রবিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আজরাইলের রংপুর চেনা ও মন্ত্রীর ভাঙা বাড়ি

নঈম নিজাম

আজরাইলের রংপুর চেনা ও মন্ত্রীর ভাঙা বাড়ি

সরকারি দলের অনেক সমর্থকের বাস আসমানে, মাটিতে নয়। মাটিতে তারা পা রাখতে চান না। আর চান না বলেই বাস্তবতা মানতে তাদের কষ্ট। রংপুরে সরকারি দলের বিশাল বিপর্যয় একটি বাস্তবতা। অথচ এ নিয়ে কথার ফুলঝুরি চলছে। আসমানে হেঁটে হেঁটে দেওয়া হচ্ছে নিত্যনতুন ব্যাখ্যা। এভাবেই কুমিল্লা ভোটের পর আকাশে হেঁটে বেড়ানো মানুষগুলোর কথা শুনেছিলাম। একজন তো  আমাকে বললেন, কুমিল্লার মানুষগুলো বড় খারাপ। ভাবখানা এমন সারা বাংলাদেশ অপেক্ষা করছে আওয়ামী লীগের জন্য। শুধু দোষ করেছিল কুমিল্লাবাসী। এখন রংপুর নিয়ে কী বলবেন? সেই সময়ে মাটির দিকে তাকালে রংপুরে ভোটের এই বিশাল ব্যবধান হতো না। ভোটে হারজিত থাকবে। কিন্তু ব্যবধান এত হবে কেন? আরে ভাই ভোটাররা একবার কেন্দ্রে প্রবেশ করলে কোন দিকে অবস্থান নেবে কেউ জানে না। কল্পনার জগৎ ছেড়ে বাস্তবে আসুন। ভোটারদের সম্মান করতে শিখুন। তাদের অপমান বন্ধ করুন। এই ভোটাররাই ’৭০ সালে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশ স্বাধীন করার অধিকার দিয়েছিল। এই ভোটাররা জেগে উঠলেই তৈরি হয় নতুন ইতিহাস। আপনার আমার আস্থা থাকুক না থাকুক তাতে কিছু যায় আসে না। আওয়ামী লীগের প্রতি অতি ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে চাটুকারিতা, অবাস্তব কথা বন্ধ করুন। কুমিল্লার ভোটের পর অনেক ব্যাখ্যা শুনেছি। মনে রাখবেন, চাটুকারিতা আর অতি ভালোবাসা কখনই ভালো নয়। বাস্তবতাকে মেনে নিলেই সংকটের নিরসন হয়। কুমিল্লা থেকে শিক্ষা নিলে রংপুরে এ বিপর্যয় হতো না। আওয়ামী লীগ কুমিল্লা থেকে শিক্ষা নেয়নি। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়াই ইতিহাসের শিক্ষা।

বিএনপির একটি গ্রুপ রংপুরের ভোট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেক কথা বলছেন। কী আশ্চর্য সত্যকে আড়াল করাই যেন ওদের রাজনীতি। আমাদের টেলিভিশন ও পত্রিকা থেকে কয়েকজন রিপোর্টারকে পাঠিয়েছিলাম রংপুরে। তাদের সঙ্গে প্রতিদিন আমার কথা হতো। ভোটের দিনও কথা হয় বার বার। জানতে চেয়েছিলাম, ভোট নিরপেক্ষ হচ্ছে তো। শুরু থেকেই সবার এক উত্তর ভোট শতভাগ শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য। উচ্ছ্বাস নিয়ে ভোটাররা কেন্দ্রে আসেন। তারপরও অনেকের প্রশ্ন কেন এই ফলাফল? ব্যাখ্যা অনেক। রংপুর জাতীয় পার্টির রাজধানী। এরশাদ এই রাজধানীতে দাপুটে নেতা। ১৯৯১ সালে রংপুরের মানুষ তাকে পাঁচ আসনে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু রংপুরের সর্বশেষ মেয়র ছিলেন আওয়ামী লীগের ঝন্টু। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে রংপুরে জাতীয় পার্টিকে বাদ দিয়েই আওয়ামী লীগ বেশির ভাগ আসন তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল। এবারও আওয়ামী লীগের আশাবাদ ছিল ঝন্টুকে নিয়ে। আমার কথা হলো, আওয়ামী লীগ হারতেই পারে। কিন্তু ভোটের ব্যবধান এক লাখ কেন? আওয়ামী লীগকে ভাবতে হবে। এ নিয়ে একটি পুরনো গল্প আছে। গল্পটি না বলে পারছি না। এক শোকের বাড়িতে এক তরুণকে চিৎকার করে বেশি কাঁদতে দেখে পড়শিরা প্রশ্ন করল, যিনি মারা গেছেন তিনি তোমার কে হন? জবাবে তরুণটি বলল, দূরসম্পর্কের চাচা! তখন সবাই বলল, দূরের চাচার মৃত্যুতে এত কান্নাকাটি, বাপ মরলে কী করবে? জবাবে তরুণটি বলল, চাচার জন্য কাঁদছি না। আজরাইল বাড়ি চিনে গেল তাই কাঁদছি। আজরাইল একবার বাড়ি চিনলে সহজে ছাড়তে চায় না। বাড়ির চারদিকে ঘোরাফেরা করে। আমি রাজনীতির সঙ্গে গল্পটি মেলাচ্ছি না। তবে বাস্তবতায় ফিরে আসতে হবে সরকারি দল, তাদের সমর্থকদের।

সরকারি দলের পুরনো সমর্থকদের নিয়ে সমস্যা নেই। তারা বাস্তবতা বোঝেন। সমস্যা নবাগত, বহিরাগত আর হাইব্রিডদের নিয়ে। নবাগতরা বড্ড বেশি উৎসাহী। তারা সবকিছুতেই বাস্তবতার বাইরে হাস্যকর ব্যাখ্যা বানান। এই চক্রকে বলছি, দয়া করে বিভ্রান্তি বন্ধ করুন। কারণ কুমিল্লার পর রংপুরের বিপর্যয়। এরপর আরও ভোট আছে। আরও ছয় সিটিতে ভোট হবে। সামনে ঢাকা উত্তর সিটির ভোট। তারপর গাজীপুর। এরপর সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, বরিশালে ভোট। রংপুরের পরাজয়ের কারণ বের করুন। সরফুদ্দিন ঝন্টু বিশাল জনপ্রিয়তা নিয়েই সর্বশেষ মেয়র হয়েছিলেন। গত পাঁচ বছর রংপুর শহরে পরিকল্পিত উন্নয়ন হয়নি। দলের নেতা-কর্মীরা গ্রুপিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ঝন্টুর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে। কর্মীরা ঠিকভাবে কাজ করেননি। সমন্বয়ের অভাব ছিল কুমিল্লার চেয়ে একধাপ বেশি। ভোট হয়েছে নিরপেক্ষ। আর নিরপেক্ষতার অর্থই হলো ক্ষমতাসীনদের জন্য এখন চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া রাজনীতির নিত্যনতুন ঠিকাদাররা রংপুরকে কলুষিত করছেন। ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। হেলিকপ্টার নিয়ে ওড়াউড়ি, নায়িকা, গায়িকা নিয়ে ঘোরাঘুরি রংপুর আওয়ামী লীগ রাজনীতির বারোটা বাজিয়েছিল। এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে সময় লাগবে। তবে রংপুর থেকে শিক্ষা কাজে লাগবে অন্য ভোটগুলোতে। রংপুর দিয়ে ভোট শেষ নয়। শুরু। ছোটবেলায় শুনতাম এই দিন দিন নয়। আরও দিন আছে। এই দিন নিয়ে যাবে সেই দিনের কাছে। সেই দিনের কাছে যাওয়ার আগে প্রস্তুতি নিন। ঘোড়ায় চড়ে ভোট চাওয়ার দিন শেষ। ভোট চাইতে হবে মানুষের কাছে। মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে সাময়িক চলা যায়। দীর্ঘ সময় নয়।

আওয়ামী লীগ মাটি ও মানুষের দল হিসেবে মানুষের হৃদয়ে ছিল, আছে। সর্বশেষ এই দলের একজন মন্ত্রীর মারা যাওয়ার পর তার গ্রামের বাড়ির কাহিনী মানুষের মনে দাগ কেটেছে। সাদামাটা জীবন ছিল। কোনো অহংকার ছিল না। মন্ত্রী, এমপি হয়ে বিত্তবিলাসে নিজেকে ভাসিয়ে দেননি। ছায়েদুল হকের সঙ্গে পরিচয় ২০০১ সালের পর আওয়ামী লীগের এক কঠিন সময়ে। এটিএন বাংলার সংবাদ বিভাগের দায়িত্বে ছিলাম। অন্যদৃষ্টি নামের একটি টকশো যেত আমার প্রযোজনায়। অনুষ্ঠানটি সমন্বয় করতেন মোস্তফা কামাল। এখন বাংলাভিশনে কাজ করেন। মোস্তফা কামাল আমার রুমে নিয়ে আসেন তখনকার দুঃসময়ের এমপি ছায়েদুল হককে। একদম সাদামাটা মানুষ। আমাকে বললেন, আমি তো টিভিতে কথা বলতে পারি না। আমি বললাম, এখন বিএনপির সমালোচনা করার লোক নেই। আপনি প্রবীণ নেতা। পুরনো এমপি। বিএনপির বিপক্ষে লোকও খুঁজে পাই না। কামাল মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে বসে থাকেন। আওয়ামী লীগের লোক পান না। মাঝে মাঝে আসবেন। তিনি কয়েকবার টকশোতে এসেছিলেন আমার অনুরোধে। তারপর এ মানুষটির সঙ্গে আর যোগাযোগ ছিল না।

বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই রাজনীতিতে প্রবেশ ছায়েদুল হকের। সাদামাটা মানুষ ছিলেন। মন্ত্রী, এমপি ছিলেন। কিন্তু বাণিজ্য করেননি। গাড়ি, বাড়ির দিকে নজর দেননি। চলে যাওয়ার পর মানুষ তার সম্পর্কে নতুন করে জানল। তার বাড়িটি ছিল টিনের ঘর। এখানেই তিনি থাকতেন। এ কারণেই সাধারণ মানুষের নেতা ছিলেন। বিত্তবৈভব নয়, মানুষের হৃদয় জয় করার প্রতিযোগিতায় ছিলেন এই নেতা। তার মতোই ছিলেন জয়নাল আবেদীন ভূইয়া। কাছ থেকে তাকে দেখেছি। বার বার এমপি ছিলেন। তার গাড়ি ছিল না। বাড়ি ছিল না। গ্রামের বাড়িতে গেলে ভাইদের টিনের ঘরে বসতেন। ঘুমাতেন হাটবাজারে। কর্মীদের বাড়িতে। আমাদের বাড়িতেও থেকেছেন। আমি তার সঙ্গে নাঙ্গলকোটের আনাচে-কানাচে ঘুরেছি। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনকার মতো উন্নত ছিল না। একবার সারা দিন ঘুরে আমরা এক বাড়িতে খেয়ে মধ্যরাতে হাজির হলাম এক বাজারে। জয়নাল ভাইকে বললাম, চলেন কারও বাড়িতে যাই রাতে থাকার জন্য। তিনি বললেন, বাজারে এই দোকানের পেছনে তিনটা চৌকি রাখা আছে। তুমি আর বাচ্চু মিয়া দুটোতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আমি পরে আসছি। গিয়ে শুয়ে পড়তেই সারা দিনের ক্লান্তিতে ঘুম এসে গেল। গভীর ঘুম। সকালে লোকজন নাশতা নিয়ে ঘুম ভাঙালো আমাদের। আহারে আওয়ামী লীগে এমন নেতা কি এখন আছেন? এখন সবাই রাজনীতি করে সুবিধার জন্য। আর দেশে এখন আওয়ামী লীগারেরও অভাব নেই। বিএনপি, জামায়াতের অনেক নেতাকেও দেখি এখন আওয়ামী লীগ সাজতে। সেদিন এক ত্যাগী আওয়ামী পরিবারের সন্তান বললেন, ওমুক ভাইকে চেনেন? আমাদের দলের পরীক্ষিত নেতা। আমি বললাম, হুম। চিনি। অনেক ত্যাগী। একবারও বললাম না, তার বাপ দাদা, চাচা চৌদ্দগুষ্টি সারা জীবন ছিল আওয়ামী লীগ বিরোধী। মুসলিম লীগ পরে বিএনপি। আর তিনি ব্যবসা করেছেন হাওয়া ভবনের সঙ্গে। বিএনপি থেকে নেওয়া তার দৃশ্যমান ব্যবসাগুলো এখনো আছে। বড় আজব দেশে বাস করি।

আসলে বাস্তবতা নিয়ে কথা বলেও লাভ নেই। কারণ রাজনীতি অনেকের কাছে এখন লাভজনক ব্যবসা। আর সুবিধাবাদী, মধুলোভী ব্যবসায়ীদের বড় অংশও জড়িয়ে পড়ছেন রাজনীতিতে। আগে যাদের পেশা ছিল রাজনীতি তারাও এখন মন্ত্রী, এমপি হয়ে পেশা বদল করেছেন। তারাও এখন আর রাজনীতিবিদ লেখেন না। এখন পেশা হিসেবে লেখেন রাজনীতি। মন্ত্রী-এমপি হওয়ার পর এখন সবাই ব্যবসায় নজর দেন। ব্যাংক, বীমা, জাহাজ, বিদ্যুৎ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ নতুন নতুন ব্যবসা গড়েন। আর পুরনো ব্যবসায়ীরাও রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। রাজনীতি চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের কাছে। আর ব্যবসা যাচ্ছে রাজনীতিবিদদের কাছে। দেশের অর্থনীতির নতুন মেরুকরণ। খারাপ না। আগে রাজনীতিবিদরা ব্যবসা নিতেন বন্ধু-বান্ধব আর দূরের আত্মীয়ের নামে। এখনকার মন্ত্রী-এমপিরা কোনো লুকোচুরি খেলেন না। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন নিজের নামে। রাজনীতি এখন বড়ই জটিল। এখানে সততা নিষ্ঠার অবস্থান নেই। দক্ষতা ও মেধার গুরুত্ব নেই। রাজনীতির হিসাব-নিকাশ বদলে গেছে। আমরা এক নতুন গোলকধাঁধায় প্রবেশ করেছি। এই গোলকধাঁধা থেকে কীভাবে বের হব জানি না। কারণ সর্বনাশা রাজনীতির খেলায় দুঃসময়ের মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।  আত্মঅহমিকায় থাকা রাজনীতিবিদদের ত্যাগী দুঃসময়ের কর্মী পছন্দ নয়।  তাদের পছন্দ চাটুকার। এই চাটুকাররা যে দলই করুক না কেন, তাদের কাছে আদর্শ বড় নয়। চাটুকারিতাই বড় বিষয়।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর