শুক্রবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

সাধনায় মেলে জান্নাত

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

সাধনায় মেলে জান্নাত

দার্শনিকরা বলেন, ‘সত্যই সুন্দর, সুন্দরই সত্য’। তবে সত্যের পথ সবসময় সুন্দর হয় না। সহজ হয় না। এটি বলেছেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দার্শনিক মুহাম্মদ (সা.)। তিনি বলেছেন, ‘অনিন্দ্য সুন্দর জান্নাতের পথে আছে কাঁটা বিছানো।  আর চির-নোংরা অশান্তির আবাস জাহান্নামের পথে রয়েছে ফুল ছড়ানো।’ অর্থাৎ, সুন্দর জান্নাতের পথে এগোতে হবে অসুন্দর-নিরানন্দের সঙ্গে লড়াই করে। আর জাহান্নামের পথে যেতে চাইলে কোনো লড়াই কিংবা সাধনার প্রয়োজন নেই। ভোগ-বিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলেই অনায়াসে পৌঁছে যেতে পারবেন জাহান্নামের অতল তলে। তাই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাত অর্জন করতে হয় সাধনা করে। আর জাহান্নাম পাওয়া যায় খুব সহজেই।’

চিরশান্তির আবাস জান্নাতকে ঘিরে রেখেছে দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, হাজারো ব্যথা-বেদনা। তাই তো জান্নাতের পথের যাত্রী যারা, তাদের জীবনেও আনন্দের চেয়ে বেদনা, হাসির চেয়ে কান্নাই বেশি দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ আমাদের নবীজি (সা.)-এর কথাই বলতে পারি। বলতে পারি তাঁর প্রিয় সঙ্গী-সাথীদের কথাও। যুগে যুগে যারাই খোদার প্রিয় বান্দা হওয়ার সাধনা করেছেন, সাধনা করেছেন জান্নাতের উত্তরাধিকার হতে, তাদের জীবনেই ‘কষ্ট’ এসেছে পরশ পাথর হয়ে। যেন কষ্টের ছোঁয়াই তারা খ্রিস্টের মর্যাদা লাভ করেছেন প্রভুর কাছে। প্রভু যেমন যিশু খ্রিস্ট তথা ঈসা মসিহ (আ.)-কে নিজের কুদরত ও শক্তির নিদর্শন বানিয়ে নিয়েছেন, তেমনি কষ্টের স্পর্শে ধন্য আত্মাগুলোকেও তিনি নিজের প্রেমিক বলে গ্রহণ করেছেন। সুফিদের ভাষায় একেই বলে আশেক-মাশুকের খেলা। এ বড় জটিল খেলা। বড় মধুর খেলা।

বলছিলাম, জান্নাতের পথ কষ্টে ঘেরা। অন্যদিকে জাহান্নামের পথে আছে সুখের ভেলা। দুনিয়ায় যখন কাউকে সুখের ভেলায় ভাসতে দেখি তখন আমাদের মনে হয়, সেই বুঝি ঠিক করছে। খোদার পথে চলে, হালালের পথে থেকে কষ্ট-যন্ত্রণা ছাড়া কী জুটল পোড়া কপালে। তার চেয়ে মিথ্যার সঙ্গে মিশে গিয়ে কিছু দিন আনন্দ করে নিলেই ভালো হতো। এরকম ভাবনাও মানুষ ভাবে। মানুষ অর্থাৎ আমি আপনি, আমরাই এসব ভাবি। আমার আপনার এ ভাবনা কি আসলেই সঠিক? আসুন কোরআনের পরশ পাথরে যাচাই করে নিই আমাদের ভাবনাটি। ‘ওয়াদ্বদুহা। ওয়াললাইলি ইজা সাজা। মা ওয়াদ্দাআকা রাব্বুকা ওয়ামা কালা। ওয়ালাল আখিরাতু খায়রুল্লাকা মিনাল উলা।

অর্থ : ‘দুপুরের রোদ্রোজ্বল দিনের শপথ। নিকষ আঁধারে ঢেকে যাওয়া রাতের শপথ। সত্যের পথে, সুন্দরের পথে চলার পরও যে দুঃখ-বেদনা তোমাকে ঘিরে রেখেছে তার মানে এই নয় যে, তোমার প্রেমময় প্রভু তোমায় ভুলে আছেন কিংবা তোমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন। আসলে তোমার প্রভুর ইচ্ছা তোমাকে শেষ প্রতিদানের দিন অঢেল দেবেন। যা প্রথমের চেয়ে অনেক উত্তম এবং সুখকর হবে।’ (সূরা দোহা : ১-৪)।

আল্লাহপাকের ইচ্ছা, তিনি আমাদের শেষ প্রতিদান ভালো দেবেন। তাই এখন পরীক্ষা নিচ্ছেন, আমরা সেই প্রতিদানের উপযুক্ত কিনা। আমরা সবর ও শোকরের জিন্দেগি যাপন করি কিনা এ জন্যই পরীক্ষা। এই পরীক্ষার অনেক হেকমতের মধ্যে বড় হেকমত হলো, যখন আমরা সুখের সাগরে ভাসতে থাকব তখন পাপীরাও দুঃখের আগুনে পুড়তে থাকবে। তখন আমরা তাদের দেখে মজা নেব যেমন তারা এখন আমাদের দেখে মজা নিচ্ছে। কোরআনের ভাষায়— ‘ইন্নাল্লাজিনা আজরামু কানু মিনাল্লাজিনা আমানু ইয়াদহাকুন। ওয়া ইজা মাররু বিহিম ইয়াতাগামাজুন। অপরাধীরা মুমিনদের সোনামাখা দুঃখের জীবন দেখে হাসি-ঠাট্টা করত। তারা একে অপরের প্রতি ইশারা-ইঙ্গিত করেও মজা লুটত।’ ‘ফালইয়াও মাল্লাজিনা আমনু মিনাল কুফফারি ইয়াদ্বহাকুন। আলাল আরাইকি ইয়ানজুরুন। আর আজ মুমিনরা কাফেরদের শোচনীয় অবস্থা দেখে হাসি-ঠাট্টা করবে। স্বর্ণখচিত সিংহাসনে বসে একজন আরেকজনকে দেখিয়ে মজা নেবে।’ (সূরা মুতাফফিফিন : ২৯-৩০ এবং ৩৪-৩৫)।

তাই হে আল্লাহর প্রিয় মুমিন ভাই! খোদার পরীক্ষাকে সহজভাবে নিন। প্রেমকে সম্বল করে পরীক্ষার পথে এগিয়ে চলুন। দুঃখ-কষ্টকে খোদার প্রিয় দান মনে করে হাসিমুখে বরণ করে নিন। বিশ্বাস রাখুন, এই কষ্টের বিনিময়েই সেদিন আপনি চিরশান্তি, চির আনন্দময় জান্নাত লাভ করবেন। সে ওয়াদাই করেছেন খোদাতায়ালা কালামে পাকে।

ইরশাদ হচ্ছে, ‘ইন্নালিল মুত্তাকিনা ইন্দা রাব্বিহিম জান্নাতুন নায়িম। আফানাজআলুল মুসলিমিনা কাল মুজরিমিন। মালাকুম কায়ফা তাহকুমুন? দুনিয়ার মনুষ কান খাড়া করে শুনে রেখ! আমার মুত্তাকি বান্দাদের জন্যই আমি অনাবিল শান্তির ঘর জান্নাত বানিয়ে রেখেছি। তোমরা ভেবেছ কী- পাপী আর আল্লাহ ভীরুদের পরিণাম একই হবে? যে সারা জীবন পাপের সাগরে ডুবে ছিল আর যে সংযমের আগুনে পুড়েছিল দুজনের প্রতিদান-পরিণাম এক হবে? তোমাদের বিবেক কী বলে? এটা তোমাদের কেমন বিচার বলো হে মানুষ?’ (সূরা কলম : ৩৪-৩৬)।  আল্লাহ আমাদের সবাইকে পরীক্ষার মোকাবিলায় সবর ও শোকরের জীন্দেগি যাপনের তৌফিক দিন।  সবশেষে আমাদের পরিণতি সুন্দর ও আনন্দময় করে দিন।  অনাবিল শান্তির আবাস জান্নাতের উত্তরাধিকারী হওয়ার তৌফিক দিন। আমিন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

চেয়ারম্যান : বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি।

www.selimazadi.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর