শনিবার, ২ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

আদর্শে অবিচল থাকতে হবে

বাহালুল মজনুন চুন্নু

আদর্শে অবিচল থাকতে হবে

দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে থাকা এক অবিচ্ছেদ্য নাম, আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা এক অমলিন ছাত্র সংগঠনের নাম ছাত্রলীগ। পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে  হত্যা করা হলে সেই হত্যার বিরুদ্ধে গগনবিদারী প্রতিবাদ করেছিল তাঁরই হাতে গড়া ছাত্রলীগ। পঁচাত্তর-পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নানা ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপটে যখন বহুধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল তখন এ ছাত্রলীগই হয়েছিল আওয়ামী লীগের মূল শক্তি। বর্তমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সভাপতি আর আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ১৯৭৮ সালে নির্বাচিত হয়ে কঠিন সেই দুঃসময়ে সারা বাংলাদেশের ছাত্রলীগকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলাম। যার প্রমাণ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন রাজপথে লাখ লাখ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর ঢল। নির্যাতন-নিপীড়ন, জেল-জুলুমের পরোয়া না করেই ছাত্রলীগ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে, গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলনে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সরকারের জনবিরোধী কাজের প্রতিবাদী আন্দোলনে রাজপথ কাঁপিয়েছে। ছাত্রলীগ আমার প্রাণাধিক প্রিয় সংগঠন। রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল এ সংগঠনের কর্মী হিসেবে। যৌবনের পুরোটা সময় ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে নানা আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছি, নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করেছি। জীবনের যত আনন্দ-বেদনার কাব্য রচিত হয়েছে তার বেশির ভাগই হয়েছে ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে। তাই এ সংগঠনটির প্রতি ঠিক আগের মতো এখনো ভালোলাগা, ভালোবাসা হৃদয়ে অনুভব করি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ছাত্রলীগের নামে আজ দুর্নাম রটেছে। যে ছাত্রলীগ নিয়ে সবাই গর্ব করত, সেই ছাত্রলীগের নামে পত্রিকার পাতায় নেতিবাচক শিরোনাম লেখা হচ্ছে। যখন প্রাণপ্রিয় এ সংগঠনটি নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হয়, তখন হৃদয় মুষড়ে পড়ে। ছাত্রলীগের একজন সাবেক কর্মী হিসেবে আমার উপলব্ধি হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কোনো ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর পক্ষে কোনো ধরনের অন্যায় কাজ করা সম্ভব নয়। তাহলে এই যে ছাত্রলীগ নিয়ে কুৎসা রচিত হচ্ছে এর কারণ ছাত্রলীগের মধ্যে ঢুকে পড়া অনাহূত সেসব আগাছা; যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করে না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না। আদর্শ যেখানে নেই, চেতনা যেখানে নেই; নৈতিকতা সেখানে সুদূরপরাহত। তাই অনাহূত ছদ্মবেশী আগাছারা সংগঠনে ঢুকে নানা কুকর্ম করে সংগঠনটির গায়ে কালিমা লেপন করে চলেছে। এরা খুনোখুনি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অপহরণ, ধর্ষণ, শিক্ষক লাঞ্ছনা, প্রশ্ন ফাঁস, অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানা সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত থেকে এ গৌরবান্বিত সংগঠনটির ঐতিহ্য নষ্ট করার চেষ্টা করছে। এদের থেকে ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনটির নেতা-কর্মীকে সতর্ক থাকতে হবে। নতুন কর্মীকে সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার আগে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে। না হলে ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে ছদ্মবেশী ভিন্নমতাবলম্বীরা নানা কুকর্ম করে এ সংগঠনটিকে আরও বিতর্কিত করে তুলবে।  অবশ্য অনেক সময় সাম্প্রদায়িক শক্তি ও ষড়যন্ত্রকারীদের অপপ্রচারের শিকারও হচ্ছে ছাত্রলীগ। এ ক্ষেত্রে অনেক গণমাধ্যমও তিলকে তাল করে প্রচার করে আসছে। এসব বিষয়ে ছাত্রলীগকে সদা সতর্ক থাকতে হবে। কেউ যেন কোনো অপপ্রচারের সুযোগ না পায় সেদিকে ছাত্রলীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীকে সজাগ থাকতে হবে। ছাত্রলীগের ঐতিহ্য আছে, আদর্শ আছে, নিজস্ব চেতনা আছে, গর্ব করার মতো হাজারো ঘটনা আছে। গৌরব ও ঐতিহ্যের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে এর প্রত্যেক নেতা-কর্মীকে সজাগ থাকতে হবে। যারা ছাত্রলীগের নামে সংগঠন পরিপন্থী কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।

নেতৃত্বের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এ প্রতিযোগিতাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এবারের ২৯তম জাতীয় সম্মেলনে অনেকেই শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত হতে চেয়েছিল। তার মধ্য থেকে দুজন পেরেছে। এ দুজনকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। তাই বলে বাদবাকিদের হতাশগ্রস্ত হলে চলবে না। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রায়শই একটা কথা বলেন, রাজনীতিতে নিজে কী পেলাম আর কী পেলাম না এমন হিসাব কষলে চলবে না। রাজনীতি গণমানুষের কল্যাণের জন্য। এ সত্যটা হৃদয়ে ধারণ করতে পারলে যে যেই অবস্থানেই থাকুক না কেন, সেই অবস্থানে থেকেই মানুষের কল্যাণে কাজ করতে পারবে। তাই পদ পেলাম না বলেই সব শেষ হয়ে গেল এমন না ভেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল নেতা-কর্মীদের উচিত হবে শীর্ষপদে অধিষ্ঠিতদের সহায়তা করা। তা ছাড়া একটি পথ বন্ধ হলে আরও অনেক পথ খুলে যায়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। ছাত্রলীগ ছাড়া এর অনেক অঙ্গসংগঠন, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন আছে, এ চিন্তা করে দেশ, দলের জন্য কাজ করে যেতে হবে। ভেঙে না পড়ে ধৈর্যের সঙ্গে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আর শীর্ষপদ অর্জনকারীদেরও উচিত হবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ না করা। অতীত ভুলে সৌহার্দ্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। শীর্ষপদে অধিষ্ঠিতদের কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে যাতে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের কেউ কোনোরকম অন্যায় কাজের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ে। কেউ করলে নিতে হবে কঠোর-কঠিন সিদ্ধান্ত। এটা নির্বাচনের বছর। চারদিকে ওত পেতে থাকা পাকিস্তানি দোসররা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবিশ্বাসী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি নানা ষড়যন্ত্র করবে, এ ষড়যন্ত্রের বিষয়েও ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতা-কর্মীকে সতর্ক থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে সব ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে ছাত্রলীগকে। শীর্ষপদধারী থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে ছাত্রলীগের সব নেতা-কর্মীকে সব অন্যায় থেকে দূরে থাকতে হবে। দেশ ও দলের প্রয়োজনে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ বিসর্জন দিতে হবে। ছাত্রলীগকে বই পড়ার প্রতি অধিক মনোযোগী হতে হবে। তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের খুঁটিনাটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ কর্মীদের অধ্যয়নের প্রতি উৎসাহিত করতে শীর্ষ নেতৃবৃন্দকেই প্রেরণামূলক নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাহলে ছাত্রলীগের সব নেতা-কর্মী বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে এবং ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হবে না।  ছাত্রলীগ নিয়ে পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে সর্বত্রই যে সমালোচনা চলছে সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী সবাইকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। তাদের দেখিয়ে দিতে হবে ছাত্রলীগ কোনো অন্যায় করে না, কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপসও করে না, বরং ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা সমুন্নত রাখতে বদ্ধপরিকর; তাহলেই ছাত্রলীগ হয়ে উঠবে অতীতের মতোই গৌরবোজ্জ্বল।

লেখক : সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর