শুক্রবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধু

তোফায়েল আহমেদ

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধু

প্রতি বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি দিনটি গভীরভাবে স্মরণ করি। এ দিনটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। ১৯৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি ইতিহাসের মহামানব জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। প্রিয় নেতা তাঁর যৌবনের প্রায় ১৪টি মূল্যবান বছর পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছেন। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে যে নেতা প্রিয় মাতৃভূমি বাংলার ছবি হৃদয় দিয়ে এঁকেছিলেন, ফাঁসির মঞ্চে  দাঁড়িয়ে হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন, সেই নেতাকে সেদিন জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তিনি শুধু বাঙালি জাতিরই মহান নেতা ছিলেন না, সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদের হতে হবে। সেই লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে ’৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ এবং ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারপর সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথে নেতৃত্ব দিয়ে মহান বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন।

আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কালপর্বটি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ‘ড্রেস রিহার্সেল’। জাতির মুক্তিসনদ ছয় দফা দেওয়ার অপরাধে বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ সর্বমোট ৩৫ জনকে ফাঁসি দেওয়ার লক্ষ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করা হয় এবং নির্বিঘ্নে পুনরায় ক্ষমতায় আরোহণের এক ঘৃণ্য মনোবাসনা চরিতার্থে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান। আগরতলা মামলার বিচার যখন শুরু হয় তখন আমরা উপলব্ধি করি, বঙ্গবন্ধুকে যদি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয় তাহলে চিরদিনের জন্য বাঙালি জাতির কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যাবে। তখন ঊনসত্তরের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডাকসু’ কার্যালয়ে আমার সভাপতিত্বে এবং চার ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন এবং ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি ১১ দফা ঘোষণা করি।

১৭ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জমায়েত অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় এবং পূর্ব ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়। ঊনসত্তরের ১৭ জানুয়ারি যে আন্দোলন আমরা শুরু করেছিলাম, ২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদের রক্তাক্ত জামা হাতে নিয়ে যে শপথ নিয়েছিলাম, ২৪ জানুয়ারি মতিউর-মকবুল-রুস্তম-আলমগীরের রক্তের মধ্য দিয়ে সেই আন্দোলন সর্বব্যাপী গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছিল। ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে শপথ দিবসে স্লোগান দিয়েছিলাম ‘শপথ নিলাম শপথ নিলাম মুজিব তোমায় মুক্ত করব; শপথ নিলাম শপথ নিলাম মা-গো তোমায় মুক্ত করব।’ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করে সান্ধ্য আইন জারি করা হলে সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল করি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সেনারা বেয়নেট চার্জে নির্মমভাবে হত্যা করে পুনরায় সান্ধ্য আইন জারি করলে যথারীতি আমরা সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখি। ২০ ফেব্রুয়ারি সমগ্র ঢাকা নগরীকে মশাল আর মিছিলের নগরীতে পরিণত করলে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে পল্টনের মহাসমুদ্রে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম প্রদান করি। সমগ্র দেশ গণবিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়। জনরোষের ভয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান সব রাজবন্দীকে বিনা শর্তে মুক্তি দিলে দেশজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। প্রিয় নেতাকে কারামুক্ত করার মধ্য দিয়ে শপথ দিবসের স্লোগানের প্রথম অংশ ‘মুজিব তোমায় মুক্ত করব’ এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে হাতিয়ার তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদার মুক্ত করে স্লোগানের দ্বিতীয় অংশ ‘মা-গো তোমায় মুক্ত করব’ বাস্তবায়ন করি।

বস্তুত, ’৬৬-এর ৮ মে’র গভীর রাতে ছয় দফা কর্মসূচি প্রদানের অভিযোগে দেশরক্ষা আইনে যে মুজিব গ্রেফতার হয়েছিলেন, ৩৩ মাস পর ঊনসত্তরের ২২ ফেব্রুয়ারি যে মুজিব মুক্তিলাভ করেন, নাম বিচারে এক হলেও বাস্তবে ওই দুই মুজিবের মধ্যে ছিল গুণগত ফারাক। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি ছিল সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য অগ্নিপরীক্ষার মতো। সেই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ফাঁসিকাষ্ঠের বন্দীদশা থেকে মুক্ত মহামানব হয়ে বেরিয়ে আসেন। ২২ তারিখ আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই, আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে আমরা সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানাব। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়।

শুরুতেই বলেছি এ দিনটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান যারা দেখেননি তাদের বলে বোঝানো যাবে না সেই জনসমাবেশের কথা। আমরা যখন সেখানে পৌঁছি, তখন রেসকোর্স ময়দানে মানুষ আর মানুষ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রেন, বাস, ট্রাক, লঞ্চ-স্টিমার বোঝাই হয়ে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, কৃষক-শ্রমিক, সাধারণ মানুষ ছুটে এসেছে। ঢাকার মানুষ তো আছেই। অভিভূত হয়ে পড়লাম। এর আগে এতবড় জনসভা দেখিনি। এটা জনসভা না, জনসমুদ্র। সেই জনসমুদ্রে লাখ লাখ লোক এসেছে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে একনজর দেখতে। প্রিয় নেতাকে নিয়ে আমরা মঞ্চে উঠলাম। তখন একটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল, আমি প্রতিটি সভায় সভাপতিত্ব করতাম এবং সভা পরিচালনা করতাম। কে বক্তৃতা করবে সেই নামটিও ঘোষণা করতাম। সেদিন ওই মঞ্চে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রেখেছিলেন। চিরাচরিত প্রথা ভঙ্গ করে আগেই সভাপতির ভাষণ দেওয়ার জন্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে লাখ লাখ মানুষকে অনুরোধ জানিয়ে বলেছিলাম, ‘সবার শেষে বক্তৃতা করার কথা থাকলেও আপনাদের অনুমতি নিয়ে আমি আগেই বক্তৃতা করতে চাই।’ ১০ লাখ লোকের সম্মতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আগেই বক্তৃতা করি। আমার জীবনে এই বক্তৃতাটির কথা চিরদিন মনে থাকবে। সেদিন যে ভালোবাসা মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি, তা বলে বোঝাতে পারব না। বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে বলেছিলাম, ‘প্রিয় নেতা তোমার কাছে আমরা ঋণী, বাঙালি জাতি চিরঋণী। এই ঋণ কোনো দিনই শোধ করতে পারব না। সারা জীবন এই ঋণের বোঝা আমাদের বয়ে চলতে হবে। আজ এই ঋণের বোঝাটা একটু হালকা করতে চাই জাতির পক্ষ থেকে তোমাকে একটা উপাধি দিয়ে।’ ১০ লাখ লোক ২০ লাখ হাত তুলে সম্মতি জানিয়েছিল। তখনই ঘোষিত হয়েছিল, ‘যে নেতা তাঁর জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন সেই নেতাকে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হলো।’ ১০ লাখ লোক তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে এ প্রস্তাব গ্রহণ করে প্রিয় নেতাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে লাখ লাখ কণ্ঠে ধ্বনি তুলেছিল, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’। বাংলাদেশে অনেক আন্দোলন হয়েছে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের মানুষ মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য জীবন দিয়েছে। একেকটি আন্দোলনের একেক রকম চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের বৈশিষ্ট্য এমন ছিল যে, তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বিচারের কাজ চলছিল। বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’ তথা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে ’৬৮-এর ১৯ জুন বিচারের কাজ শুরু হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোর জন্য আইয়ুব খান পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। আইয়ুব খানের তথ্য সচিব আলতাফ গওহর ‘আইয়ুব খান’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। সেই বইয়ে উল্লেখ আছে কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের শহীদদের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ সেই ষড়যন্ত্রের প্রচেষ্টাকে সমাধিস্থ করে এবং আসাদ-মতিউর-মকবুল-রুস্তম-আলমগীর-সার্জেন্ট জহুরুল হক-ড. শামসুজ্জোহার জীবনের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্দোলন সফল হয়। জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকে নারায়ণগঞ্জের এক জনসভায় যে দম্ভোক্তি করে আইয়ুব খান বলেছিলেন তিনি আবার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হবেন। অথচ ১৭ জানুয়ারি আন্দোলন শুরু হলো, ২০ জানুয়ারি আসাদ শহীদ হলো, ২৪ জানুয়ারি শহীদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হলে সর্বব্যাপী গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হলে, সেই আইয়ুব খান একদিন পরই বলেছিলেন, ‘আমি আর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব না।’ তার মানে কত বড় আন্দোলন হতে পারে! একটি আন্দোলন সাত দিনের মধ্যে গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে, ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে! এর তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। যখন প্রতিবছর ২০ জানুয়ারি আসাদের মৃত্যুবার্ষিকী ফিরে আসে, তখন ‘শহীদ আসাদ ফাউন্ডেশন’ স্মরণসভা করে। শহীদ মতিউরের স্কুল নবকুমার ইনস্টিটিউট শহীদ মতিউর স্মরণসভা ও ২৪ জানুয়ারি ‘গণঅভ্যুত্থান দিবস’ পালন করে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের অন্যতম শহীদ ড. শামসুজ্জোহা, যিনি সেদিন প্রিয় ছাত্রদের রক্ষার্থে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলি বুক পেতে গ্রহণ করে শহীদী মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন, আগেই মরণোত্তর ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত হয়েছেন; এবার শহীদ আমানউল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, শহীদ মতিউর রহমান মল্লিক এবং শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হককে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদানের সিদ্ধান্ত সরকার গ্রহণ করেছে। সেদিন জাতীয় জাদুঘর পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সেখানে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উল্লেখযোগ্য আলোকচিত্র বা সংবাদপত্র খুঁজে পাইনি। যে কারণে মনের মধ্যে প্রচণ্ড দুঃখবোধ তৈরি হয়। যে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমি রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আজ এ অবস্থানে এসেছি, যাদের রক্ত ঋণে গোটা জাতি ঋণী, তাদের কীভাবে আমরা সম্মান-শ্রদ্ধা জানাব? আমার জন্মস্থান ভোলার বাংলাবাজারে ‘স্বাধীনতা জাদুঘর’ নামে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছি। সেখানে যদি কেউ প্রবেশ করেন দেখবেন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অগ্নিযুগের বিপ্লবী ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলনে শহীদ বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সেথায় স্থান পেয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। এ বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন। তিনি বিশ্ববরেণ্য মহান নেতা ছিলেন। তাঁর কোনো তুলনা হয় না। তিনি জন্মেছিলেন এ মাটিতে আমাদেরই স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য। তিনি যদি না জন্মাতেন আমরা আজও পাকিস্তানের দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ থাকতাম। সেই মহান নেতা তাঁর জীবদ্দশায় এ দিনগুলোতে শহীদদের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতেন। ছয় দফা আন্দোলন না হলে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান হতো না। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান না হলে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে পারতাম না। বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্ত না হলে সত্তরের নির্বাচনে পাকিস্তানে আমরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারতাম না। আর পাকিস্তানে যদি আমরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারতাম, তাহলে নয় মাস যুদ্ধ করে এ দেশ স্বাধীন করতে পারতাম না। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্রসমাজের যে ভূমিকা তা গৌরবোজ্জ্বল। সেদিনের তুমুল গণআন্দোলন সংঘটিত করতে যে ১০ জন ছাত্রনেতা— আবদুর রউফ (প্রয়াত), খালেদ মোহাম্মদ আলী, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক (প্রয়াত), সামসুদ্দোহা, মোস্তফা জামাল হায়দার, মাহবুবউল্লাহ, ইব্রাহিম খলিল (প্রয়াত), ফখরুল ইসলাম মুন্সী, নাজিম কামরান চৌধুরী জীবন বাজি রেখেছিলেন, তারা সবাই আমার থেকে বড় নেতা ছিলেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমি ছিলাম ডাকসুর ভিপি। সে হিসেবে প্রতিটি সভায় সভাপতিত্ব করা, কর্মসূচি ঘোষণা করা এবং সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করে সর্বসাধারণ্যে অধিক পরিচিতি লাভ করেছিলাম। আজ স্মৃতির পাতায় সেই সহযোদ্ধাদের ছবি ভেসে ওঠে। তাদের অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। আন্তরিক পরিবেশে আমরা কাজ করেছি। চারটি ছাত্র সংগঠন, দল-মত-আদর্শ ভিন্ন। কিন্তু আমরা যখন একসঙ্গে থাকতাম আমাদের মধ্যে কোনো ভিন্নতা থাকত না। আজ সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে। এ দুঃখবোধ আমাকে পীড়িত করে।

এমন একটি মধুর দিন আমার জীবনে আর কোনো দিন আসবে না। বছর ঘুরে দিনটি যখন ফিরে আসে হৃদয়ের মানসপটে কত স্মৃতি ভেসে ওঠে। আমরা সংখ্যাসাম্যের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুর অবস্থান থেকে ‘এক মাথা এক ভোট’ ও ‘সার্বভৌম পার্লামেন্ট’-এর দাবি তুলে তা আদায় করেছিলাম। ফলে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাধিক্য আসন আমরা লাভ করেছিলাম। এদিনের প্রতিটি মুহূর্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে মনে পড়ে। সেদিন বক্তৃতায় আরও বলেছিলাম, ‘ছয় দফা ও ১১ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের রক্তের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আমরা ফিরে পেয়েছি। তাদের সে রক্ত যেন বৃথা না যায়, তার জন্য জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাই। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রসহ সব মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য এ আন্দোলন শুরু হয়েছে।’ বক্তৃতা শেষ করে ঘোষণা করেছিলাম, ‘এখন বক্তৃতা করবেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।’ তুমুল করতালির মধ্যে তিনি বক্তৃতা করতে দাঁড়ালেন। চারদিকে তাকিয়ে উত্তাল জনসমুদ্রের উদ্দেশে বললেন, “রাতের অন্ধকারে সান্ধ্য আইনের কঠিন বেড়াজাল ছিন্ন করে যে মানুষ ‘মুজিবকে ফিরিয়ে আনতে হবে’ বলে আওয়াজ তুলে গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে তাদের দাবির সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না।” সংগ্রামী ছাত্রসমাজকে আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ছাত্রদের ১১ দফা শুধু সমর্থনই করি না, এর জন্য আন্দোলন করে আমি পুনরায় কারাবরণে রাজি আছি। ছাত্রদের ১১ দফার মধ্যে আমার ছয় দফা দাবিও নিহিত রয়েছে। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি যদি এদেশের মুক্তি আনতে ও জনগণের দাবি আদায় করতে না পারি, তবে আন্দোলন করে আবার কারাগারে যাব।’ সেদিন বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, ‘আমি গোলটেবিল বৈঠকে যাব, সেখানে আমার ছয় দফাও পেশ করব, ১১ দফাও পেশ করব।’ তিনি জীবদ্দশায় কোনো দিন ১১ দফার কথা ভুলেননি। তাঁর বক্তৃতায় সবসময় ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের কথা থাকত। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে আছে— ‘১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম।’ পরিশেষে স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কৃতজ্ঞচিত্তে বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, তোমরা যারা রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছ, যদি কোনো দিন পারি নিজের রক্ত দিয়ে আমি সেই রক্তের ঋণ শোধ করে যাব।’  তিনি একা রক্ত দেননি— পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতির রক্তের ঋণ তিনি শোধ করে গেছেন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দিন।  যতদিন বেঁচে থাকব হূদয়ের গভীরে লালিত এ দিবসটিকে স্মরণ করব।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, মন্ত্রী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। [email protected]

 

সর্বশেষ খবর