মঙ্গলবার, ১ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

‘তোমাদের আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব’

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

‘তোমাদের আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব’

পয়লা মে শ্রমজীবী মানুষের জন্য এক মহান দিন। এই মহান দিনে শ্রমজীবী সবাইকে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও সালাম জানাই। দেখতে দেখতে এসে গেল মাহে রমজান। মুসলমানের কাছে সব থেকে পবিত্র হিজরি মাস। শবেবরাত বুঝিয়ে দেয় রমজানের আগমনী বার্তা। একজন মুসলমানের কাছে রমজান বহু আরাধ্য, কাঙ্ক্ষিত মাস। কত আশা নিয়ে কত মুসলমান অপেক্ষায় থাকে রমজানের জন্য। রমজান আমাদের সবার জন্য মঙ্গলময় হোক, এ প্রত্যাশা করি। দিন পনের আগে টাঙ্গাইলের পথে ছিলাম। কদিমধল্যা পার হওয়ার সময় ড্রাইভার বলছিল, ‘স্যার, পেশাব করব।’ অসুবিধা কী। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি দাঁড় করেছিল। ডান পাশে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নেমে এলো চারজন। চিনতে পারিনি। কাছে এলে দেখি পুলক সরকার। অতটা বৃদ্ধ হয়েছে ভাবতে পারিনি। দু-এক বছর আগেও দেখেছি অত নাজুক মনে হয়নি। সালাম করে দাঁড়িয়েই বলল, ‘স্যার, ২৯ তারিখ আমার ছেলের বৌভাত। আপনি আসবেন।’ পুলকের ছেলের বিয়ের কথা ভাবিনি। কেন যেন তালে তালে বলেছিলাম, ঠিক আছে। চেষ্টা করব। দুই দিন আগে ঢাকা গিয়েছি। সে এক মহা কেলেঙ্কারি। জিরাবো আর ইপিজেড এলাকায় সবসময় যানজট লেগেই থাকে। সাড়ে চার-পাঁচ ঘণ্টার আগে মূল সড়ক দিয়ে যাওয়া যায় না। তাই মির্জাপুর-ওয়াশি-কাওলিপাড়া-কালামপুর হয়ে চার-পাঁচ বার যাতায়াত করেছি। তাই সেদিনও সে রাস্তা ধরেছিলাম। মোটামুটি ভালোই ছিল। কিন্তু মূল রাস্তা সাভারের হেমায়েতপুর এসে নট নড়নচড়ন। প্রায় দেড় ঘণ্টা গাড়ি-ঘোড়া একেবারে চলেনি। বড় বেশি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। কীভাবে দারুসসালামের ট্রাফিক অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার সাইফুল ইসলাম মুজাহিদকে পেয়েছিলাম। ভদ্রলোক বলছিলেন, ‘কেন যেন সকাল থেকে প্রচণ্ড চাপ। আমি দেখছি।’ ভদ্রলোক দেখেছেন কি দেখেননি জানতে পারিনি। কিন্তু একটু পরই গাড়ি চলতে শুরু করে। ঢাকার বাড়িতে পৌঁছতে তাতে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পার হয়ে গিয়েছিল। কী আর করব! চিত্কার-পাত্কার তো কম করছি না। কিন্তু শোনার কেউ নেই, দেখার কেউ নেই। কেউ যদি কষ্ট না বোঝে তাহলে বোঝাব কী করে? কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের মতো বয়স নেই তাই রাস্তায় নামতে পারি না। আর রাস্তায় নামলেই বা কী হবে। রাস্তা বন্ধ হলে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। সাধারণ মানুষের কী হলো না হলো দেখে কে। সরকার আছে সরকারি মনোভাব নিয়ে। সত্য থেকে অনেক দূরে। তাই পুলকের ছেলের বৌভাতে হাতে বেশ সময় নিয়ে বেরিয়েছিলাম। তাই ঠিক সময় পৌঁছতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। প্রথম বসেছিলাম মির্জাপুর কলেজের প্রিন্সিপাল সালাহউদ্দিন আহমেদের অফিসে। আমাদের অনেকেরই পরিচিত, অনেকের কর্মী। কলেজের অবকাঠামো বেশ চমত্কার। বৃষ্টির কারণে দাওয়াতিদের অসুবিধা হয়েছে। কিন্তু তবু বিশাল বারান্দা থাকায় খাওয়াতে গিয়ে তেমন কষ্টে পড়তে হয়নি। আমি মাংস খাই না ৩৮-৪০ বছর। তাই দাওয়াতে গেলে অসুবিধা হয়। তবু পুলকের ছেলের বৌভাতে কোনো অসুবিধা হয়নি। মাছ থাকায় মোটামুটি ভালোই হয়েছে। বহুদিন পর বানিয়ারার ওয়াদুদকে দেখলাম, এসেছিল নাসির, শামসু। সঙ্গে সঙ্গে দুলালকে পাইনি। কিন্তু পরে বউসহ দুলাল এসেছিল। এসেছিল তাপস, গফুর, আমজাদ, কহিনূর। তাপস তো খাওয়ার সময় ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। খাওয়ার শেষ পর্যায়ে টাঙ্গাইল পৌরসভার চেয়ারম্যান মিরন এসেছিল। ওর ডায়াবেটিসের মাত্রা ২০-এর নিচে নামে না। তবু বেশ ভালো খায়। খাওয়া-দাওয়া শেষে পুলক সরকারের ছেলে পার্থপ্রতিম সরকার এবং ছেলের বউ দীপা সরকারকে শান্তিতে স্বস্তিতে থাকার দোয়া করেছি। আল্লাহ যাতে ওদের ভালো রাখেন, সুসন্তানের জনক-জননী বানান কায়মনে এই কামনা করেছি।

মির্জাপুর কলেজে যতক্ষণ ছিলাম কেন যেন অনেক চেষ্টা করেও মুক্তিযুদ্ধের কথা মন থেকে মুছে ফেলতে পারছিলাম না। ঘটনাটি অনেকেরই জানা। ১৯৭১-এর ২০ নভেম্বর আমরা ঢাকা-টাঙ্গাইল, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল-নাগরপুর, টাঙ্গাইল-পোড়াবাড়ীর প্রায় ৪২টি সড়কসেতু ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলাম পাকিস্তানি হানাদারদের চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। মূলত ২০ নভেম্বর ঢাকা-টাঙ্গাইল, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া ছিল কাদেরিয়া বাহিনীর অন্যতম বড় অভিযান। প্রায় ছয় হাজার যোদ্ধা এই অভিযানে অংশ নিয়েছিল। মাত্র একজন ছাড়া কেউ শহীদ হয়নি। আহত হয়েছিল ৪০-৫০ জন। এমন সফল অভিযান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ। মির্জাপুর কলেজের প্রিন্সিপালের অফিসের উত্তরে থানা ভবন। এখনো থানা ভবন প্রায় আগের মতোই দেখে ভালো লাগেনি। সারা দেশের সবকটা থানা হয়তো দেখিনি। কিন্তু বেশিসংখ্যক দেখেছি। কোনো থানাই এমন নাজুক অবস্থায় নেই। যেমনটা নাগরপুর আর মির্জাপুর এখনো রয়ে গেছে। সে যাক, বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় ৭ মার্চে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। একজন জাতীয় নেতা জনগণের সঙ্গে কতখানি সম্পৃক্ত হলে অমন এক সব দিক থেকে পরিপূর্ণ ভাষণ দিতে পারেন সে শুধু বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর।’ বলেছিলেন, ‘আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঢাকায় আসুন দেখুন বিচার করুন।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার বুকে গুলি চালাতে চেষ্টা করো না। ৭ কোটি মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আমরা তোমাদের ভাতে মারব, পানিতে মারব। কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।’ যুদ্ধে যে পানিও কখনো অস্ত্র হয় সে কথাই বলছি। প্রতিদিন দেখছি কত লোক কত পুরস্কার পাচ্ছে। জননেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদের কোনো নাম নেই। স্বাধীনতা পুরস্কার পায় শাইখ সিরাজ। ওই এক যুদ্ধের জন্য বীরবিক্রম সবুর খানের স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল।

সে যাক, ঘটনাটা খুলেই বলি। রোজার মধ্যে যুদ্ধের গতি কিছুটা কম ছিল। আমরা খুব একটা আক্রমণ করতে যাইনি। আমাদের অবস্থা হয়ে পড়েছিল অনেকটাই ডিফেন্সিভ। এ রকম অবস্থায় নভেম্বরের ১৮ তারিখ রমজানের একেবারে শেষের দিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কসেতু উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল। তখন আমাদের বিপুল শক্তি। একটা নিয়মিত বাহিনী যেভাবে চলে কাদেরিয়া বাহিনী তার চেয়েও সুশৃঙ্খল। অস্ত্রের দিক থেকে যেমন শক্তিশালী, মনোবলের দিক থেকে তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী। ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজার যোদ্ধাকে প্রস্তুত করা হয়েছিল এই অভিযান সফল করার জন্য। খুব সম্ভবত ১৬ নভেম্বর আকাশবাণী এবং স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র অভিযানের একটা ভুয়া খবর দিয়ে দেয়। আমাদের দিক থেকে খবরটি ফাঁস হওয়ার একটা কারণ থাকতে পারে। সেটা হলো রোজার শুরুর দিকে কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক প্রশাসক আনোয়ারুল আলম শহীদকে ভারত পাঠানো হয়েছিল। সেদিক থেকে যদি কোনোভাবে তাদের কথায় কথায় প্রচার হয়ে থাকে সে হতে পারে। তা ছাড়া আমাদের দিক থেকে ওই পরিকল্পনা প্রচার বা প্রকাশের কোনো কথা ছিল না। যাই হোক, অভিযানের খবর প্রচার হয়ে গেলে আমরা কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে যাই। কারণ দিন-তারিখ ঘোষণা করে আর যাই হোক গেরিলা যুদ্ধ হয় না। দেশে দেশে যুদ্ধ হতে পারে। কিন্তু গেরিলা যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে হয় না। সব কমান্ডারকে আবার ডাকা হলো। সবাইকে বলা হলো অভিযানের যেভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে ঠিক সেভাবেই হবে, সময়টা শুধু হেরফের হবে। ছয় থেকে আট ঘণ্টা আগে অভিযানের শেষ নির্দেশ দেওয়া হবে। সবাই প্রস্তুত থাকো। যারা খবর আনা-নেওয়া করত তাদের শান্তি নামে ডাকা হতো। তাদের তত্পরতা অনেক বেড়ে গেল। রাস্তার ওপর দৃষ্টি রাখা, প্রত্যেক কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ, সে খবর হেডকোয়ার্টারে পৌঁছানো, হেডকোয়ার্টার থেকে আবার আমার কাছে। এসব চলতে লাগল নির্ভুল যন্ত্রের মতো। ১৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় যার যার টার্গেট দখল করে অভিযান সফল করতে নির্দেশ দেওয়া হলো। আমি নিলাম একেবারে উত্তরে ভাতকুড়া সেতু। যদিও শুরু থেকে সব কমান্ডারের তাতে আপত্তি ছিল। তবে ভাতকুড়া সেতু অভিযানে আমাদের কোনো গুলি ছুড়তে হয়নি। সব কৃতিত্ব ভাতকুড়ার মোহর খাঁর। সে-ই আগে থেকে রাজাকার-আলবদরদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঠিকঠাক করে রেখেছিল আক্রমণ হলেই আত্মসমর্পণ করবে। তা-ই তারা করেছিল। অন্যদিকে বজ কোম্পানির কমান্ডার বায়েজিদ, সহকারী কমান্ডার শামসুল হক, সোলায়মান ও অন্যরা হাবিব, হাকিম, মজনু, ফেরদৌস, আজাদ, কুর্নীর বাদশা, সাইদুর, তমছের, হালিম, মকবুল হোসেন খোকা, সবুর খান, রবিউল গেরিলা আরও যাকে যেখানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রায় সবাই রাতেই তাদের সেতু দখল করে ডিনামাইটে উড়িয়ে দিয়েছিল। সবুর খানকে দেওয়া হয়েছিল সোহাগপাড়া সেতু। সে সেটা সময়ের আগেই দখল করে ভেঙে চুরমার করে ফেলেছিল। তারপর প্রায় ১০ মাইল দক্ষিণে গিয়ে কালিয়াকৈরের মহিষবাথান কালভার্ট ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে একাকার করে ফেলে আবার গোড়াই ফিরে আসে। সবুরের কিছুটা উত্তর-পশ্চিমে দেওহাটা সেতু তখনো মূর্তিমান দাঁড়িয়ে ছিল। অথচ ওর আগে সেখানে প্রায় ৪০০ পাউন্ড এক্সক্লুসিভ ব্যবহার করা হয়েছে। দেওহাটা সেতুর যে আকার তাতে ২০০ পাউন্ড হলেই যথেষ্ট, সেখানে খরচ হয়েছে ৪০০ পাউন্ড। তাই রবিউল গেরিলা সবুর খানের শরণাপন্ন হয়। সবুর এসে মাত্র ৯০ পাউন্ড চার্জ ব্যবহার করে দেওহাটা সেতু মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। তারও উত্তর-পশ্চিমে মির্জাপুর সেতুর দখল দায়িত্বে ছিল কমান্ডার আজাদ কামালের। সে সেতুর পাহারা উড়িয়ে দিতে পারলেও ডিনামাইট বসিয়ে সেতু উড়িয়ে দিতে পারছিল না। কারণ, সেতু থেকে দেড়-দুই শ গজ দূরেই মির্জাপুর থানা। সেখান থেকে অনবরত মেশিনগানের গুলি আসছিল। আজাদ কামাল কিছুতেই কিছু করতে পারছিল না। কখনো থানা আক্রমণ কখনো সেতু ধসিয়ে দেওয়ার কোনো চেষ্টাই সফল হচ্ছিল না। রাত পেরিয়ে সকাল, আপ্রাণ চেষ্টা করেও কোনো কিছু করতে পারেনি। বেলা ১১-১২টার দিকে তার পুরো দল নিয়ে সবুর খান মির্জাপুরে আসে। স্বাভাবিক কারণেই সিনিয়র কমান্ডার হওয়ায় সব দায়িত্ব চলে আসে তার ওপর। সবুর খান প্রথমেই থানা দখল নেওয়ার চেষ্টা করে। বাজারের দিক থেকে ঘুরে থানার অবস্থান ঠিক করে নেয়। দুপুরের দিকে একবার ঝটিকা আক্রমণ করে। একেবারে থানার কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারলেও থানা দখল করা সম্ভব হয় না। কারণ সব কটি বাঙ্কার এমনভাবে করা হয়েছে যে, তাদের মাটির ওপর না উঠলেও চলে। সবুর অনেক চিন্তা করে কোনো কূল-কিনারা করতে পারে না। একসময় কী করে তার মনে হয় থানা আশপাশের চেয়ে কিছুটা নিচু। তাই পানি দিয়ে ভরিয়ে দিলে কেমন হয়। আর যেহেতু এক বাঙ্কারের সঙ্গে আরেক বাঙ্কারের যোগাযোগ আছে সেহেতু কোনো এক বাঙ্কার কোনোভাবে পানি দিয়ে ভাসিয়ে দিতে পারলে শত্রুসেনার বাঙ্কারে থাকা মুশকিল হয়ে পড়বে। তখন কেবলই দেশে পাওয়ার পাম্প চালু হয়েছে। সব জায়গায় কৃষিতে পাওয়ার পাম্প ব্যবহার হচ্ছে। এত দিন আমরা রাইফেল-বন্দুক-কামান দিয়ে যুদ্ধ করেছি। এবার প্রয়োজন দেখা দেয় পাওয়ার পাম্পের। সবুর লোকজন ডেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাওয়ার পাম্পের ব্যবস্থা করতে বলে। সত্যিই তখন এমন একটি অবস্থা কারও কাছে আকাশের চাঁদ চাইলেও হয়তো তারা সে ব্যবস্থা করে দিতেন। মির্জাপুর কলেজের অসমাপ্ত বিল্ডিং আড়াল নিয়ে খালের পাড়ে পরপর চারটি পাওয়ার পাম্প বসানো হয়। ২০ তারিখ পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন। সন্ধ্যার কিছু আগে পাওয়ার পাম্পগুলো একসঙ্গে চালু করা হয়। পাঁচ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের পাওয়ার পাম্প পানি উদিগরণ করতে থাকে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মির্জাপুর বাজারের কাছে স্কুল-কলেজের মাঠ পানিতে ভরে যেতে থাকে। রাত ৯টা-সাড়ে ৯টার মধ্যে থানা কম্পাউন্ডে পানি ঢুকে যায়। সে এক দেখবার মতো দৃশ্য। নানা জায়গায় অবস্থান নিয়ে সবুর খান তার দলকে অত্যন্ত নিপুণভাবে পরিচালনা করেন। বাঙ্কার ডুবে গেলে কী হবে তা আগে থেকেই বুঝতে পারে পাকিস্তানি হানাদাররা কোন দিকে যাবে, রাজাকার-আলবদররা কী করবে। এসব চিন্তা ছিল তার নখদর্পণে। রাত ১০টা থেকে হানাদারদের দিক থেকে গুলি একেবারে কমে আসে। এখন আবহাওয়া বদলে গেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় নভেম্বর-ডিসেম্বর ছিল ভরা শীতের মাস। জানুয়ারিতে ছিল হাড়কাঁপানো শীত। তাই আস্তে আস্তে যখন পানিতে বাঙ্কারগুলো ভেসে যায় তখন আর কারও পক্ষে বাঙ্কারে থাকা সম্ভব ছিল না। হানাদাররা সন্তর্পণে থানা ছেড়ে প্রথমে কিছুটা উত্তরে গিয়ে তারপর ঢাকার দিকে পালাতে থাকে। ৩০-৩১ জন হানাদার মিলিশিয়া সবুরের হাতে ধরা পড়ে। বাকিরা কোথায় যায় সে খবর সবুরের কাছে ছিল। এক দিন পর আমি যখন মির্জাপুর গিয়েছিলাম সবুর খানের সেদিনের সেই যুদ্ধকৌশল শুনে এবং দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। তাকে যে সাহসিকতার খেতাব দেওয়া হয়েছিল তার অনেকটা জুড়ে ছিল এই মির্জাপুরের পানির যুদ্ধ। আসলে বঙ্গবন্ধুর কোনো কথাই যে ফেলনা ছিল না— ‘তোমাদের আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব। তোমরা ব্যারাকে থাকো কেউ তোমাদের কিছু বলবে না।’ তাঁর কথা আমরা সেদিন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলাম। খারাপ লাগে বঙ্গবন্ধু নেই। কেউ চিরকাল থাকে না। কিন্তু তাঁর কথা যারা কাজে রূপায়িত করেছে তারা কেউ খুব একটা মর্যাদা পায়নি। অমর্যাদার জঞ্জাল মাথায় নিয়ে তাদের অনেক পথ চলতে হয়েছে। আরও কতটা চলতে হবে তা তারাই জানেন। তবে স্বাধীনতা হাসতে-হাসতে খেলতে-খেলতে আসেনি। স্বাধীনতার জন্য আমাদের অসম্ভব পরিশ্রম করতে হয়েছে, ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। মির্জাপুর অভিযানে জাহাঙ্গীর নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিল। যাকে বহুরিয়াতে দাফন করা হয়। তার কবর দেখারও কেউ নেই। এই হলো আমাদের স্বাধীনতা।

 

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর