শুক্রবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

গণতন্ত্র ও দেশ-জাতির উন্নয়ন

আলাউদ্দিন মল্লিক

কেন কিছু দেশ ধনী, বাকিরা গরিব। কেন কিছু দেশের জীবনযাপন প্রণালি উন্নত ও আকর্ষণীয়? সেখানে সব দেশের, সব জাতের সব ধর্মের মানুষ যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। কেনই-বা কিছু দেশ অনুন্নত আর পিছিয়ে পড়া। কেন কিছু দেশে আইনের শাসন আর অন্যত্র শাসকগোষ্ঠী দ্বারা নিষ্পেষিত। কেন কিছু দেশে ভিন্ন মত আর চিন্তা টিকে থাকে। আর অন্যত্র তা হয় নিষ্পেষিত; অন্তত অবহেলিত। পৃথিবীর বহু বিজ্ঞ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়িয়েছেন। ২০১২ সালে দুজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এসিমগলু ও রবিনসন যখন ‘কেন রাষ্ট্রসমূহ ব্যর্থ? ক্ষমতা, উন্নতি ও দারিদ্র্যের উৎস’ প্রকাশ করলেন তখন পৃথিবী উপরের প্রশ্নগুলোর জুৎসই সমাধান পেল। ধনী ও উন্নত দেশগুলোর কী এমন বিশেষ বৈশিষ্ট্য আমরা দেখি? কেউ বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কথা। কেউবা দীর্ঘকালের সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করেন। কেউ বলেন ধর্মের কথা। আবার অনেকে অতীতের সমৃদ্ধির বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। আসলে কি তাই? সপ্তদশ শতকে শিল্প-বিপ্লবের আগে ব্রিটেন কী সমৃদ্ধতম দেশ ছিল? অথবা ফ্রান্স, কিংবা ইতালি? এর ঐতিহাসিক এবং একমাত্র উত্তরটা হলো— ‘না’। ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে শিল্পবিপ্লব শুরুর সময় ব্রিটেনের উল্লেখযোগ্য কোনো উপনিবেশ ছিল না। শিল্প-বিপ্লবের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে ব্রিটেন ইউরোপ তথা সারা পৃথিবীতে প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করে। এমনকি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে শত বর্ষব্যাপী যুদ্ধের জয়লাভও এই বিপ্লবের ফসল। অবশ্য বিদ্যমান ও পরবর্তীতে জয় করা উপনিবেশগুলো প্রথমে ব্রিটেনের শিল্পের কাঁচামাল জোগান দিয়েছে, আর পরে বড় একটি মার্কেটে পরিণত হয়েছে। তাহলে সুইজারল্যান্ড যে বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম উন্নত দেশ—তার সমৃদ্ধির মূলে কী? সেটা কি উপনিবেশ না অন্য কিছু? এমনকি গত শতাব্দীজুড়ে উন্নতি করা জাপান—যে দুটি বিশ্বযুদ্ধের পরাজয়ের কারণে বিজয়ী শক্তির চাপিয়ে দেওয়া নানা বিধি-নিষেধ সংযুক্ত কোমরভাঙা অর্থনীতি নিয়ে ১৯৫০ দশকে যাত্রা শুরু করে মাত্র ৩০ বছরের মধ্যে শুধু এশিয়ার নয়, সারা বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। কিংবা সিঙ্গাপুর? তার তো না ছিল ভূমি, না ছিল খনি। একমাত্র সমুদ্রবন্দর নিয়ে মাত্র ৩০ বছরের মধ্যে উন্নতি লাভ করেছে। এরকম অনেক উদাহরণ টানা যাবে। এসিমগলু ও রবিনসন অনেকগুলো দেশের এবং এলাকার তুলনামূলক বিশ্লেষণ দেখিয়েছেন। বইটি পাঠে আমাদের ধারণা আরও সমৃদ্ধ করবে। সমস্ত উন্নত দেশের দিকে তাকালে কতগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এগুলো নিম্নরূপ : (১) এসব দেশ বিশেষ কোনো অতীত সভ্যতার কারণে উন্নতি লাভ করেনি; (২) এ দেশগুলোর মধ্যকার সংস্কৃতির নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড বা সাধারণ কোনো মিলগত বৈশিষ্ট্য নেই। যেমন—কর্মঠ জাতি বা স্বভাবগত অধীনস্থতা ইত্যাদি। আমেরিকা ছিল সুযোগসন্ধানীদের স্বর্গরাজ্য। আর সিঙ্গাপুর ছিল চরম নৈরাজ্যকর একটি সমুদ্রবন্দর, যেখানে বহু দেশের বিভিন্ন সংস্কৃৃতির ও ধর্মের লোকজনের আনাগোনা ছিল; (৩) এসব দেশ কোনো একটি ধর্মমতকে ঊর্ধ্বে না তুলে ধরে সব ধর্মকেই আশ্রয় দিয়েছে; (৪) এ দেশগুলো তার পরিচালনার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মের মধ্যে ও জনগণের অংশগ্রহণমূলকভাবে গড়ে তুলেছে এবং পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বিকশিত করে চলেছে ও (৫) এ দেশগুলোর বেশির ভাগ কোনো অসাধারণ নেতৃত্ব দ্বারা গঠিত হয়নি, এমনকি শাসিতও হয়নি। উপরের বিষয়গুলোর বিপরীতে কিছু দেশ দেখা যায়, যারা উন্নয়নের উজ্জ্বল চিত্র নিয়ে আমাদের সময়ে বিরাজ করছে। এসিমগলু আর রবিনসনের মতে, এগুলো স্থায়িত্বশীল নয়। আমরা এখানে চীনকে উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারি। অনেকের মতে চীনে বর্তমান শাসন ব্যবস্থা না থাকলে এই উন্নয়ন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা তর্ক সাপেক্ষ। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন-পরবর্তী অভিজ্ঞতা আমাদের সেই প্রশ্ন করার অধিকার দেয়। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত হতে আমরা উন্নত দেশগুলোর সাফল্য ও তা ধরে রাখার ক্ষেত্রে কতকগুলো প্রয়োজনীয় সাধারণ উপাদান নির্ণয় করতে পারি। সেগুলো হলো—(১) সমাজের উন্মুক্ততা, যা যে কোনো বিষয় বা জিনিসকে প্রত্যাখ্যানের আগে যাচাই করবে; (২) সৃজনশীল কর্মযজ্ঞকে স্বাগত জানানো ও সহায়তা প্রদান। কারণ, এভাবেই নতুন নতুন আবিষ্কার, প্রযুক্তি ও তত্ত্ব সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়; (৩) সমাজে বহু মত ও ধর্মের অবস্থান নিশ্চিতকরণ। কারণ, এককেন্দ্রিকতা তা সে মতবাদের হোক বা ধর্মের সমাজকে দুর্বল করে; (৪) সর্বত্র গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং সঙ্গে জনগণের সাবলীল অংশগ্রহণ; (৫) আইনের শাসন নিশ্চিতকরণ; (৬) দেশ পরিচালনা প্রতিষ্ঠানগুলো গণতন্ত্রীকরণ এবং জনগণের সহজপ্রাপ্যতা ও ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ ও (৭) নতুন ও তরুণ নেতৃত্বের জন্য যথেষ্ট স্থান রাখা এবং তরুণ নেতৃত্বকে স্বাগত জানানো। একটি বিষয় বর্তমান ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল যুগে নির্দ্বিধায় বলা যায়, কোনো পরিবর্তন, তা সে উন্নত দেশ বা অনুন্নত দেশ, যেখানেই হোক না কেন, তার জন্য গোছানো বড় কোনো সংগঠন বা বিশাল কোনো নেতৃত্বের প্রয়োজন নেই। মিসরের ক্ষমতা পরিবর্তনকারী আরব বসন্তের নেতৃত্বদানকারী ওয়ায়েল খালিল একজন ইন্টারনেট ব্লগার ছিলেন। তার ব্লগে পোস্ট করা ১২ দফার ওপর ভিত্তি করে মিসরীয়রা তাহিরি স্কোয়ারে সমবেত হয়ে বিক্ষোভের মাধ্যমে ৩০ বছরের অধিক ক্ষমতায় থাকা হোসনি মোবারককে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করেন। আবার এ দেশের শাহবাগের আন্দোলনও উদাহরণ হতে পারে। দেশের মানুষের কাছে অপরিচিত ব্লগাররা নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করেছে (যদিও সঠিক দিক-নির্দেশনার অভাবে আন্দোলনটি কাঙ্ক্ষিত সফলতা পায়নি)। সে জন্য বলা যায়, বর্তমান শাসনতান্ত্রিক অচলায়তন অবসানে যে কোনো দিক থেকে যে কোনো সময় বড় ধরনের ঢেউ সৃষ্টি হতে পারে।  এখন প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য সময়োপযোগী বুদ্ধিবৃত্তিক ক্যাম্পেইন।

            লেখক : অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক শাসন বিষয়ে গবেষক।

সর্বশেষ খবর