বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

এই মৃত্যুমিছিলের কি শেষ নেই?

তপন কুমার ঘোষ

এই মৃত্যুমিছিলের কি শেষ নেই?

সড়ক দুর্ঘটনার খবর সংবাদপত্রের পাতায় একটা ‘স্ট্যান্ডিং আইটেম’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত হওয়ার খবর পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বেশি হলে এ-সংক্রান্ত খবর সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় স্থান পায়। ছোটখাটো দুর্ঘটনার খবর ভিতরের পৃষ্ঠায় ঠাঁই করে নেয়। ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর দিনকয়েক আলোচনা হয়। একসময় সবকিছু থিতিয়ে যায়।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে গোলটেবিল আলোচনা, টকশো, সভা-সেমিনার কম হয়নি। সংবাদপত্রে এ নিয়ে প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় মাঝেমধ্যেই ছাপা হয়। দুর্ঘটনার কারণগুলো চিহ্নিত হয়েছে। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। দুর্ঘটনার সংখ্যা কমছে না। তাই অনেকে আক্ষেপ করে বলেন, কী হবে এসব করে? এ নিয়ে লেখালেখি করা পণ্ডশ্রম বৈ কিছু নয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালনা, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, ওভারলোডিং, লাইসেন্সবিহীন চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করা প্রভৃতি কারণ মূলত দায়ী। অন্যান্য কারণের মধ্যে আছে জেব্রা ক্রসিং না মানা, যেখান সেখান দিয়ে রাস্তা পার হওয়া, গাড়ি চালনার সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, মাদকাসক্ত হয়ে গাড়ি চালানো, ধীরগতি ও দ্রুতগতির যানবাহন একই সঙ্গে চলাচল করা, মহাসড়কের ওপর হাটবাজার বসানো ইত্যাদি। সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান দুটি কারণ হচ্ছে— চালকের অদক্ষতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালনা। ট্রাফিক আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে লাগামহীন গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। বেপরোয়া গতির কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ি ফুটপাথে উঠে নিরীহ পথচারীদের পিষে মারছে। বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা বাসের চাকায় পিষ্ট হচ্ছেন। অনেক সময় যাত্রী তোলা নিয়ে দুটি বাসের মধ্যে রেষারেষি শুরু হয়। তখন বিপজ্জনকভাবে ওভারটেকিং করতে গিয়ে বিপরীত থেকে আসা কোনো যানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে অকালে ঝরে যাচ্ছে অনেক প্রাণ। যাত্রীবীমা না থাকায় দুর্ঘটনায় যারা অকালমৃত্যুর শিকার হন তাদের পরিবার কোনো ক্ষতিপূরণ পায় না। কপাল জোরে যারা বেঁচে যান তাদের চিকিৎসার ব্যয়ভার নিজেদেরই বহন করতে হয়। চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেকে নিঃস্ব হয়ে যান। দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অনেকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি তখন পরিবারের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

এ কথা ঠিক, সুযোগ পেলেই ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা আমাদের অনেকের মধ্যেই আছে। চালকদের একাংশের মধ্যেও এই বিপজ্জনক প্রবণতা অতিমাত্রায় লক্ষ্য করা যায়। চালকের ফিটনেস গুরুত্বপূর্ণ। একজন দক্ষ ড্রাইভারের ছয়টি যোগ্যতা ও গুণ থাকা দরকার। এগুলো হচ্ছে— প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, যান্ত্রিক জ্ঞান, ট্রাফিক আইন-কানুন সম্পর্কে সম্যক ধারণা ও তা কঠোরভাবে মেনে চলার মানসিকতা, দায়িত্বশীলতা, আত্মবিশ্বাস ও ধৈর্য। এর যে কোনো একটির ঘাটতি থাকলে দুর্ঘটনা অনিবার্য হয়ে ওঠে। চালককে অত্যন্ত ধৈর্যশীল হতে হবে। উগ্রমেজাজি ব্যক্তির এ পেশায় না আসাই উত্তম। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলে মানুষ সচেতন হয় না। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চালকদের কেউ কেউ নিরক্ষর। বাংলা পড়তে পারেন না। এমনকি ট্রাফিক চিহ্নও ঠিকমতো বোঝেন না। ট্রাকচালকরা প্রয়োজনীয় বিশ্রাম পান না। সময়মতো ঘুম নেই। খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নেই। রাতের পর রাত জেগে গাড়ি চালাতে হয়। পথই তাদের ঠিকানা। এই হিউম্যান ফ্যাক্টরগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। চালকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও কাউন্সেলিংয়ের বিকল্প নেই।

গাড়ির ফিটনেস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খোদ ঢাকা শহরেই কিছু কিছু জরাজীর্ণ যানবাহন চলাচল করতে দেখা যায়। এ থেকে মফস্বলের অবস্থা আন্দাজ করা মোটেই কঠিন কাজ নয়। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার না করার বিধান আছে। কিন্তু এই বিধান কজন মানেন? চালকের অবহেলা বা খামখেয়ালিপনার কারণে প্রাণহানি হলে এটাকে নিছক দুর্ঘটনা বলে মেনে নেওয়া যায় না। এটা হত্যাকাণ্ডেরই শামিল।

দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়কের বেহাল দশা। এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিন সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে পত্রিকার পাতায়। ছবি তো আর মিথ্যা বলে না। ভাঙাচোরা সড়ক অনেক দুর্ঘটনার কারণ। মনোযোগ দেওয়ার ফলে হাল আমলে আমাদের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। সড়কপথে ভোগান্তির কারণে এখন অনেকেই রেলপথকে বেছে নিয়েছেন। রেলপথে ভ্রমণ তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক বলে ভ্রমণকারীরা জানান।

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কঠোর শাস্তির বিধানের কথা অনেকেই বলেন। এতে কোনো সুরাহা হবে বলে মনে হয় না। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকের শাস্তি হয়েছে এমন নজির কম। দুর্ঘটনার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে চালক পালিয়ে যান। মামলা হলেও সাক্ষ্য-প্রমাণ দিতে অনেকে এগিয়ে আসেন না। ইউনিফরম পরে গাড়ি চালানোর বিধান চালু করা হলে চালককে সহজেই শনাক্ত করা যাবে। উড়োজাহাজ, রেলগাড়ি, স্টিমার সব ক্ষেত্রেই এই নিয়ম চালু আছে। কিন্তু বাস-ট্রাক চালকের ক্ষেত্রে এটা নেই। কেন নেই? এ প্রশ্নের জবাব নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে যারা আছেন তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদেরও দায়িত্ববোধের কমতি আছে, এটা অস্বীকার করার জো নেই। উল্টোপথে গাড়ি চালানো, ফুটপাথে মোটরসাইকেল তুলে দেওয়া, জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর যানবাহন দাঁড় করিয়ে রাখা, যেখান সেখান দিয়ে রাস্তা পারাপার, এমন অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে। লাগামহীন গতির কারণে মোটরসাইকেল আরোহীরা পথে-ঘাটে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন। প্রভাবশালীদের গাড়ি উল্টোপথে চালানো ভালো বিজ্ঞাপন নয়। এটা আইন অমান্যকারীদের উৎসাহিত করে। সমালোচনার সুযোগ করে দেয়। আমরা নিজেরা না শোধরালে কিছুতেই কিছু হবে না।

চালক ও পথচারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হলে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। একসময় মাঝেমধ্যে ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করা হতো। এখন কালেভদ্রে। ট্রাফিক আইন-কানুন সম্পর্কে সচেতন করার দায়িত্বটা কার? এ দায়িত্ব তারা সঠিকভাবে পালন করছেন কি?

            লেখক : সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর