শিরোনাম
শনিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

ইসলামে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব

মাওলানা মো. মিজানুর রহমান, সিনিয়র পেশ ইমাম : বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

আল্লাহতায়ালার এক বিশেষ নিয়ামত ও পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার নাম ইসলাম। এতে মানব জীবনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের যাবতীয় বিষয়ের সমাধানে হিকমতপূর্ণ বিধানের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। আল কোরআন আল্লাহর নির্ধারিত ফরজ ইবাদত সম্পন্ন করার পর জীবিকা অন্বেষণে জমিনে ছড়িয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছে। রসুল (সা.) নিজের শ্রমলব্ধ উপার্জনকে সর্বোত্তম উপার্জন বলে আখ্যায়িত করেছেন। এমন উপার্জনকে ইসলাম অবৈধ ঘোষণা করেছে, যাতে প্রতারণা, মিথ্যা, ধোঁকাবাজি, জনসাধারণের অকল্যাণ সর্বোপরি জুলুম রয়েছে। দুনিয়ার জীবনে অবৈধ পন্থায় উপার্জন করে সুখ-স্বচ্ছন্দ লাভ করলেও পরকালীন জীবনে রয়েছে এর জন্য জবাবদিহিতা ও কঠিন বিচার।

মানুষ কীভাবে উপার্জন করবে ও কোন পন্থায় তা ব্যয় করবে এবং উপার্জনের ক্ষেত্রে যাবতীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ইসলামে। ব্যক্তির উপার্জিত সম্পদে তিনি (আল্লাহ) জাকাত ফরজ করেছেন, যেন সম্পদ একশ্রেণির লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। নামাজের পাশাপাশি জাকাতের কথা ৮২ বার কোরআনে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ নামাজ সমাপনান্তে জীবিকা নির্বাহের জন্য কোরআনে গুরুত্বারোপ করেছেন : ‘নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করতে হবে, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সূরা জুমা : ১০)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে কুরতুবিতে ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘যখন নামাজ শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা ব্যবসায়িক কাজকর্ম ও অন্যান্য পার্থিব প্রয়োজন পূরণে বেরিয়ে পড়।’ ব্যক্তিজীবনে স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যাপারে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এমনিভাবে উৎসাহিত করেছেন যে, ভিক্ষাবৃত্তিকে তিনি নিন্দা করেছেন। জুবাইর ইবনে আউয়াম (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ তার রশি নিয়ে চলে যাক, পিঠে কাঠের বোঝা বহন করে এনে বিক্রি করুক এবং তার চেহারাকে আল্লাহর আজাব থেকে বাঁচিয়ে রাখুক। এটা তার জন্য মানুষের কাছে ভিক্ষা করা, চাই তাকে দান করুক বা না করুক— তার চেয়ে উত্তম।’ (মুসলিম)।

রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বদা মানুষের কাছে চেয়ে বেড়ায় সে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় আগমন করবে যে, তার মুখমণ্ডলে এক টুকরা গোশতও থাকবে না।’ (মুসলিম)। ইসলাম নিজ হাতে উপার্জনকে সর্বোত্তম হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। হজরত রাফে ইবনে খাদিজ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, সর্বোত্তম উপার্জন কোনটি? তার জবাবে তিনি বলেন, ব্যক্তির নিজস্ব শ্রমলব্ধ উপার্জন ও সততার ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয়। (মুসনাদে আহমাদ)। সব নবী-রসুলের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাঁরা নিজ হাতে কর্ম সম্পাদনকে অধিক পছন্দ করতেন। আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রাথমিক জীবনে ছাগল চরানো ও পরবর্তীতে খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসায়িক দায়িত্ব পালনের বর্ণনা পাওয়া যায়, যা নিজ হাতে জীবিকা নির্বাহের উত্কৃষ্ট প্রমাণ বহন করে। হালাল উপায়ে উপার্জন করা ইসলামে মৌলিক ইবাদত; যা ফরজ কাজ হিসেবে স্বীকৃত। এই মর্মে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘ফরজ আদায়ের পর হালাল পন্থায় উপার্জনও ফরজ।’ (বায়হাকি)।

উপার্জনের ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য সবচেয়ে বড় মাধ্যম। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি একটি মহত্ পেশা। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’ (সূরা বাকারা : ২৭৫)। রসুল (সা.) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘তোমরা ব্যবসা-বাণিজ্য কর, কারণ তাতেই নিহিত রয়েছে নয়-দশমাংশ জীবিকা।’ (ইয়াহিয়া উনুমদ্দিন)। তা ছাড়া সততা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা, ধোঁকামুক্ত, কল্যাণমুখী মানসিকতাসম্পন্ন। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘সত্ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যবসায়ী পরকালে নবী, সিদ্দিকিন ও আল্লাহর পথে জীবন বিসর্জনকারী শহীদদের সঙ্গী হবে।’ (তিরমিজি)। ব্যবসা-বাণিজ্যর ক্ষেত্রে ইসলাম যেসব মূলনীতি দিয়েছে তা হলো, ধোঁকা ও প্রতারণামুক্ত, মিথ্যার আশ্রয়বিহীন, ভালো পণ্যের সঙ্গে খারাপ পণ্যের মিশ্রণ না করা, মজুদদারি চিন্তা-চেতনা পোষণ না করা, ওজনে হেরফের না করা, সর্বোপরি যাবতীয় প্রতারণা থেকে বিরত থাকা।

ুচাকরি জীবিকা-নির্বাহের বড় একটি মাধ্যম। সরকারি-আধাসরকারি, বেসরকারি, ব্যাংক-বীমা, এনজিও এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মানুষ চাকরি করে। এসব চাকরির ক্ষেত্রে ইসলামের মূল দর্শন হলো, প্রত্যেক চাকরিজীবী তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পূর্ণ নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে পালন করবে। রসুল (স.) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই এক একজন দায়িত্বশীল। তোমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (বুখারি)।

কৃষিকর্ম জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যম। কৃষিকর্মের সূচনা আদি পিতা হজরত আদম (আ.) থেকেই। তাঁকে কৃষিকর্ম, উৎপাদনে ব্যবহার ও কুটিরশিল্প শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের অধিকাংশ লোক কৃষির ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে। অথচ ইসলামের কৃষিনীতি সম্পর্কে অবগত হয়ে যদি কেউ তার এই ব্যবস্থাপনায় ইসলামী নীতি অনুসরণ করে, তবেই তা হালাল উপার্জন হবে।

ইসলামে মানুষের অর্থসম্পদ লাভের তিনটি নৈতিক পন্থা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তা হলো— ১. পরিশ্রম ২. উত্তরাধিকার ৩. হেবা বা দান।

উপার্জন বৈধ হওয়ার ইসলামী মূলনীতি : ইসলামে উপার্জনের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় দুটি মূলনীতি রয়েছে। যা উপার্জন করা হবে তা মূলগতভাবে হালাল হতে হবে। আল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন, ‘হে মানুষ! পৃথিবীতে হালাল ও তাইয়েব যা রয়েছে তা থেকে আহার কর। আর শয়তানের পথ অনুসরণ কর না। নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সূরা বাকারা : ১৬৮)।

সর্বশেষ খবর