বুধবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভারতে গেরুয়া বাহিনী গুরুত্ব পাচ্ছে

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

ভারতে গেরুয়া বাহিনী গুরুত্ব পাচ্ছে

ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে এই মুহূর্তে দুটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ— প্রথমত, অর্থনীতি এবং দ্বিতীয়ত সন্ত্রাসবাদ। আর এ দুটি চ্যালেঞ্জকেই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার সুফল এখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষ। ১৯ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে ৩নং মতিলাল নেহরু মার্গে তার সরকারি বাসভবনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেছেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী তথা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মনমোহন সিং। ড. সিং তার ঠিক আগে দুই দিনের কাশ্মীর সফর করে এসেছেন। সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, সব শ্রেণির লোকের সঙ্গে কথা বলে তার ধারণা হয়েছে তৎকালীন জম্মু-কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে বলে সংবিধানের ৩১-এ ধারাতে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন যে ভারতের অন্য কোনো রাজ্য থেকে জম্মু-কাশ্মীরে গিয়ে জমি কিনতে পারবে না। কিন্তু বর্তমান ভারত সরকার এবং কাশ্মীরের মেহবুবা মুফতি সরকার পরিস্থিতিকে ক্রমশ জটিল করতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, তার ১০ বছরের রাজত্বকালে জম্মু-কাশ্মীরে স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকও করেছিলেন। তৎকালীন পাক শাসক মিলিটারি ডিক্টেটর জেনারেল মোশাররফকে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানে নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর এ ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা করা হবে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে। কিন্তু নির্বাচনের আগেই পাকিস্তানের নেত্রী বেনজির ভুট্টোকে হত্যা করার ফলে যতটা অগ্রসর হওয়া গিয়েছিল, ঠিক ততটাই পিছিয়ে আসতে হয়েছে। আমি আশা করেছিলাম, বর্তমান দিল্লি সরকার এবং জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ক্ষমতা ভাগাভাগি না করে মূল সমস্যা সমাধানের দিকে হাঁটবে। কিন্তু তা তারা করেননি। তাই কাশ্মীর পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। তিনি এ ব্যাপারে তার পর্যবেক্ষণের রিপোর্ট কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর হাতে পৌঁছে দিয়েছেন। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সব বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছবে। তারা এ ব্যাপারে ভারতের বিজেপি সরকারের সঙ্গে সব রকম সহায়তা করতে প্রস্তুত। তাকে প্রশ্ন করা হয়, বর্তমানে ঢাকা ও দিল্লির সম্পর্ক কীভাবে দেখছেন? উত্তরে ড. সিং বলেন, ১০ বছর ভারত শাসনকালে আমি দুটি চুক্তির ওপর জোর দিয়েছিলাম। একটি চুক্তি হয় ১৮ মার্চ ১৯৭২ সালে। ঢাকায় সে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং ইন্দিরা গান্ধী। দ্বিতীয় চুক্তি এই দুই নেতার মধ্যে হয়েছিল ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি। এ চুক্তি দুটোতেই পথনির্দেশিকা দেওয়া রয়েছে কীভাবে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব সহযোগিতা এবং সহমর্মিতা বজায় রাখা যায়। আশা করব, বাংলাদেশ নীতির ব্যাপারে মোদি সরকার সেই পথেই হাঁটবেন। যদিও এখন পর্যন্ত দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে সুসম্পর্ক বহাল আছে। কথা শেষ করার আগে সব কাগজপত্র নিয়ে গেছিলাম তোমাদের...। এ পর্যন্ত বলে তিনি থেমে গেলেন। তারপর আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের মুখ্যমন্ত্রী তো বেশ কিছু চুক্তিতে বাধা দিয়েছিলেন। যেমন তিস্তা চুক্তি, যা বাংলাদেশের পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমি এবং আমার দল চায় বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে থাকুক। আর সে জন্য দরকার দিল্লির সহযোগিতা। ভারতের নোট বাতিল ও জিএসটি প্রসঙ্গ আসতেই ড. সিং কড়া ভাষায় নরেন্দ্র মোদি সরকারের সমালোচনা করেন। এদিনও তিনি বলেন, কোনো প্রস্তুতি না নিয়ে নোট বাতিল করে চরম অবিবেচকের মতো কাজ করেছে মোদি সরকার। ভারতের ছোট ও মাঝারি শিল্পকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। অথচ এ ক্ষেত্র থেকেই ভারতের একটা বড় অঙ্কই আসে। আমি আগে যা বলেছিলাম, ভারতের জিডিপি দুই শতাংশের মতো কমে যাবে, ঠিক তেমনই হয়েছে। মোদি সরকার জিএসটি চালু করতে গিয়েও বিস্তর তাড়াহুড়া করেছে। এ দুটি পদক্ষেপের প্রভাব ভারতের অর্থনীতিতে পড়া অনিবার্য ছিল। ঠিক তাই হয়েছে। আবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সে দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগোচ্ছে তা দেখে পৃথিবীর ছোট ছোট দেশগুলোকে ওই পথেই এগোতে হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কার্যত বিভিন্ন দেশকে এ ব্যাপারে দিশা দেখাচ্ছেন। হাসিনার কয়েকজন আর্থিক উপদেষ্টাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাদের কর্মদক্ষতার ওপর আমার আস্থা আছে। যে পথে ঢাকা হাঁটছে, সেটাই সংস্কারের একমাত্র পথ। ভারতের আর্থিক সংস্কারের রূপকার ১৯৯১ সালে নরসিমা রাও মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী হয়ে তিনি যে ঝুঁকি নিয়েছিলেন, তার সুফল ২০০৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ধরে রাখা গেছে। কিন্তু দিল্লি সরকারের বিশেষ হেলদোল আছে বলে মনে হয় না। যদি থাকত, তাহলে এর মধ্যে জিএসটি নিয়ে আসত না। মোদি সরকার দেশের অর্থনীতিকে গুরুত্ব না দিয়ে দল এবং গেরুয়া বাহিনীকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে তা থেকে উঠে আসা খুব সহজ নয়। আমার মনে আছে এই দশকের ২০০৮-০৯ সালে বিশ্বে যখন মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তখন লন্ডনে জি-২০ বৈঠকে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ বিশ্বের তাবৎ নেতা উপস্থিত ছিলেন। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্বাগত জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, এ সম্মেলনে উপস্থিত আছেন আমাদের শিক্ষক ড. মনমোহন সিং। তিনিই আমাদের পথনির্দেশিকা দেবেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বলেছিলেন, আমাদের শিক্ষকের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলার মতো ধৃষ্টতা আমার নেই।  তার কাছেই জানতে চাইব— এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের পথ কী? সম্মেলনের শেষে মনমোহনের দাওয়াই সব দেশই মেনে নিয়েছিল। দিল্লি সফরকালে আমি সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ১০নং রাজা গোপালচারীর মার্গের বাড়িতেও যাই। সেখানে ভারত ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, বর্তমান রোহিঙ্গাসহ বহু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন শেখ হাসিনা। সে দেশের জনগণের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তা কাটিয়ে উঠেছেন।  ভবিষ্যতেও তিনি এ ধরনের সমস্যা কাটিয়ে উঠবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।  

লেখক :  প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর