মঙ্গলবার, ৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভোটের মাখলুকাত : ধর্মবাদের নতুন পয়গাম

মোস্তফা কামাল

ভোটের মাখলুকাত : ধর্মবাদের নতুন পয়গাম

একযোগে ১ হাজার ১০ জন কওমি আলেমের সরকারি চাকরিতে যোগদান বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন সংযোজন। গত বছরের ১১ এপ্রিল কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদকে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তর ডিগ্রির স্বীকৃতির ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দ্রুতগতিতে ঘোষণা বাস্তবায়ন। ঘোষণার দুই দিন পরই এ মর্মে আদেশ জারি। সেই সিঁড়িতেই ৫ মার্চ কওমি ডিগ্রিধারীদের সরকারি চাকরিতে অন্তর্ভুক্তির ইতিহাসের এই গোড়াপত্তন। কওমি মাদ্রাসাসহ সংশ্লিষ্ট মহলে এ নিয়ে বাঁধভাঙা শুকরিয়া। ভোটের রাজনীতিতে এই মাখলুকাতগুলো ব্যাপক বরকতময় হবে বলে ভাবছে সরকার। বেআইনি হলেও বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতির আগাগোড়াতেই ধর্ম একটি মোক্ষম ফ্যাক্টর। ইসলাম সেখানে টপ মোস্টে। এর বিপরীতে সংখ্যালঘুদের হাত করার প্রতিযোগিতাও ব্যাপক। মুসলিম-হিন্দু এই দুই ফ্যাক্টরই এখন মোটামুটি ক্ষমতাসীনদের কব্জায়। ধর্মভিত্তিক দলগুলোও এ রেসে ক্ষেত্রবিশেষ ফেল মেরেছে আওয়ামী লীগের কাছে। বিএনপির জন্য এটি অন্তর্জ্বালার। আফসোসের। সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযোজনকারীর হকদার তারা। দীর্ঘদিন জামায়াতসহ ইসলামপন্থিরা ছিল তাদের আয়ত্তে। কিন্তু সময়ের স্রোতে ক্ষমতা-শক্তি বুঝে ইসলামপন্থিদের অনেকে বিএনপিকে পীঠ দেখিয়ে কিবলা পাল্টে ফেলেছে। এর আগে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, শুক্রবারে সাপ্তাহিক ছুটির সুবাদে এই মাখলুকের মিম্বারে সাময়িক একটা জায়গা করেছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পীরদের বেশ কজনকেও হাসিল করতে পেরেছিলেন তিনি। তাও এখন অতীত। এর পরও এরশাদ মাঝেমধ্যে তা পুনরুদ্ধারে নামেন। কুলাতে না পারলেও হাল ছাড়েন না। রাজনীতিতে ধর্মকে সম্বল করার কাজে কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে— এ প্রশ্ন ফয়সালাহীন। প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ-বিএনপিরই ‘ইসলামিক উইং’ বেশ কর্মঠ। ভোটের মৌসুমে আওয়ামী লীগের বহুল ব্যবহৃত স্লোগান ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ নৌকার মালিক তুই আল্লাহ’। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের তুষ্টের সঙ্গে তারা হিন্দু সম্প্রদায়কেও বিশেষভাবে আয়ত্তে রাখার চেষ্টায় বেশ সফল। তাদের অন্যতম প্রচারণা হচ্ছে— তাদের না জেতালে সংখ্যালঘুদের দেশে থাকা কঠিন হবে। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে হজ-ওমরাহ, নামাজ, মাজার জিয়ারতে কেউ পিছিয়ে থাকছে না। এই প্রতিযোগিতায় ইসলামী দলগুলোর নেতাদের বিএনপি-আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে হারই মানতে হয়। এদিকে, জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধের বিচারের কারণে কোণঠাসা হয়ে গেলেও ভোটের অঙ্কের কারণে তাদের ভ্যালু শেষ হয়ে যায়নি। বড় দুই দলই তাদের নিয়ে হিসাব-নিকাশে বাধ্য। স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াত প্রথম ১৯৮৬ সালে এরশাদের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। ১০টি আসন পায়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ওই সময় বেশ খায়-খাতিরও ছিল তাদের। একপর্যায়ে সংসদ থেকে পদত্যাগের দৌড়ে আওয়ামী লীগকে টপকে ফার্স্ট হয়ে যায়। এরপর তারা বিএনপির মিত্র হিসেবে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে পারফর্ম করে। জোট না করলেও ১৯৯১ সালে সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে বোঝাপড়ায় ১৮টি আসন পায়। পরে আবার আওয়ামী লীগের কাছে-কিনারে থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ক্ষমতাসীন বিএনপির বিরুদ্ধে মাঠে নামে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমান্তরাল আন্দোলনে শামিল হয়। ভোটের মাঠে তা ফজিলত আনেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী পায় মাত্র ৩ সিট। এর কাফফারা দিতে আবার ভেড়ে বিএনপির সঙ্গে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে চারদলীয় মিতালিতে ১৭টি আসন জেতে জামায়াত। ধর্মভিত্তিক ভোটের এই মাখলুকের হিসাবের মধ্যে নতুন উপাদান ও ভবিষ্যতের তথ্য জোগান দিয়েছে ভারত। কেবল মৌলবাদ ঠেকাও আওয়াজে আগামীতে আগের মতো সুবিধা করা যাবে না সেই আলামত মিলছে। বরং মৌলবাদ-ধর্মবাদের কদর বাড়তির দিকে। পশ্চিমবঙ্গের পর, ত্রিপুরায়ও পতন হলো দীর্ঘ বাম জমানার। দুই হাত দিয়ে আগলে যে প্রদীপের শিখা বাঁচাতে চেয়েছিলেন বামপন্থিরা, গেরুয়া ঝড় তাকে স্তব্ধ করে দিল। ২৫ বছর ধরে যে রাজ্যপাট সামলেছিল বাম ফ্রন্ট, সেই রাজ্যপাট দখল করে নিল ধর্মবাদী বিজেপি। সুদূর শাহি দিল্লি থেকে বার বার উড়ে এসে উত্তর-পূর্বের এই ছোট্ট রাজ্য ত্রিপুরায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আহ্বান জানিয়েছিলেন, ‘মানিক’ ফেলে এবার ‘হীরা’ আনুন। ভোটে তা-ই হলো। পড়শির এ ছায়া ঢাকায়ও। সেই বাস্তবতায় হেফাজতের সঙ্গে মুসাবিদা অবিশ্বাস্য-অসম্ভব মনে হলেও সরকার তা ভাবে না। আবার বিএনপিও এই দিদার লাভে হাল ছাড়ছে না। হেফাজত সরকারের সঙ্গে চিরতরে মোলাকাত করে ফেলেছে তা মনে করে না বিএনপি। হেফাজতের অন্দরমহলের অন্তত চারটি দল এখনো বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিক। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মহাজোটের শরিক ইসলামী দলগুলোও সামনে আরও সুদিন দেখছে। মৌলবাদ, ধর্মবাদ যে নামেই ডাকা হোক এসব দল এখন আর এতে লজ্জা পায় না। বড় দুই দলের কাছে ওজন, ভোটের মাঠে মাথা গণনা, প্রতিবেশী দেশের চিত্র তাদের কাছে আশাজাগানিয়া। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ-বিএনপির কাছে ভিতরে-ভিতরে কিছু দিন ধরে তাদের সমাদর কী মাত্রায় বেড়েছে তারাই জানে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ও খেলাফত মজলিসের বাইরে আরও অর্ধশত ইসলামী রাজনৈতিক দলের তত্পরতা বেশ জোরদার। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও রাজনৈতিক দাওয়াত পড়ছে তাদের। বিশেষ করে বড় দুই দলই চায় তাদের মহব্বতে রেখে ভোট বাড়াতে।

প্রতিবেশী ভারতসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই রাজনৈতিকভাবে ধর্মের এই অপব্যবহার। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় ধর্মের অপব্যবহার মানুষের মাঝে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। ভারতে হিন্দু-মুসলিম অসহিষ্ণুতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। পাকিস্তানে ধর্মবাদ থেকে উগ্রবাদ-জঙ্গিবাদ জন্ম নিয়েছে। তা পাকিস্তানকে একটি ব্যর্থ ও ভঙ্গুর রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। দেশটির বোধসম্পন্ন মাখলুকও যেন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতো তা হজমে বাধ্য হচ্ছে।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট

বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

সর্বশেষ খবর