রবিবার, ৮ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

আমেরিকার রাজনীতিতে বাংলাদেশি মুখ

শামীম আল আমিন

ব্রিটেনের রাজনীতিতে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ এবং সাফল্য অর্জনের পরিসংখ্যান দেখলে মনটাই ভালো হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক, রুপা হক এবং রুশনারা আলী এ মুহূর্তে দেশটির পার্লামেন্টের সদস্য। বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় ও অন্যান্য নির্বাচনে দেশটিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের সাফল্য নজর কাড়ার মতো। তবে সেই হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বাংলাদেশিদের অবস্থান এখনো দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরার মতো নয়। যদিও স্থানীয় পর্যায়ে অনেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিজয়ীও হয়েছেন। কিন্তু দেশের জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে সাফল্যের প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশের নামটি প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল হ্যানসেন ক্লার্কের মাধ্যমে। তিনিই এখনো ‘একমাত্র’ হয়েই আছেন। মিশিগানের ১৩তম কংগ্রেশনাল ডিস্ট্রিক্ট থেকে ইউএস কংগ্রেসের সদস্য হয়েছিলেন তিনি। ডেমোক্র্যাটিক দল থেকে হাউস মেম্বার হিসেবে ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন এই বাংলাদেশি আমেরিকান। এর আগে তিনি মিশিগান হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের সদস্যও ছিলেন। হ্যানসেন ক্লার্কের জন্ম মিশিগানের ডেট্টয়েটে। তার বাবা মোজাফফর আলী হাশিম অভিবাসী হিসেবে এসেছিলেন সিলেটের বিয়ানীবাজার থেকে। তবে তার মা থিলমা ক্লার্ক ছিলেন আফ্রিকান আমেরিকান। বাবার কারণেই দেশটির জাতীয় পর্যায়ে এখনো একমাত্র বাংলাদেশি আমেরিকান হিসেবে হ্যানসেন হাশিম ক্লার্কের নামটিই কেবল শোনা যায়। এরপর সেই অর্থে এত বড় সাফল্য আর আসেনি। তবে ২০১৬ সালের নির্বাচনে অনেকটাই কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন ড. রশীদ মালিক। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রাইমারির বাধা পেরিয়ে তিনি কংগ্রেসম্যান পদে চূড়ান্ত লড়াইয়ে নেমেছিলেন। রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থীর সঙ্গে শেষ পর্যন্ত পেরে না উঠলেও, বেশ আশা জাগিয়েছিলেন তিনি। জর্জিয়ার আটলান্টা থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পেয়েছিলেন তিনি। 

আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এশিয়া-প্যাসিফিক কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন ড. নীনা আহমেদ। ছিলেন পেনসিলভেনিয়ার ফিলাডেলফিয়া শহরের ডেপুটি মেয়র। সেই পদ ছেড়ে পেনসিলভেনিয়া স্টেটের লেফটেন্যান্ট গভর্নর পদে লড়াইয়ে নেমেছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি স্টেটের মধ্যে পেনসিলভেনিয়াসহ ১৮টিতে চার বছর মেয়াদে লেফটেন্যান্ট গভর্নর পদে সরাসরি নির্বাচন হয়। বাকিগুলোতে গভর্নরের রাটিংমেট হিসেবে লড়াই করেন এই পদের প্রার্থীরা। নীনা আহমেদ ডেমোক্র্যাট প্রাইরামিতে হেরে গেলেও, পাঁচজন প্রার্থীর মধ্যে ২৪ শতাংশ ভোট পেয়ে হয়েছিলেন দ্বিতীয়। ১৫ মে হয়ে যাওয়া ওই প্রাইমারি ভোটে নীনা পেয়েছেন ১ লাখ ৭৫ হাজার  ৩৬৮ ভোট। চলতি বছর নিউইয়র্ক স্টেট থেকে ইউএস কংগ্রেসে প্রার্থী হয়েছিলেন মিজান চৌধুরী। তিনিই প্রথম কোনো বাংলাদেশি আমেরিকান যিনি নিউইয়র্ক থেকে ইউএস কংগ্রেসের সদস্য হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। কেবল ঘোষণা দিয়েই বসে থাকেননি; কংগ্রেশনাল ডিস্ট্রিক্ট-৫ এর জন্য রীতিমতো জমজমাট প্রচারণায় নেমে পড়েছিলেন তিনি। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ডেমোক্র্যাট পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশী মিজান চৌধুরী জয় লাভ করতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য সবার আগে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করতে হয়। তার জন্য একটি প্রাইমারি ভোট হয়। গত ২৬ জুন সেই প্রাইমারির বাধা পেরুনো সম্ভব হয়নি মিজান চৌধুরীর পক্ষে। তবে তার এই অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে অনেক বাংলাদেশি আমেরিকান অনুপ্রেরণা পাবেন, এমনটাই বলছেন বিশ্লেষকরা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমেরিকায় বেশির ভাগ বাংলাদেশি-আমেরিকানই ডেমোক্র্যাট দলের সমর্থক। সেই অর্থে রিপাবলিকান দলের সমর্থক বলতে গেলে, হাতেগোনা। তাও কেবল সমর্থক পর্যায়েরই বলা যায়। কর্মী কিংবা নেতা নেই। এদিকে নিউইয়র্কের আইনসভার সিনেটর পদে লড়াই করার ঘোষণা দিয়েছিলেন অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি সেই দৌড় থেকে সরে দাঁড়ান। মিশিগান হাউসের ডিস্ট্রিক্ট ৪ থেকে সায়ীদ রব প্রার্থী হয়েছেন। তবে একটি আশার খবর হচ্ছে, জর্জিয়ার স্টেট সিনেট-৫ থেকে এরই মধ্যে ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিতে বিজয়ী হয়েছেন শেখ রহমান। এখন তিনি চূড়ান্ত লড়াইয়ে নামবেন রিপাবলিকান প্রার্থীর বিপক্ষে। অনেকেই আশাবাদী তিনি সেখানে বিজয়ী হবেন।

নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের গত নির্বাচনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত দুই প্রার্থী ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারির লড়াইয়ে নেমেছিলেন। তারা হলেন হেলাল শেখ এবং তৈয়েবুর রহমান। শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হতে না পারলেও, দুজনই বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন সেই নির্বাচনে।

তবে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশি আমেরিকানদের বিজয়ী হওয়ার রেকর্ডও রয়েছে। নিউ জার্সির পেটারসনের সেকেন্ড ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলম্যান শাহীন খালেক। ওই স্টেটের বরো অব হেলডনের কাউন্সিলম্যান তাহসিনা আহমেদ। এ ছাড়া প্লেইন্সবরো টাউনশিপের কাউন্সিলম্যান ড. নূরন নবী। তারা তিনজনই বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। সেই তালিকায় আরও আছেন পেনসিলভেনিয়ার ফিলাডেলফিয়ার কাছের আপার ডারবির কাউন্সিলম্যান শেখ সিদ্দিক, কাউন্সিলম্যান নুরল হাসান, মিলবোর্ন সিটির কাউন্সিলম্যান মনসুর আলী, আপস্টেট নিউইয়র্কের হাডসন সিটির কাউন্সিলম্যান শেরশাহ মিজান, মিশিগান স্টেটের হ্যামট্রমিক সিটির কাউন্সিলম্যান আবু আহমেদ মুসা। আরও কয়েকজন আছেন স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন নির্বাচনে যারা বিজয়ী হয়েছেন। এ তালিকার কয়েকজন চলতি বছর আবারও প্রাইমারি অর্থাৎ বাছাই নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয় পেয়েছেন। এদিকে নিউইয়র্ক সিটির পাঁচ বরোর মধ্যে ব্রুকলিন, ব্রঙ্কস ও কুইন্সের কমিউনিটি বোর্ডে এখন প্রায় দুই ডজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কুইন্স কমিউনিটি বোর্ডে ১৪ জন কাজ করছেন। যদিও এই পদটি অবৈতনিক, তবুও এ দেশের রাজনীতিতে অংশ নিতে আগ্রহীরা এখান থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।

আমেরিকায় বসবাসকারী বাংলাদেশিদের বড় একটি অংশ এ দেশে এসেও নিজ দেশের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এখানেও তারা হয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি কিংবা অন্য কোনো দলের রাজনীতি করেন। এ দেশের রাজনীতির সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় নেই। কোথায় কী ঘটছে, কোথায় কোথায় তাদের অধিকার আছে; কী করলে এগিয়ে যাওয়া যাবে; অনেকেরই ধারণা নেই। বেশির ভাগই থাকতে চান একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির ভিতরে। হয় তারা দেশের রাজনীতি ছাড়তে পারেন না; নয়তো এ দেশের রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার সাহস পান না। অথচ আমেরিকা একটি উদারনৈতিক সমঅধিকারের দেশ। এখানে রয়েছে অবারিত সুযোগ। কেউ এ দেশে জন্মালে আর চেষ্টা করলে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হতে পারেন। আর কোনো পদের জন্যই এ দেশে জন্মগ্রহণ করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে যার যেখানে সুযোগ রয়েছে, সেখানে চেষ্টা করতে হবে। নিজেদের যোগ্য করে তুলতে হবে। চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। নিজেদের সন্তানদের বোঝাতে হবে এ দেশটি তাদের। দেশটির প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। দেশের প্রতি অধিকার জন্মাতে হবে। বড় স্বপ্ন দেখতে হবে। সবার মধ্যেই সম্ভাবনার আগুন থাকে; সে আগুনকে জ্বালাতে হবে। এরই মধ্যে অনেকেই সেই স্বপ্ন দেখছেন। অনেকে সফল হয়েছেন। তাহলে নিশ্চয়ই আরও অনেক দূর যাওয়া সম্ভব।

লেখক : হেড অব নিউজ, টিবিএন২৪ টেলিভিশন, নিউইয়র্ক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর