রবিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
অর্থনীতি

হুন্ডিকে ‘না’ বলুন

ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন

হুন্ডিকে ‘না’ বলুন

সাত-আট বছর আগের ঘটনা। সিডনি থেকে আমার এক বাংলাদেশি ছাত্র বাসায় বেড়াতে এসেছে। হঠাৎ দেশ থেকে খবর এলো জরুরি ভিত্তিতে দেশে কিছু টাকা পাঠাতে হবে। নিউক্যাসেলে বসেই ছাত্রটি সিডনির একটা মানি এক্সচেঞ্জের অ্যাকাউন্টে আড়াই হাজার ডলার ট্রান্সফার করে দিল। একই সময়ে দেশে বাড়ি বানানোর জন্য সিডনি থেকে বাবার কাছে একই মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে আঠারো হাজার ডলার পাঠালেন আমার আরেক পরিচিত বাংলাদেশি। দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হলো, দুজনের কারও প্রেরিত অর্থই আর গন্তব্যে পৌঁছেনি। কদিনের মধ্যেই সিডনির বাঙালি কমিউনিটি উত্তপ্ত! কয়েক মিলিয়ন ডলারসহ সেই মানি এক্সচেঞ্জের সবাই সিডনি ছেড়ে লাপাত্তা। পত্রিকায় বড় বড় শিরোনামে খবর ছাপা হলো, কিন্তু কেউই তাদের অর্থ আর ফেরত পায়নি।

এবার গত বছর কোরবানি ঈদের আগের ঘটনা। আবার পত্রিকার শিরোনামে এলো আরেকটি মানি এক্সচেঞ্জের ঘটনা। কাহিনী সেই একই। ঈদের আগে স্বজনের কাছে প্রেরিত অর্থ আবারও আত্মসাৎ, অর্থ প্রেরকদের মাথায় হাত। জানা মতে, অধিকাংশই তাদের প্রেরিত অর্থ আর ফিরে পাননি।

উপরের দুটো ঘটনায় অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি আরেকটি মিল হলো, দুটো ঘটনার নেপথ্য কুশীলবরাই স্থানীয় রাজনৈতিক দলের তথাকথিত নেতা। অর্থাৎ এরা রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থেকেই এসব অপরাধ সংঘটনের সাহস পাচ্ছে। এদের দাপটে নিরীহ অর্থ প্রেরকরা একপ্রকার অসহায়ভাবেই এ অন্যায় মেনে নিচ্ছেন, কোথাও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। মানি এক্সচেঞ্জ এজেন্সির আড়ালে এদের অনেকেই অবৈধ হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সিডনির বাঙালি অধ্যুষিত কয়েকটি এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে অনেকটা প্রকাশ্যেই এরা এদের হুন্ডি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আর সামান্য কটি টাকা বেশি পাওয়ার লোভে পড়ে প্রবাসীদের অনেকেই এদের শরণাপন্ন হন। অবৈধ জেনেও হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ করেন।

প্রতি বছর প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলার অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী আদান-প্রদান হয়, যা সমগ্র পৃথিবীর জিডিপির দুই-পাঁচ শতাংশ। এর মাত্র এক বা দুই শতাংশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি বছর প্রায় সাড়ে চারশ কোটি ডলার অবৈধভাবে লেনদেন হয়। একটি সমীক্ষায় জানা যায়, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ছয় হাজার ২০০ কোটি ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে।

পৃৃথিবীব্যাপীই হুন্ডি ব্যবসা একটা সমস্যা। বিশ্বের সব দেশ বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশসমূহের অর্থনীতির জন্য হুন্ডি ব্যবসা এক ধরনের রক্তক্ষরণ ঘটায়। সাধারণত অবৈধ মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ী, অসৎ রাজনীতিবিদ, সন্ত্রাসী ও জঙ্গিরাই হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেন বেশি করে থাকে। এদের প্রতিহত করার জন্য বিশ্বব্যাপী নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ দেশের সরকারই হুন্ডি ব্যবসার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে সচেষ্ট। বাংলাদেশ সরকারও অবৈধ হুন্ডি ব্যবসার বিরুদ্ধে সোচ্চার। সরকারের পক্ষ থেকে দেশে-বিদেশে হুন্ডির বিপক্ষে সেমিনারসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। দুই বছর আগে সিডনিতে অবৈধ অর্থ লেনদেনের বিপক্ষে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটা সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক হুন্ডির ক্ষতিকর দিক তুলে ধরেছিলেন। বাংলাদেশের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল একটি দেশে এখন প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন। এমতাবস্থায় সচেতন নাগরিক হিসেবে, একজন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশি হিসেবে আমাদেরও বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়নযাত্রায় সহায়তা প্রদান করা উচিত। সপ্তাহান্তের বৈঠকখানার আড্ডায় বসে প্রবাসে আমরা অনেকেই বাংলাদেশের নানান অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে তুলাধোনা করি, সরকারের বিরামহীন সমালোচনায় মেতে উঠি। পাশাপাশি আমরা কি একবারও ভেবে দেখি, একজন প্রবাসী হিসেবে আমরা আমাদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করি? দেশ ছেড়ে চলে এলেই দেশের প্রতি সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বরং বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় সুযোগ এসেছে, আমরা চাইলেই দেশের উন্নয়নে অনায়াসে ভূমিকা রাখতে পারি। কয়েকদিন আগে সিডনিতে হৃদয় নামের এক মধ্যবয়স্ক তরুণের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, গত ২০ বছরে বিভিন্ন সময়ে সব মিলিয়ে তিনি দেশে প্রায় আড়াই কোটি টাকা পাঠিয়েছেন। এর পুরোটাই তিনি ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বৈধপথে পাঠিয়েছেন। কথাগুলো বলার সময় দেখলাম, হৃদয়ের চোখজোড়া এক ধরনের অহংকারে জ্বলজ্বল করছে।

দেশপ্রেমের ভিতরে এক ধরনের অহংকার লুকিয়ে থাকে। আসুন, দেশপ্রেমের অহংকারে অহংকারী হই।

বাংলাদেশকে ভালোবাসি। হুন্ডিকে ‘না’ বলি। আর কে কী করল সেটা নিয়ে সরব হওয়ার পাশাপাশি আমরা যেন আমাদের দায়িত্বটুকু সত্ভাবে পালন করি। বিদেশ থেকে এখন খুব সহজেই দেশে অর্থ প্রেরণ করা যায়। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে, প্রয়োজনে এক্সচেঞ্জ রেটটা বাড়ানো হোক।

লেখক : অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কবি ও চিকিৎসক, বর্তমানে নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর