রবিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

অসুস্থ ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশীকে বাঁচান

কাওসার বেগম

অসুস্থ ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশীকে বাঁচান

বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস সুদীর্ঘ ও বর্ণিল। শোষণ-বঞ্চনা নিপীড়নের নীরব-সরব অচলায়তনের বিরুদ্ধে বারবারই বাঙালিকে রুখে দাঁড়াতে হয়েছে। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল এ জাতির সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল একটি মাইলফলক। এ যুদ্ধ, দুটি বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত একটি সশস্ত্র সংগ্রাম মাত্র ছিল না, বরং ছিল একটি সর্বাত্মক গণযুদ্ধ। মুক্ত স্বদেশ এবং ক্ষুধা দারিদ্র্য ও বৈষম্যহীন ন্যায়ভিত্তিক একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলার আপামর জনসাধারণ এতে নিজেদের যুক্ত করেছে।

দীর্ঘ ৪৬ বছর পর ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণে বসে বার বার আমার মমতাময়ী রত্নগর্ভা মায়ের কথা, বাবার অনুপ্রেরণা ও সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের কথা মনে পড়ছে। তাদের অবদান অক্ষয় হয়ে থাকবে আমাদের জীবনের পাতায় যা চিরকাল উদ্বুদ্ধ করবে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যটি টিকিয়ে রাখতে। মনে পড়ে সেই ১৯৬০-৬২ সাল থেকে এদেশের মানুষের স্বাধিকার আন্দোলনে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী আইয়ুবের তখতে তাউস কাঁপানো বড় ভাই ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর সেই অনলবর্ষী বক্তৃতার কণ্ঠস্বর। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ ‘ডাকসুর’ সহ-সভাপতি (১৯৬৬-৬৭) ও তৎকালীন অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি (১৯৬৭-৬৮) হিসেবে সেদিনের ছাত্র/যুবসমাজকে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের ঐতিহাসিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তার আপসহীন ও দূরদর্শী নেতৃত্বে ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনীত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে অভিহিত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল এবং সেই মামলা প্রত্যাহারে আইয়ুব সরকার বাধ্য হয়েছিল। এসব কারণে বছরের পর বছর তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন, এমনকি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও রাজবন্দী হিসেবে একসঙ্গে কারাবাসে সময় কাটিয়েছেন। মনে পড়ে কেবল মায়ের চোখের জলে নামাজের বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকার করুণ দৃশ্য। তেমনি মেজ ভাই সাবের আহমদ আসগারীর ১৯৬৬-৬৮ সালে চট্টগ্রামে ছয়দফা আন্দোলন-হরতালের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কারা নির্যাতন ভোগের স্মৃতি। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। ১৯৬৯-৭২ সালে অবিভক্ত চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনের কমান্ডার মরহুম শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বাধীন যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রশিক্ষণ শেষে দেশের ভিতরে যুদ্ধে প্রেরণের ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের শেষভাগে তথা চূড়ান্ত পর্যায়ে চট্টগ্রামের সাত সদস্যের আঞ্চলিক কমান্ডের একজন জোনাল কমান্ডার হিসেবে মিরেরসরাই, সীতাকুণ্ড এবং সন্দ্বীপের দায়িত্ব পালন করেন। বড় ভাইও তার বিপুল সংখ্যক সহকর্মী নিয়ে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। এ সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধের মুখপাত্র ‘দেশবাংলা’ পত্রিকা মুজিবনগর থেকে প্রকাশ করেন। বলাবাহুল্য, এটিই মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র ছিল। এই পত্রিকা আগরতলায় প্রচারণার সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন সেজো ভাই ড. জাফর আহমদ হানাফী। বাংলাদেশে এই পত্রিকার ঝুঁকিপূর্ণ বিলি বণ্টনের দায়িত্বে ছিলেন ছোট ভাই প্রফেসর নোমান আহমদ সিদ্দিকী। ছোট ভাই ড. বাকের আহমদ সিদ্দিকী ত্রিপুরার হরিণা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭১-এর এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে ভারতের তানদুয়া দেরাদুন মিলিটারি একাডেমি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে তিনি গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণ নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ফ্রন্টে সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে আমরা তিন বোনও অংশ নিয়েছি চিকিৎসাকর্মী হিসেবে। আগরতলার একটি হাসপাতালে মেডিকেল ট্রেনিং নিয়ে জিবি ও বিএম হাসপাতালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সুস্থ করে যুদ্ধে পাঠানোর দায়িত্ব পালন করেছি আমরা। আমাদের ভাই-বোনদের সবাই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় আমার বাবাকে নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হতে হয় রাজাকারদের হাতে। ভাইয়েরা সবাই ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় বিশেষত ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী সাবেক ডাকসু ভিপিসহ দেশের শীর্ষ স্থানীয় ছাত্রনেতা হওয়ায় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ভাইদের খোঁজে চট্টগ্রাম ও ফেনী সর্বত্র তল্লাশি চালায়।  আমার বাবাকে ফেনী রেলওয়ে স্টেশনে ঝুলিয়ে তার ওপর নারকীয় নির্যাতন চালানো হয়। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ পুনর্গঠনে ও ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর লেখনীর অন্ত ছিল না। বর্তমানে হঠাৎ স্ট্রোক করে প্যারালাইজড অবস্থায় আছেন, অর্থের অভাবে উন্নত চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে না।

দেশের স্বাধিকার ও মুক্তিসংগ্রামে অনন্য ভূমিকা পালনকারী ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর সুচিকিৎসা তথা জীবন রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার এগিয়ে আসবে আমরা এমন আবেদনই রাখছি। 

            লেখক : মুক্তিযোদ্ধা।

সর্বশেষ খবর