রবিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঘরের ভিতর মাছের চাষ

শাইখ সিরাজ

ঘরের ভিতর মাছের চাষ

বাংলাদেশের মাছ চাষে সাফল্য সার্বিক উৎপাদন খাতে এক বিশাল অর্জন। একটা সময় ছিল গ্রামের পুকুরগুলো ব্যবহার হতো শুধু গোসল ও কাপড়-চোপড় ধোয়ার জন্য। সেখানে প্রাকৃতিকভাবে কিছু মাছ হতো। বড় গৃহস্থের বাড়িতে সারা বছরের মাছের চাহিদা পূরণ হতো বাড়ির পুকুর থেকে। সেখানে প্রাকৃতিকভাবেই বছর বছর মাছের প্রজনন হতো। ওই পুকুর ছিল নিত্যকার বিশুদ্ধ পানির উৎসও।  রান্নাবান্নার কাজেও পুকুরের পানি ব্যবহার হতো। এখন তেমন পুকুর নেই। কিন্তু দেশে অজস্র অগণিত পুকুরে চলছে মাছ চাষ। বিরাট বিরাট জলাশয়ের মতো পুকুরে উৎপাদিত হচ্ছে হাজার হাজার টন মাছ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী সারা বিশ্বে মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। এই মাছ চাষের জোয়ারকে বলা যেতে পারে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জোয়ার। অন্যদিকে এক রুপালি বিপ্লব। আজকের গ্রামীণ জনপদে আর্থ-সামাজিক যে পরিবর্তনগুলো সূচিত হয়েছে তার পেছনে কৃষির বহুমুখী বৈচিত্র্যের পাশাপাশি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান মাছ চাষের।

এখন এক জমি থেকে কীভাবে বছরে চারটি বা তারও বেশি ফসল তোলা যায় সেই চেষ্টা চলছে। তার পাশাপাশি ঢুকে গেছে সর্বাধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি। অর্থাৎ গ্রিন হাউসে সারা বছর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে মাটি ছাড়াই হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে কোনো ফসলেরই কোনো মৌসুম প্রয়োজন নেই। বাজার চাহিদা বিবেচনা করে সবজিসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে। এক টুকরো জমিতে কীভাবে ঊর্ধ্বমুখী বিস্তার (Vertical expansion) করা যায়, সেই প্রয়াস চলছে উন্নতবিশ্বে। তারই ধারাবাহিকতা চলে এসেছে আমাদের দেশেও। দুই-তিন বছর ধরে কৃষিতে চলছে এই পরিবর্তন। বড় বড় উদ্যোক্তা গ্রিন হাউস কৃষিতে যাচ্ছেন। বোঝা যায় আগামী এক দশকে খুব বড় পরিবর্তন আমরা দেখতে পাব। ঠিক একই পরিবর্তনের বাতাস লেগেছে মাছ চাষের ক্ষেত্রেও। ‘ইনডোর ফিশ ফার্মিং’ বা ঘরোয়া মাছ চাষ শুরু হয়ে গেছে। দেশে প্রথম এ পদ্ধতির মাছ চাষে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে সায়েন্স ল্যাবরেটরি বা বিসিএসআইআর।

দুই হাজার বর্গফুটের একটি ঘর মোটা টিনের তৈরি। সেই ঘরের মধ্যেই স্থাপন করা হয়েছে আরেকটি ঘর। যেখানে ১১টি পানির ট্যাংকে ঘরোয়া মাছ চাষের বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। এক একটি ট্যাংকে রয়েছে তিন হাজার লিটার পানি। যা প্রতিনিয়ত রিসার্কুলেটেড সিস্টেমে পরিবর্তন হচ্ছে। সঠিক পুষ্টি ও অক্সিজেন পেয়ে বড় হচ্ছে তেলাপিয়া, পাবদা, গুলশা, কই, মাগুর, শিং, বাইমসহ বেশ কয়েক রকমের মাছ। খুব অল্প জায়গায় ঘরোয়া পরিবেশে মাছ চাষের এ পদ্ধতিটি ইতিমধ্যেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বিশ্বের অনেক স্থানে। পুকুরের চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশি মাছ উৎপাদন, রিসার্কুলেটেড অ্যাকুয়াকালচার সিস্টেমের বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে এশিয়ার থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, জাপান ও চীনসহ ইউরোপীয় কয়েকটি দেশেও এখন মাছ উৎপাদনে এ পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের দেশেও এ প্রযুক্তিটি নিয়ে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ বিসিএসআইআর ২০১৫ সাল থেকে কাজ করছে। বলা যেতে পারে, মাছ চাষের প্রচলিত হিসাবই পাল্টে দিচ্ছে আধুনিক এ প্রযুক্তি।

বলে রাখি, এই চাষ কার্যক্রম ছোট বা মাঝারি খামারিদের জন্য নয়। মোটামুটি বেশ টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। বিসিএসআইআরের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানালেন, সম্পূর্ণ ১১টি ট্যাংকের সেটআপ নিতে বিনিয়োগ করতে হবে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। এই বিনিয়োগ ১০ বছরের জন্য। বিদ্যুতের লাইন লাগবে নয় কিলোওয়াটের দুই ফেস। আর মাসিক বিল সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকার মতো আসতে পারে বলে জানালেন রেজাউল করিম। তিনি জানালেন, প্রতি কেজি পাবদা মাছের উৎপাদন খরচ ১৮০ টাকা। বাজারে প্রতি কেজি পাবদা মাছের বিক্রয়মূল্য ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। অবশ্য, বিনিয়োগকারীরা এই টাকা অল্প দিনে তুলে নিতে পারবেন বলেও জানালেন রেজাউল করিম।

আবদ্ধ ঘরের ট্যাংকগুলোই মাছের বিচরণ ক্ষেত্র। সেখানেই তাদের স্বাস্থ্যকর বেড়ে ওঠার পরিবেশ। দেখলাম ট্যাংকের ভিতরই প্রাণশক্তিতে ভরপুর মাছের লাফ-ঝাঁপ! পাবদা ও তেলাপিয়ার ওজনই বলে দেয় পদ্ধতিটি মাছের বেড়ে ওঠার জন্য কতটা উপযোগী। রিসার্কুলেটেড একুয়াকালচার পদ্ধতিতে মাছ চাষ মানেই একই পানি বার বার শোধন করে ব্যবহার করা। প্রতিবার শোধনের পর পানিতে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে অক্সিজেন ও পরিমাণ মতো তৈরি খাদ্য। এগুলো সময়মতো মাছ পাচ্ছে বলে প্রাকৃতিক উৎস থেকে গ্রহণ করা পুষ্টির চেয়ে এটি অধিক কার্যকর। এ পদ্ধতিতে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণও খুব নিয়ন্ত্রিত, এতে মাছের খাদ্য গ্রহণের চাহিদাও থাকে বেশি। ফলে এ প্রক্রিয়ায় মাছ খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়, জানালেন সেখানে কর্মরত বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা দেবব্রত কর্মকার। 

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রেজাউল করিমের গবেষণা অনুযায়ী, এই পদ্ধতিতে পানিতে অক্সিজেন লেভেল ৮-এর উপরে রাখা হয়। FCR অর্থাৎ Feed Conversion and Performance  থাকে ১.২ লেভেলে। এতে এক কেজি খাবার খেয়ে এক কেজি ৪০০ গ্রাম মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে। যেখানে সাধারণত পুকুরে দুই কেজি খাবারে মাত্র এক কেজি মাছ উৎপাদন সম্ভব হয়। এ পদ্ধতিতে মাছ উৎপাদন করতে লোকবলও লাগে কম। মাত্র দুজনকে নিয়েই এমন একটা প্রজেক্ট চালানো সম্ভব। মাত্র ১০০০ লিটার পানির ঘনত্বে ১০০ কেজি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে এখানে। যেখানে পুকুরে এই পরিমাণ পানিতে মাত্র ১০ থেকে ২০ কেজি মাছ উৎপাদন করা যায়। এ ছাড়াও এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত মাছ সুস্বাদু, এন্টিবায়োটিক ফ্রি ও রাসায়নিক মুক্ত হওয়ায় ভোক্তাদের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হতে পারে। মত্স্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করলে বিনিয়োগকারীদের লোকসানের আশঙ্কা থাকে না। অন্যদিকে নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট ওজনে এবং নির্দিষ্ট পরিমাণে মাছ উৎপাদনে নিশ্চয়তা থাকে এখানে। পাশাপাশি বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার ঝুঁকিও থাকছে না। থাকছে না বড় কোনো রোগ বালাইয়ে মাছের মড়ক লাগার মতো ভয়াবহ আশঙ্কাও।

বিজ্ঞানীরা এও বলছেন, এ পদ্ধতিতে মাছ চাষের একটি আদর্শ আকারের ঘর বা মিনি আরএসএস প্লান্টের কারিগরি সহায়তা তারা দিচ্ছেন। যেখানে ৯০ হাজার লিটার ধারণক্ষতাসম্পন্ন একটি পানির ট্যাংকে মাছ চাষ করে মাত্র দেড় থেকে দুই বছরেই অধিক লাভ ঘরে আনা সম্ভব। তবে প্রশ্ন হলো, গ্রামীণ সাধারণ মাছ চাষি কিংবা উদ্যোক্তাদের কাছে মাছ চাষের এ পদ্ধতিটি কতটা সহজলভ্য? বিসিএসআইআরের চেয়ারম্যান মো. ফারুক আহমেদ জানালেন, দেশীয় প্রযুক্তির সঙ্গে বিদেশি প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে কমমূল্যে উদ্যোক্তাদের কাছে পদ্ধতিটি পৌঁছে দিতে কাজ করছেন তারা।

যুগের সঙ্গে গোটা কৃষি ব্যবস্থাই পাল্টে যাচ্ছে। মাঠ কৃষি যেমন চলে যাচ্ছে গ্রিন হাউসে এর ধারাবাহিকতায় এর আগে বিসিএসআইআর-ই নিয়ে এসেছে গ্রিন হাউসে হাইড্রোপনিক ঘাস উৎপাদনের কার্যকর ব্যবস্থা। এখন তারা প্রাকৃতিক পুকুর ছাড়াও মাছ উৎপাদনের এ পদ্ধতির খোঁজ জানাচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশের কয়েকজন মাছ চাষ উদ্যোক্তা অনুসরণ করেছেন এ পদ্ধতি।  ঘরোয়া মাছ চাষ পদ্ধতির সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হচ্ছে, বছরের পর বছর মাছ চাষের কারণে পুকুরের তলায় জমা ময়লা নিষ্কাশনের ঝামেলাও নেই, বরং সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত ও স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে অনেক বেশি মাছ উৎপাদনের এক আধুনিকতম ব্যবস্থা।  যা আমাদের সামনে উন্মোচন করতে পারে মাছ চাষের আরেক হিসাব।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

            [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর