বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা : গণমাধ্যমও ভালো নেই

ড. শেখ আবদুস সালাম

শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা : গণমাধ্যমও ভালো নেই

সম্প্রতি আমরা কয়েক বন্ধু এবং সহকর্মী মিলে সুন্দরবন দুবলার চরে গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে গাড়িতে করে মাওয়া পার হয়ে মাইক্রোবাসে মোংলা এবং মোংলা থেকে নির্ধারিত লঞ্চযোগে সুন্দরবনের মধ্যদিয়ে বয়ে যাওয়া পশুর নদীর বুক চিরে সেই সমুদ্র মোহনায় দুবলার চরে যাওয়া এবং একইভাবে ঢাকায় ফিরে আসা। এ সময়ে তিন/চার দিন আমরা মোটামুটি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলাম। মোবাইল নেটওয়ার্ক, রেডিও-টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন। এ দিনগুলোতে বিশেষ করে পত্র-পত্রিকা পড়তে না পারায় ব্যক্তিগতভাবে আমার মধ্যে এক অস্বস্তি কাজ করছিল, দৈনন্দিন খবরাখবর জানার তৃষ্ণা ছিল প্রবল।

এ সময়েই আমার নিজ কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে মারামারির ঘটনাটি ঘটেছিল। ঘটনার পর দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে এটি তোলপাড় তুলেছিল। কিন্তু সে খবর আমি জেনেছি তিন/চার দিন পরে। দুবলার চর থেকে ফিরে ঢাকায় পা রেখেই প্রথম শুনেছিলাম এ ঘটনাটি। পরের দিন সকালেই তাই গত কয়েকদিনের পত্রিকা নিয়ে বসেছিলাম ওই দিনগুলোর খবরাখবর জানতে। মাত্র তিন/চার দিনের ওইসব পত্র-পত্রিকার প্রথম এবং শেষ পৃষ্ঠার শিক্ষা বা শিক্ষাঙ্গনবিষয়ক খবরের শিরোনামগুলোর কয়েকটি ছিল এমন— ১. নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে আন্দোলনে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা, ২. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়- প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক বৈষম্য সৃষ্টিকারী প্রশ্ন, ৩. কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ৪. কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়- অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় ১৭ দিন ধরে দফতরে যাচ্ছেন না উপাচার্য, ৫. ঢাবি শিক্ষকদের পাল্টাপাল্টি মানববন্ধন, ৬. কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অনিবার্য কারণে’ ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত, ৭. শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী-পরিবহন শ্রমিক সংঘর্ষ, ৮. নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের গাড়িতে হামলা ইত্যাদি।

এসব বিষয় নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিক (প্রথম আলো, ৭ নভেম্বর ২০১৭) সংবাদ সারাংশ ছেপেছিল এভাবে যে— ‘আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে হাতাহাতির রেশ এখনো কাটেনি। এরই মধ্যে ময়মনসিংহের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের ওপর হামলা করেছে শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য নিয়ে অস্থিরতা চলছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়েও। এর জের ধরে সেখানকার ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আর ছিনতাইকে কেন্দ্র করে সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিক ও স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। পত্রিকার এ চুম্বক খবর থেকে অনুমান করতে বেগ পেতে হয় না যে দেশের শিক্ষাঙ্গন বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে অস্থিরতার লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। শুধু শিক্ষা প্রশাসন নয় খোদ শিক্ষক নেতৃত্বের প্রতি সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা কতটা আস্থা হারাতে শুরু করেছেন তা ১১ নভেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবায়দা নাসরীনের লেখাটি পড়লে উপলব্ধি করা যায়।

বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে আমরা সব সময় দেখে এসেছি শত প্রতিকূলতার মধ্যদিয়েও শিক্ষাঙ্গন এবং গণমাধ্যম রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থাকে এক ধরনের পাহারা দিয়ে রাখে। রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যত্যয় দেখলে এ দুটি জায়গা থেকেই প্রতিবাদ ওঠে, কখনওবা সেখান থেকে প্রতিকারের পথও বাতলে দেওয়া হয়। বলতে দ্বিধা নেই, সেই পরিস্থিতি কেন জানি দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি পুরান ঢাকার আলোচিত বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় প্রকাশিত হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনে বা সমাজে যা ঘটছে তাকে হতাশা, উদ্বেগজনক ও ঐতিহ্য-বিচ্যুত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। একদিকে রাজনীতির নামে কিছুসংখ্যক ছাত্র রাজনীতির যেমন অপচর্চা করছে অন্যদিকে তাদের মধ্যে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আধিপত্য বিস্তারের স্পৃহা, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে টেন্ডার, অনৈতিকভাবে অর্থনৈতিক প্রাপ্তি প্রভৃতিতে জড়িয়ে পড়া ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্যকে সত্যিই ম্লান করে দিচ্ছে। অন্যদিকে শিক্ষকরাও এখন নিজেদের মধ্যে মারামারি করছেন। প্রশাসনে যুক্ত হওয়ার আশায় তদবিরের দৌড়ে পাল্লা দিয়ে অংশ নিয়ে চেয়ারে বসে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছেন, কেউ কেউ জেলে যাচ্ছেন। শিক্ষকদের জন্য এসব বড়ই বেমানান। ছাত্রদের পাশাপাশি শিক্ষকদের মধ্যেও যদি এ ঝোঁক জেঁকে বসে তাহলে দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। ছাত্রই হোক অথবা শিক্ষক হোক, এমনকি যে কোনো নাগরিকের জন্য এ অপবাদে না জড়ানো এবং জড়িয়ে থাকলে সেখান থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসা খুবই জরুরি।

শুধু শিক্ষাঙ্গন নয়, গণমাধ্যমে কাজ করা মানুষেরাও যেন এ সময়ে এসে আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। তাই শিক্ষাঙ্গন ছাড়া সাংবাদিকতা অঙ্গন নিয়েও আজকাল নানা কথা হয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি সার্বিকভাবে এ দুই অঙ্গনের অধিকাংশ মানুষই ওইসব অপবাদ সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত নয়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এতসবের মধ্য থেকেও তারা পেশাগত নীতি-আদর্শের ঝাণ্ডা ঊর্ধ্বে তুলে কাজ করে যাছেন। তবে এ ব্যতিক্রমী অংশের দাপট সমাজে আজ প্রবলভাবে ঢেউ তুলছে।

সাধারণ যেসব শিক্ষক কিংবা গণমাধ্যমকর্মী পেশায় অটল থেকে কাজ করছেন তাদের পথচলা এ সমাজে নিষ্কণ্টক নয়। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিশেষ করে গণমাধ্যমকর্মীরা আজও নানাভাবে নানা দিক থেকে নাজেহাল হচ্ছেন। সম্প্রতি গেটিং অ্যাওয়ে উইথ মার্ডার শিরোনামে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)-এর একটি প্রতিবেদনে দেখেছি— ‘বাংলাদেশে গত এক দশকে সাতজন সাংবাদিক খুন হয়েছেন এবং এসব খুনের ঘটনায় তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। শুধু সাংবাদিক নয়, এদেশে এখন মুক্তমনা লেখক, ব্লগার প্রমুখদের মৌলবাদী ও অপরাধী গোষ্ঠীগুলো তাদের হত্যা পর্যন্ত করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ২০১৩ সালে আহমেদ রাজীব হায়দারের খুনের ঘটনা ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কোনো মামলার রায় কিংবা যথাযথ তদন্ত পর্যন্ত হয়নি। ওই প্রতিবেদন মতে সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়া দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০ম। এ পরিস্থিতিতে একদিকে সাংবাদিক বা মুক্তমনের মানুষদের হত্যা যেমন বন্ধ হওয়া দরকার, পাশাপাশি বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি থেকে রাষ্ট্রকে বেরিয়ে আসাও জরুরি।

বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় দায়িত্বশীলতা আর পেশাদারিত্বের মান নিয়ে অনেকেই এখন প্রশ্ন তোলেন। সাংবাদিককে কেউ কেউ মজা করে সাংঘাতিক বলে আখ্যায়িত করেন। আবার সাংবাদিকদের ওপরও অবিচার কম হয় না। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মানুষেরা যে কেবল হত্যা-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তা নয়। তাদের পেশাগত অবস্থানের দিকেও নজর দিলে দেখা যাবে তারা বহুভাবে ভালো নেই। গণমাধ্যমের মানুষেরা ওপরের চাকচিক্য বজায় রেখে কাজ করছেন, ভিতরে কিন্তু অনেক ফাঁক। তারা পেশায় থেকে কাজ করছেন ঠিকই কিন্তু অনেকের মনে স্বস্তি নেই, পেশার সন্তুষ্টিতে এক বড় ঘাটতি রয়ে গেছে।

সম্প্রতি আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মাস্টার্স থিসিস পাঠ করেছি। এ গবেষণাকর্মে ঢাকায় অবস্থিত সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা, রেডিও, টেলিভিশন সব মিলিয়ে ৪২টি প্রতিষ্ঠানের ২৫০ জন গণমাধ্যমকর্মীর মধ্যে একটি জরিপ চালিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে (১৫টি টেলিভিশনে : ৯০ জন; ১৬টি সংবাদপত্রে : ৯৫ জন; ১০টি অনলাইন নিউজ পোর্টালে : ৫৯ জন; দুটি এফএম রেডিওতে : ১২ জন এবং একটি সংবাদ সংস্থায় : ছয়জন)। এ জরিপে এসব গণমাধ্যমকর্মী (পুরুষ : ৭৫%; মহিলা : ২৪.৮ %) কাছে বিভিন্ন দিক থেকে ৩৫টি প্রশ্ন রাখা হয়েছিল।

এসব প্রশ্নের জবাবে উত্তরদাতাদের মধ্যে মিশ্র মনোভাব লক্ষ্য করা গেছে। তবে অধিকাংশ কাউন্টে পেশাগত ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা তাদের যে মনোভাব প্রকাশ করেছেন, সেখানে অসন্তুষ্টির ছাপ বেশি লক্ষণীয়। সাংবাদিকদের মধ্যে তাদের চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রায় অর্ধেক উত্তরদাতা সন্তুষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন। ৪১.৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন যে, পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে তারা নানাভাবে হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। প্রায় ৪০ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন তারা নিয়ম অনুযায়ী আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পান না। ৫০ শতাংশ সাংবাদিক নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট পান না বলে মত দিয়েছেন। এ গবেষণাটিতে চাকরির নিশ্চয়তার ব্যাপারে সংবাদপত্রে কর্মরত কর্মীরা খানিকটা সন্তোষ প্রকাশ করলেও রেডিও, অনলাইন এবং টেলিভিশনে কর্মরত সাংবাদিকদের মধ্যে যথেষ্ট শঙ্কা রয়ে গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায়, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তুষ্টিই কাজ করছে বেশি।

গণমাধ্যমকর্মীদের কর্মক্ষেত্রে সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির বিষয়টি ছাড়াও পেশাগতভাবে তাদের মধ্যে আজকাল এক ধরনের চাপ তৈরি হচ্ছে। সাংবাদিক খুন হয়ে যাওয়া, গুম হয়ে যাওয়া, ৫৭ ধারার খড়গ মাথায় নিয়ে সাংবাদিকতা করা- এসব পরিস্থিতির কারণে সাংবাদিকদের মধ্যে একরকম সেলফ সেন্সরশিপও কাজ করছে। ফলে তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে সাবধানী হতে গিয়ে তারা সব সময় বস্তুনিষ্ঠভাবে তা প্রকাশ করতে একবারের জায়গায় দুইবার ভাবছেন।

শিক্ষাঙ্গনের ন্যায় সাংবাদিকতা অঙ্গনেও রাজনৈতিক বিভাজন আজ স্পষ্ট। এদের অনেকের পরিচয় এখন রাজনীতিক শিক্ষক কিংবা রাজনীতিক সাংবাদিক হিসেবে। এদের মধ্যে যারা আবার সরকার সমর্থক তাদের নিজেদের মধ্যের কোন্দল এবং প্রাপ্তি ঝোঁক পেশাকে কখনো কখনো কলুষিত করার পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। এখন সময় এসেছে স্ব স্ব পেশার পেশাদারিত্ব রক্ষা করার জন্য সবাইকে সুবিবেচনাপ্রসূত হয়ে এগিয়ে আসা এবং সেভাবে আচরণ করা। 

লেখক : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর