মঙ্গলবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

প্রশ্ন ফাঁস রোধ করা যাবে কীভাবে

বাহালুল মজনুন চুন্নু

প্রশ্ন ফাঁস রোধ করা যাবে কীভাবে

বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রশ্ন ফাঁস। এটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর চরম কুঠারাঘাত। এর কারণে শিক্ষাব্যবস্থার সব ইতিবাচক অর্জন বিনষ্ট হতে চলেছে। এ প্রশ্ন ফাঁস আজ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন পাওয়া যাচ্ছে এবং তা মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগ-ব্যবস্থাসহ অন্য অনেক মাধ্যমে। অনেকে আবার ঘোষণা দিয়ে প্রশ্ন ফাঁস করছে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা, এসএসসি, এইচএসসি, বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের যে মহামারী শুরু হয়েছে তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এর ফলে শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞানের মূল্যায়ন করা যাচ্ছে না। লেখাপড়ার প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে। হতাশা বাসা বাঁধছে সর্বত্র। প্রশ্ন ফাঁসের ধরন দেখে মনে হচ্ছে ফাঁসকারীদের কাছে অর্থ মুখ্য নয়। তারা চায় অন্য কোনো কিছু। তা হতে পারে সরকারকে বিতর্কিত করা। তা হতে পারে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়ে দেশকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে নিমজ্জিত করা। বর্তমান সরকার দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে গেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও অর্জিত হয়েছে অনেক সাফল্য। এমডিজির লক্ষ্য পূরণ, ঝরেপড়া রোধ, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, শিক্ষার সংখ্যাগত ও গুণগত মান বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষাঙ্গনের অবকাঠামোগত ও পরিবেশগত উন্নয়ন, বই উৎসব ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষার আলো যখন বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে ঠিক তখনই প্রশ্ন ফাঁসের মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই আজ হুমকির মুখে পড়ে গেছে। শিক্ষায় সরকারের অর্জিত সাফল্যকে কালিমা লেপন করতেই যে দুষ্টচক্র প্রশ্ন ফাঁসের মতো জাতিবিনাশী জঘন্য ঘটনা ঘটাচ্ছে তা বোধগম্য।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রশ্ন ফাঁস রোধে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কঠোর নজরদারি, কেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে মোবাইল ফোন সেট পেলে গ্রেফতার, ইন্টারনেটের গতি কমানো, এমনকি প্রশ্ন ফাঁসকারীকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। সৃজনশীল প্রশ্নের সংখ্যা বৃদ্ধি, এমসিকিউ উঠিয়ে দেওয়ারও চিন্তাভাবনা করছে। কিন্তু এগুলো স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। এবারের এসএসসি পরীক্ষার প্রায় প্রতিটি বিষয়েরই প্রশ্ন যেভাবে ফাঁস হয়েছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে প্রশ্ন ফাঁসকারী দুষ্টচক্র অনেক শক্তিশালী, অনেক আটঘাট বেঁধেই মাঠে নেমেছে। এদের ধরতে হবে। পত্রিকায় দেখলাম কিশোর-কিশোরীদের মোবাইলে প্রশ্নপত্র পাওয়ায় তাদেরও ধরা হচ্ছে। ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় করে কোনো লাভ হবে না। পালের গোদাদের ধরতে হবে। কারা মূলত প্রশ্নপত্র ফাঁস করে চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদেরই ধরতে হবে। পাবলিক পরীক্ষা আইন, ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর চার নম্বর ধারায় প্রশ্ন ফাঁসকারীদের সর্বনিম্ন তিন বছর, সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান আছে। কিন্তু এ আইনের আওতায় শাস্তি পাওয়ার নজির তেমন একটা দেখা যায় না। প্রশ্ন ফাঁসের পর তদন্ত কমিটি হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগ প্রমাণিত হয় না। অপরাধীরা পার পেয়ে যায় বার বার। আর ধরা পড়লেও দেখা যায় জামিনে মুক্তি পেয়ে আবারও তারা কুকর্মে জড়িত হয়। প্রশ্ন ফাঁস জাতিবিনাশী কর্মকাণ্ড। তাই এদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কয়েকজনের যদি কঠোর শাস্তি হয় এবং আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে না যেতে পারে তবে অন্যরা এ কুকর্ম করার দুঃসাহস দেখাবে না। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও সরবরাহের সঙ্গে জড়িতদের কেউ এর সঙ্গে জড়িত কিনা তা কঠোরভাবে নজরদারি করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড, বিজি প্রেসসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সবাই যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এমনটা কিন্তু নয়। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো স্তরের কারও মধ্যে দেশবিনাশী চিন্তা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। এবং তা অসম্ভবও নয়। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন, কম্পিউটার কম্পোজ, মুদ্রণ, সংরক্ষণ, বিতরণের প্রতিটি ক্ষেত্রে গোপন ক্যামেরা ব্যবহারসহ প্রাযুক্তিক আরও নানামুখী পদক্ষেপ জোরদার করতে হবে। কোচিং সেন্টারগুলোর ওপরও নজরদারি আরও বৃদ্ধি করতে হবে।

প্রযুক্তিকে ব্যবহার করেই মূলত প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে হ্যাকিং থেকে শুরু করে আরও নানা সফটওয়্যার ব্যবহার করে নিরাপত্তাবলয় ভেঙে ফেলা যায়। কম্পিউটার কম্পোজকৃত ফাইল ডিলিটই নয়, পুরো কম্পিউটার ফরম্যাট করে ফেললেও সে ফাইল পুনরুদ্ধার করা যায়। একই সার্ভারের সুবিধা নিয়েও কারসাজি করা যায়। এ বিষয়টির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। প্রেস থেকে ছাপানোর সময়ও প্রাযুক্তিক সুবিধা নিয়ে কারসাজি করতে পারে দুর্বৃত্তরা। প্রেসে অনেক নজরদারি থাকলেও কোনো মাইক্রো ক্যামেরা কিংবা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের উপস্থিতি ধরা যায় না এমন কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে কিনা তা দেখতে হবে। প্যাকেজিং, কনজারভেশন, ডিস্ট্রিবিউশন— সব ক্ষেত্রেই প্রাযুক্তিক তত্ত্বাবধান আরও বৃদ্ধি করতে হবে। কেবল সিসি ক্যামেরাই নয়, এর সঙ্গে হিডেন ক্যামেরাসহ নিরাপত্তাবিষয়ক অতি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে এবং সিসি ক্যামেরার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের প্রতিও নজরদারি বাড়াতে হবে। প্রযুক্তিকেই ব্যবহার করে আমাদের প্রশ্ন ফাঁস রোধ করতে হবে। অনলাইন প্রশ্নব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। অনেক সেট প্রশ্ন করা হবে। প্রতিটি সেটের জন্য আলাদা পাসওয়ার্ড থাকবে। পরীক্ষার ঘণ্টা দুয়েক আগে দৈবচয়নের ভিত্তিতে প্রশ্নের সেট নির্ধারণ করে প্রতিটি কেন্দ্রে ওই সেটের পাসওয়ার্ড জানিয়ে দিলে কেন্দ্র ব্যবস্থাপক সেখান থেকেই প্রশ্ন প্রিন্ট করতে পারেন। কোনো ক্ষেত্রে তিন সহস্রাধিকের বেশি শিক্ষার্থী থাকে না। তাই ভালো দুই থেকে তিনটি প্রিন্টার দিয়ে আধা ঘণ্টার মধ্যেই এই পরিমাণ প্রশ্ন প্রিন্ট করা সম্ভব। ম্যাক নাম্বারসংবলিত ল্যাপটপ দিয়ে ইন্টারনেটের অন্য কোনো পেজ ব্রাউজ করা সম্ভব নয়, তাই প্রশ্নপত্র অন্যত্র ফরোয়ার্ড করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষার জন্য যতগুলো কেন্দ্র থাকবে সব কেন্দ্রের থেকে একটি কক্ষ নির্ধারণ করে সেখানেই প্রশ্ন সংগ্রহ, প্রিন্ট, প্যাকেজিং করতে হবে এবং সেটার ভিতর ও বাইরে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে সব কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে হবে। নির্ধারিত কক্ষ ছাড়া কেন্দ্রের আশপাশে নেটওয়ার্ক জ্যামিং করে ফেলতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় যেসব অসুবিধা হতে পারে সেগুলো প্রযুক্তিবিদদের দিয়ে বিশ্লেষণ করিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এ ছাড়া অনেক সেট প্রশ্ন করে শিক্ষার্থীদের একেকজনকে একেকটি সেটে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে কোন পরীক্ষার্থীর হাতে কোন সেট প্রশ্ন পড়বে তা অনিশ্চিত হওয়ায় কোনোভাবে যদি দু-এক সেট প্রশ্ন ফাঁসও হয় শিক্ষার্থীদের তা নিয়ে তেমন আগ্রহ থাকবে না। এমনকি পরীক্ষার আগে সব সেট প্রশ্ন ফাঁস হলেও সেগুলোর সমাধান করে পরীক্ষায় বসার মতো সময় তাদের থাকবে না। ফলে প্রশ্ন ফাঁসকারীদের উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। অনেক সেট প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে দেশের সব শিক্ষা বোর্ডের জন্য অভিন্ন সিলেবাসের ভিত্তিতে অভিন্ন প্রশ্নপত্রের সেট তৈরি করা যেতে পারে। আরেকটি বিষয় হলো, একই দিনে দুটি বিষয়ের পরীক্ষা নিয়ে দ্রুততম সময়ে পাবলিক পরীক্ষা সম্পন্ন করে ফেলতে হবে। তাহলে যদি কোনোভাবে প্রশ্ন ফাঁসও হয়, তবুও অনেক সেট ও সময়ের অভাবে শিক্ষার্থীরা সেগুলোর বিষয়ে আগ্রহ দেখাবে না। আরেকটি বিষয় হলো পরীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিদর্শক থেকে শুরু করে পিয়ন, আয়া ও পরীক্ষার্থীদের সব রকম ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে পরীক্ষার হলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে।

প্রশ্ন ফাঁসের কারণে আমাদের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও নীতি বিসর্জন দেওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। লেখাপড়ার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হচ্ছে। যার পরিণতিতে আমরা ক্রমে ভঙ্গুর ও নৈরাজ্যমূলক সমাজব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছি। ভাবলেই শিউরে উঠি যখন দেখি অভিভাবকরা ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্র পাওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তারা ভাবছেন না এতে তারা তাদের সন্তানদের ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণেই এমনটা হচ্ছে। সহপাঠীরা ফাঁসকৃত প্রশ্ন পেয়ে গেছে নিজের সন্তান না পেলে পরীক্ষায় অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়বে— এই মানসিকতাও এর জন্য অনেকটা দায়ী। এর একটা কারণ হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা জ্ঞানভিত্তিক না হয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় এত পাবলিক পরীক্ষা নেই। এত পাবলিক পরীক্ষার দরকার আছে কিনা সেই বিষয়টিও ভেবে দেখার সময় হয়েছে। বহুনির্বাচনী প্রশ্ন বাদ দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। বহু নির্বাচনী ছাড়া আরও অনেক ধরনের প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞান মূল্যায়ন করা যায়। তবে সেসব প্রশ্নও যদি ফাঁস হয়ে যায় তাহলে বহুনির্বাচনী প্রশ্ন বাদ দেওয়ার যৌক্তিকতা থাকে না। ফেসবুক বা অন্য কোনো সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া, ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেওয়া, কোচিং বন্ধ করে দেওয়া, কারও মোবাইলে প্রশ্ন পেলে তাকে গ্রেফতার করা এগুলো তো সব বিস্তরণ পর্যায়ের অংশ। এগুলোর চেয়ে সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রশ্ন ফাঁসকারী মূল হোতাদের খুঁজে বের করা। প্রয়োজনে সর্বোচ্চ গোয়েন্দা তৎপরতা চালাতে হবে। মূল উপড়ে ফেললে লতাপাতা টিকবে না। অস্বীকারের প্রবণতা ত্যাগ করে সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায় সেদিকেই সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায়ভার প্রযুক্তির ওপর না চাপিয়ে বরং অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলেই রোধ করা সম্ভব হবে প্রশ্ন ফাঁসের মতো নিকৃষ্ট ঘৃণ্য ঘটনা। প্রশ্ন ফাঁসজনিত যে মহাসমস্যা দেখা দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই এর দায় এড়াতে পারে না। কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতা সরকারকে বিব্রত করছে। তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত আবেগিক ও বাকোয়াজ ধরনের কথাবার্তা বন্ধ করে কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।

 

লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

সর্বশেষ খবর