যোগ্যতা যাচাইয়ের সুযোগই নেই তাদের। এই শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে বিশ্ব সভ্যতার বাইরে আন্দামান দ্বীপের বন্য মানুষরাও। অসভ্য নামের জংলিদের মধ্যে অবৈধ যৌনাচার শতভাগ নিষিদ্ধ। এখনো আধা ন্যাংটা থাকা ওই সমাজে ইচ্ছার বাইরে যৌন অপরাধের শাস্তি একটাই।  প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড। সেখানকার নারীদের কাপড় পরে পর্দা করতে হয় না।  ভাবতেই হয় না সম্ভ্রম রক্ষার কথা। ধর্ষিত হবে না, নিশ্চিত হয়েই তারা ঘর থেকে বেরোয়।  আর আমাদের বধূ-মাতা, কন্যা-ভগ্নিরা?

            লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর