শনিবার, ২ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

প্রধানমন্ত্রীর ভালোবাসায় সিক্ত নূরুন্নাহার

শাইখ সিরাজ

প্রধানমন্ত্রীর ভালোবাসায় সিক্ত নূরুন্নাহার

এক. ২০০৫ সাল। দেশের উত্তর-পশ্চিমের জেলা পাবনার ঈশ্বরদী কেবল জেগে উঠছে ফল-ফসলে। ঈশ্বরদীর এক কৃষক পিয়াজ আবাদ করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলেন। নাম তার সিরাজুল ইসলাম। তাকে সবাই চিনতেন ‘পিয়াজ সিরাজুল’ হিসেবে। তার আগেই এলাকায় কৃষি ফসলের সঙ্গে নাম গেঁথে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেন ‘পেঁপে বাদশা’। ধনে আবাদ করে বেশ লাভবান কৃষক সিদ্দিকুর রহমান ময়েজও তখন উঠে এসেছেন আমার অনুষ্ঠান ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর মাধ্যমে। কুলের মৌসুমে এক সকালে এই সফল কৃষকদের হালহকিকত জানতে যাই। এলাকায় কুল আবাদের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ সম্ভাবনার বেশ সামনে রয়েছেন সিদ্দিকুর রহমান ময়েজ। ময়েজের হাতে তখন ব্যাপক যশ ও সম্ভাবনা। অনেকেই আকৃষ্ট তার উৎপাদন-কৌশল আর মনোযোগ দেখে। সবাই বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে ময়েজ বড় একটা কিছু দেখাবেন। ময়েজের খেতেই দুজন আগ্রহী নারী কৃষকের সঙ্গে দেখা; যারা কৃষিতে কিছু করতে চান। এর একজন নূরুন্নাহার। নিতান্তই এক প্রান্তিক কৃষকের স্ত্রী। কৃষির কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তবে স্বপ্ন আছে চোখভরা। বলতে চাইলেন অনেক কথা। তিনি নব্বই সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমার উপস্থাপিত ‘মাটি ও মানুষ’-এর একটি পর্ব দেখেছিলেন। বগুড়ার সালেহা নামের এক নারীর সবজি চাষে সাফল্য। ওই নারী সবজি বিক্রি করে পেয়েছিলেন পনের শ টাকা। এই পনের শ টাকা পাওয়ার হিসাবটি নূরুন্নাহারের মাথায় গেঁথে ছিল। দরিদ্র বাবার ঘর থেকে স্বামীর ঘরে এসেও আরেক দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েন নূরুন্নাহার। স্বামী একটু-আধটু ফসলের আবাদ করেন। কিন্তু হাতযশ কম। ভালো কিছু করতে

পারেন না। স্বামীর ঘরে কঠিন দিন পার করতে হয়েছে তাকে। মাথার নিচে বালিশের বদলে ইট দিয়ে আর গায়ে বস্তা দিয়েও রাত কাটাতে হয়েছে। দিন কেটেছে খেয়ে না খেয়ে। সেই নূরুন্নাহার একদিন তার স্বামীর বাগানের কিছু লেবু গাছ কেটে ফেলার কারণে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হন। স্বামীর মারধরের মুখে ওই লেবু গাছগুলোর জন্যই তার জীবনে সবচেয়ে মায়া জন্মে যায়। নতুন করে সালেহার পনের শ টাকা উপার্জনের হিসাবটি আবার মাথায় চলে আসে। চিন্তা করেন কৃষিকাজই করবেন তিনি। নূরুন্নাহারের গল্প শুনে বেশ ভালো লাগল। নতুন একটি পেয়ারাবাগান করেছেন। এসব বিষয় নিয়ে একটি প্রতিবেদন ধারণ করে এলাম। টেলিভিশনে নিজের অনুষ্ঠান প্রচারের পর নূরুন্নাহারের জীবনে আসে নতুন প্রত্যয়। আশপাশের সফল কৃষকদের কাছ থেকে ধারণা নিয়ে চাষাবাদে মনোযোগ বাড়াতে থাকেন। সমিতির ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে বাড়ির আঙিনায় ফসল আবাদ, বাড়িতে দু-একটি গরু ও হাঁস-মুরগি লালন-পালনের উদ্যোগ নেন নূরুন্নাহার। এদিকে পরপর কয়েক বছর এলাকায় কৃষিতে অভাবনীয় সাফল্যের নজির গড়েন সিদ্দিকুর রহমান ময়েজ। ধনে ময়েজ থেকে দেড় কোটি টাকার কুল বিক্রি করে এলাকায় কুল ময়েজ হিসেবে নাম ছড়িয়ে যায় তার। তার সাফল্য বহু কৃষককেই নতুনভাবে উজ্জীবিত করে। একে একে এলাকায় লিচু কিতাব, গাজর জাহিদুল, কফি বারী, মাছ হাবিবের মতো সফল খামারির নাম ছড়িয়ে পড়ে। তাদের সাফল্য এলাকায় এক বড় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে। ঈশ্বরদীর বখতারপুর গ্রামের সেই নূরুন্নাহারও কিছুটা সাফল্যের আলোয় আসেন। ছোট পরিসরে কৃষি আবাদ করতে করতে আলোর মুখ দেখতে থাকেন তিনি। ২০০৯ সালে সিটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কারের নির্বাচক কমিটির একজন হিসেবে কৃষিতে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নূরুন্নাহারের নাম দেখলাম। ভালো লাগল ব্যাপারটি। বুঝলাম ঈশ্বরদীর কৃষক সবাই যেমন সাহসী তেমন উৎসাহী। তাদের ব্যর্থতা বলে কিছু নেই। ওই সিটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কারের সাড়ে তিন লাখ টাকা আর গণ্যমান্য মানুষের মাঝে সম্মানপ্রাপ্তি যেন নূরুন্নাহারকে দাঁড় করাল নতুন প্রত্যয়ের পথে। তারপর নূরুন্নাহার এগিয়েই চলেছেন। কৃষক হিসেবে নূরুন্নাহারের সাফল্যগুলোর খোঁজ পাই, ভালো লাগে। দুই. কয়েক দিন আগের ঘটনা। হঠাৎ সকালে নূরুন্নাহার ফোন করেছেন। আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। বললাম, অফিসে আসুন। অফিসে কৃষিবিষয়ক নতুন একটি অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিয়ে সভা চলছিল। সে সভার শেষের দিকে নূরুন্নাহার এলেন। তিনি উপস্থিতদের আলোচনা পর্যায়ে কৃষি সাফল্যের এক দৃষ্টান্ত হিসেবেই হাজির হলেন। আমি আমার সহকর্মীসহ অভ্যাগত অতিথিদের জানালাম চলুন এই নারীর কিছু কথা শোনা যাক। নুরুন্নাহার শুরু করলেন তার সেই ছোটবেলার গল্প থেকে যখন তিনি ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে বগুড়ার সালেহা নামের এক নারীকে দেখেছিলেন কৃষি আবাদ করে পনের শ টাকা উপার্জন করতে। তারপর স্বামীর ঘরে এসে কষ্টের গল্প। সব গল্প শুনে বললাম, এখন কী করছেন? তিনি বললেন, এ পর্যন্ত কৃষি আবাদ করে সাফল্যের জন্য ২৮টি পুরস্কার পেয়েছি। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু কৃষিপদক থেকে শুরু করে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের পুরস্কার, বিভিন্ন দূতাবাসের পুরস্কার রয়েছে। তারপর নূরুন্নাহার তার ব্যাগ থেকে একটি কার্ড বের করে দিয়ে বললেন, ‘এখন আমি কৃষিকাজের পাশাপাশি এই দায়িত্বে আছি’। দেখলাম তিনি এখন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থাপনা কমিটির একজন সদস্য। পাঁচ বছরের জন্য এ দায়িত্ব তিনি পেয়েছেন। অনেক বড় ব্যাপার। একজন কৃষক দেশের কৃষি গবেষণার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সদস্য হয়েছেন। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের জন্য এর চেয়ে ভালো ঘটনা আর কী হতে পারে? এর মধ্য দিয়ে সারা দেশের কৃষক যেমন সম্মানিত হয়েছেন, সম্মানিত হয়েছেন নারীসমাজও। ভালো লাগল নূরুন্নাহার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্মানিত কৃষক সদস্য হিসেবে যুক্ত আছেন জেনে। নূরুন্নাহার একের পর এক তার সাফল্যের কথা শোনাচ্ছেন, ভালো লাগছে। তিনি ১২০০ নারী কৃষককে নিয়ে একটি সংগঠনও পরিচালনা করছেন। তার রয়েছে গরুর খামারসহ নানা ফল-ফসলের আবাদ। কৃষিতে তার দক্ষতা ও সাফল্যের জন্যই সরকারের নতুন একটি প্রকল্প ‘উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান উন্নয়ন প্রকল্প’-এর সঙ্গে তাকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। নূরুন্নাহার দারুণ আত্মবিশ্বাসী ও প্রাণবন্ত এক কৃষি উদ্যোক্তা। তিনি কৃষিকে ভালোবাসেন বলেই তার সন্তানদের কৃষিতে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিন সন্তানের এই জননীর বড় ছেলে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে গ্র্যাজুয়েশন এ বছর শেষ করবে, মেজ ছেলে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ছোট ছেলে ঈশ্বরদী সরকারি কৃষি কলেজে পড়ছে। তার সন্তানদের লেখাপড়া করানোর সুযোগ পাওয়াটিকে জীবনের এক বড় পাওয়া মনে করেন নূরুন্নাহার। বলেন, চাওয়া-পাওয়ার আর কিছু নেই। কৃষিকাজ করে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত হয়েছি, সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারছি, এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে?

আমি উপস্থিত আমার সহকর্মীদের বললাম, এতক্ষণ আমরা যা শুনলাম এর চেয়ে বড় বিনোদন বা উজ্জীবিত হওয়ার মতো আর কী হতে পারে? কথায় কথায় ভুলেই গিয়েছিলাম, নূরুন্নাহার কি কোনো কাজে এসেছেন? জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, কাজে আসিনি তবে আপনার সঙ্গে দীর্ঘদিন দেখা করিনি মনে মনে এ অপরাধ নিয়েই এসেছি। নূরুন্নাহার বললেন, ‘১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী আমাকে যথেষ্টই ভালোবাসেন। আমার নানা বিষয়ের খোঁজখবর নেন। আমি বলেছি, আমার সব সাফল্যের পেছনে শাইখ সিরাজের অনেক বড় অবদান। তিনি বললেন, যার এত বড় অবদান, তার সঙ্গে কি যোগাযোগ রাখো? বললাম, অনেক দিন দেখা হয় না। তিনি বললেন, তার সঙ্গে দেখা কর। তিনি এবার স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি কৃষি ও কৃষকের জন্য অনেক ভালো কাজ করছেন।’  নূরুন্নাহার সহজ-সরল মানুষ। ছুটে এসেছেন আমার কাছে। আমার শুধু মনে হলো আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথা। একজন সফল কৃষক তার কাছে এত বেশি গুরুত্বের, এত বেশি সম্মানের। মনে হলো, একজন কৃষকের জন্য এর চেয়ে মর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসের আর কী হতে পারে? প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে আমিও যারপরনাই সম্মানিত হলাম। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার চাবিকাঠি যে কৃষকদের হাতে, তারা যদি সম্মানিত হন, মর্যাদা পান, ভালো থাকেন তাহলে বাংলাদেশকে কেউ পিছিয়ে রাখতে পারবে না।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর