শুক্রবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

নামাজ মানুষকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

নামাজ মানুষকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে

‘ইন্নাস সালাতা তানহা আনিল ফাহশা ই ওয়াল মুনকার। নিশ্চয়ই! নামাজ মানুষকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।’ কোরআন বলছে নামাজ মানুষকে অন্যায় থেকে ফিরিয়ে রাখে।  আমরা যে নামাজ পড়ছি তা বোধ হয় সঠিকভাবে পড়া হচ্ছে না বিধায় আমরা দেখছি মসজিদের শহর ঢাকার অবস্থাই কত বীভৎস। ঢাকার কথা এ জন্যই বললাম, এ শহরে মসজিদ বেশি। তাই স্বাভাবিকভাবে বিশ্বের যে কোনো শহরের চেয়ে এখানে নামাজির সংখ্যাও বেশি। যে শহরকে মানুষ চিনে মসজিদের শহর হিসেবে, ওই শহরের মুসলমান সম্পর্কেও মানুষ এ ধারণাই রাখে, তারা কমবেশি নামাজ পড়ে। আর যে শহরের মানুষ নামাজে অভ্যস্ত সে শহর হবে বিশ্বের বুকে এক অনন্য সুসভ্য আধুনিক শহর। বিশ্বের মানুষ এদের শান্তি-শৃঙ্খলা, আইন-কানুন, নিয়ম-নীতি, সততা বিনাবাক্যে অনুসরণ করবে। এবার দেখুন বাস্তবতা কী? বাস্তবতা হচ্ছে, ঢাকা এমন একটি শহর যা দীর্ঘদিন ধরে বাসঅযোগ্য শহরের প্রথম তালিকায় আছে। হায় মসজিদের শহর! হায় নামাজির শহর! এভাবেই বিশ্ব চিনল তোমাকে?

পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ মুসলিম দেশ বাংলাদেশ। অদ্যাবধি দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নের আশেপাশেই আমাদের অবস্থান। মুসলিম বিশ্বের আদর্শ হচ্ছে আরব দেশগুলো। বিশ্বের সবচেয়ে বিলাসিতা ও অপচয়ের দেশ হিসেবে খ্যাত তারা। অথচ এসব দেশের মানুষও নামাজ পড়ে। আমাদের চেয়ে বেশিই নামাজের প্রতি যত্নবান তারা। আমাদের দেশে তো ফজরের সময় প্রথম কাতারও ভরে না। আর আরব দেশগুলোতে ফজরের ওয়াক্তেও মসজিদ ভরে যায়। তাহলে বুঝুন, নামাজের ব্যাপারে কত বেশি সজাগ-সচেতন তারা।

বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা দৈনিক পাঁচবেলা নামাজ আদায় করছে। কিন্তু কোরআনের একটিমাত্র আয়াতের সামনেই তাদের এই নামাজ টিকছে না। দুঃখজনক হলেও সত্য! আমাদের মাঝে কিছু কিছু নামাজি আছে ধোঁকাবাজ, মিথ্যাবাদী, জুলুমবাজ, দুনিয়াপাগল মানুষ। তার হৃদয়ে নেই কোনো মানবতা, মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসা। মানুষকে ঠকিয়ে, অন্যায়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এসে তারা আল্লাহর সামনে দাঁড়ায়। আল্লাহ কী এমন ব্যক্তির নামাজ কবুল করবেন? আপনার আমার চোখে লোকটি যতই ভালো হোক, তার পাগড়ি যত লম্বাই হোক, তার তেলাওয়াত যতই সুন্দর হোক, মেসওয়াক যতই লম্বা হোক, দাড়ি যতই সুন্নাতি হোক; এই লোকের নামাজ কোরআনের নামাজ হচ্ছে না। তাই নামাজ পড়েও সে সুদের সঙ্গে, ঘুষের সঙ্গে, ব্যভিচারের সঙ্গে, মিথ্যার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অবলীলায়। সারা দিন মিথ্যার সাগরে ডুবে থেকে পাঁচবেলা এসে নামাজে হাজিরা দিয়ে এরা ভাবে আমরা জান্নাতের কাজ করছি। আল্লাহ কী এতই বোকা? বান্দা সম্পর্কে এতই বেখবর? এসব নামাজিকে বলি, দুনিয়ার মানুষকে তুমি ধোঁকা দিতে পারবে। কিন্তু আল্লাহকে ধোঁকা দিতে পারবে না। ‘ওয়াল্লাহু বাসিরুম বিল ইবাদ। বান্দা! যতই ছল-ছাতুরির আশ্রয় তুমি নাও না কেন আমি কিন্তু তোমার ব্যাপারে খুব সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখছি। আমার সিসি ক্যামেরা কিন্তু সর্বক্ষণ তোমার কার্যকলাপ রেকর্ড করে যাচ্ছে। তোমার বানানো সিসি ক্যামেরা তো কেবল মানুষের হাত-পা-ই ভিডিও করে। আর আমার ক্যামেরা তোমাদের মনের অবস্থা, নিয়তের যথার্থ পর্যন্ত ভিডিও করে। তাই সাবধান বান্দা। ওয়াল্লাহু বাসিরুম বিল ইবাদ।’

আমরা যারা নামাজ পড়ি, একই সঙ্গে অন্যায়ের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি, হারামের সঙ্গে মিশে যাই, তাদের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘ফা ওয়াইলুল্লিল মুসল্লিন। আল্লাজিনাহুম আন সালাতিহিম সাহুন। ওই নামাজিরা নামাজ পড়েও জাহান্নামে যাবে, যারা নামাজ পড়ে কিন্তু সালাতি জিন্দেগি যাপন করে না।’ সালাতি জিন্দেগির ব্যাখ্যায় সুফিরা বলেন, পাঁচবেলা সালাত আদায়ের পরও পুরো চব্বিশ ঘণ্টাই তোমাকে সালাতের হালে, সালাতের খেয়ালে থাকতে হবে। যে কাজেই থাকুক না কেন তোমাকে মনে রাখতে হবে আমি নামাজেই আছি। নামাজে থাকাবস্থায় যেমনিভাবে আল্লাহর নির্দেশিত দিক ছাড়া অন্যসব দিকে তাকানো তোমার জন্য হারাম ছিল, ঠিক এখনো আল্লাহর নির্দেশিত কাজটি ছাড়া অন্যসব কাজ তোমার জন্য হারাম। এভাবে কেউ যখন সর্বক্ষণ নামাজের ধ্যানে থাকবে কেবল তখনই নামাজ তাকে অন্যায় থেকে ফিরিয়ে রাখবে। আর তখনই আমাদের নামাজ সত্যিকারের কোরআনের নামাজ হবে। সুফিদের ভাষায় এ নামাজকে সালাতে দায়মুস সালাত বা সার্বক্ষণিক সালাত বলা হয়। আল্লাহ বলেন, ‘ইল্লাল মুসাল্লিন। আল্লাজিনা হুম সালাতিহিম দাইমুন। দুনিয়া এবং আখেরাতে সব ধরনের খারাবি থেকে, অকল্যাণ থেকে শুধু ওই নামাজিরাই মুক্ত, যারা সর্বক্ষণ নামাজের ধ্যানে থাকে।’ এভাবে কোরআনের আলোকে সর্বক্ষণ সালাতের ধ্যানে থাকতে পারলেই আমাদের নামাজে রুহু ফিরে আসবে। নামাজে এক অনাবিল আনন্দ পাওয়া যাবে। প্রশান্তির ঝরনা প্রবাহিত হবে নামাজির আত্মায়।  সুফি ছড়াকার হাফেজ আহমাদ উল্লাহ ছন্দের তুলিতে চমৎকারভাবে এঁকেছেন সে ছবি—

‘পাক পানিতে অজু কর/নামাজ পড়ার আগে—/দিল লাগিয়ে পড়লে নামাজ/কী যে ভালো লাগে!’

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর