বুধবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মাদকাসক্তি ভয়াবহ একটি রোগ

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী

মাদকাসক্তি ভয়াবহ একটি রোগ

সিগারেট থেকে নেশা শুরু করলেও মাদকের প্রতি আসক্তি ধীরে ধীরে শুরু হয়। বেশির ভাগই শুরু হয় বন্ধুবান্ধবের সাহচর্যে। মূলত মাদক কেনার অর্থ জোগাড় করতে গিয়েই কিশোর-তরুণরা ব্যাপকভাবে নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এ সুযোগে মাদক ব্যবসায়ী, সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ নানা কাজে তাদের ব্যবহার করতে থাকে। মাদকের এই নেশার জালে একবার জড়িয়ে পড়লে কেউ আর সহজে বেরিয়ে আসতে পারে না। ফলে মাদকসেবীরা দিনে দিনে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আমাদের দেশে কিশোর সন্ত্রাসীর ক্রমবর্ধমান দাপটের যে তথ্য সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তার মূল কারণ সম্ভবত নিহিত রয়েছে এখানেই। দেশের সর্বত্র সন্ত্রাসী কার্যক্রম স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের নানাভাবে উত্ত্যক্ত করা, গুলি বা ছুরিকাঘাতে হত্যা করা কিংবা সড়ক দুর্ঘটনার আধিক্যের পেছনেও মাদকাসক্তির ভূমিকা অন্যতম।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে ড্রাগ হলো এমন বস্তু যা গ্রহণ করলে ব্যক্তির এক বা একাধিক কার্যকলাপের পরিবর্তন ঘটায়। একটা ড্রাগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নির্ভর করে তার রাসায়নিক গঠন-বৈশিষ্ট্যের ওপর। এই ড্রাগ অপব্যবহারের কারণে রোগী তার রোগের জন্য ওষুধের গুণ পাওয়ার বদলে পায় বিষ। তাই অনেক সময় বিষ স্বল্পমাত্রায় প্রয়োগ করলে হয় ওষুধ, কিন্তু বেশি মাত্রা বা অযথা গ্রহণ করলে হয় বিষাক্ত যা শরীরকে নিস্তেজ করে, মৃত্যু ডেকে আনে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই অপব্যবহারের মাধ্যমে মাদকাসক্তির সূচনা হয়। অপব্যবহার থেকে অভ্যাস, অভ্যাস থেকে আসক্তি। বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে প্রায় ৬৮ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত। এর মধ্যে ৮৪ ভাগ পুরুষ, ১৬ ভাগ নারী। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু-কিশোররাও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া তথ্যানুযায়ী দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭৫ লাখ। আসক্তের শতকরা ৯০ ভাগকে কিশোর-তরুণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তার শতকরা ৪৫ ভাগ বেকার ও ৬৫ ভাগ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট। আর উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা ১৫ শতাংশ। তবে আরও বেশ কয়েকটি সংস্থার তথ্যানুযায়ী অবৈধ মাদকদ্রব্য আমদানির জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটিরও বেশি টাকার মুদ্রা বিদেশে পাচার হচ্ছে।

মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্তি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, বর্তমানে এই প্রভাব অতটা বোঝা না গেলেও সুদূরপ্রসারী অনেক প্রভাব রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। একটি সময় ছিল যখন সমাজের বিত্তশালী পরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এর আসক্তি ছিল কিন্তু বর্তমানে তা ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। বেসরকারি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, মাদকসেবীরা গড়ে প্রতিদিন অন্তত ২০ কোটি টাকার মাদক সেবন করে, হিসাব অনুযায়ী মাসে ৬০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে সারা দেশে প্রায় ৩০ লাখ মাদক ব্যবসায়ী প্রতিদিন কমপক্ষে প্রায় ২০০ কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা করে। আরও একটি ভয়ঙ্কর চিত্র হচ্ছে, সারা দেশের ছড়িয়ে পড়া ইয়াবার শতকরা ৮৫ ভাগই ভেজাল; যার ফলে এসব ইয়াবা গ্রহণকারী মাদকাসক্ত নানান ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তার মধ্যে কিডনি, লিভার ছাড়াও মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী শতকরা ৮০ ভাগ খুনের সঙ্গে মাদকাসক্তরা জড়িত।

মাদকাসক্তি হলো সব সন্ত্রাস ও অপরাধের জনক। একজন মানুষ যখন অন্ধকারের ভুবনে পা বাড়ায় তখন সে প্রথম সিঁড়ির যে ধাপটিতে পা রাখে তা মাদকদ্রব্য। এ মাদকদ্রব্য তাকে টেনে নেয়, উৎসাহিত করে পরবর্তী ধাপগুলো পেরিয়ে যেতে। ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের মাদক ব্যবসা ও প্রাপ্তির সহজলভ্যতা বেশি এবং বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তরুণসমাজ এদিকে ঝুঁকেছেও বেশি; ঠিক যেমনটি প্রত্যাশা মাদক ব্যবসায়ীদের। বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত বহু সরকারি ও বেসরকারি সমীক্ষায় পাওয়া তথ্যে প্রকাশ করা হয়, হেরোইন পাচারের জন্য এ দেশকেই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে করছে পাচারকারীরা। কমপক্ষে দেশের ৩০টি রুট দিয়ে স্থল ও নৌপথে এ দেশে মাদক প্রবেশ করে বিমান ও জাহাজে করে পৌঁছে যাচ্ছে উন্নত বিশ্বে, বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে বাজার বা গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের তথ্য বলছে, শুধু ভারত থেকেই আসে সাড়ে ৩ কোটি টাকার মাদকদ্রব্য। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসে ফেনসিডিল। এ ছাড়া অন্য একটি সূত্র জানায়, দেশের ৫১২টি পয়েন্টে প্রতিদিন হেরোইন, আফিম, প্যাথেডিন, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক বিক্রি হয়। সংঘবদ্ধ চোরাকারবারি চক্র সব সময় বেপরোয়াভাবে ফেনসিডিল আনছে। বাস, ট্রাক, ট্রেনে সে ফেনসিডিল ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী একজন মাদকাসক্ত তার নেশার পেছনে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৫০০ থেকে সর্বনিম্ন ৫০ টাকা খরচ করে। তবে বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই দৈনিক খরচ ১০০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। পক্ষান্তরে এ নেশার টাকার জোগান দিতে আসক্তরা বেছে নেয় বিভিন্ন অন্যায় পথ। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে খুন, ছিনতাই, ডাকাতির মতো ঘটনা। নেশার জন্য বাবা খুন হচ্ছেন সন্তানের হাতে। সেই খুনের দায় বহন করে ছেলেটি হয় জেলে না হয় অন্ধকার জগতে প্রবেশ করছে। এভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে মাদক মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে অবাধ ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকা-ে। এখানেই শেষ নয়, ৪০ বছর বয়সের পরে আকস্মিক মৃত্যুর ৫০ শতাংশই ঘটে মাদকাসক্তির কারণে। আর সেই লোকটি মৃত্যুর আগে রেখে যায় কিছু উত্তরসূরি। মাদকাসক্তের ৫৯ শতাংশই আসে এমন পরিবার থেকে যাদের মাসিক আয় ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী মাদকাসক্তের ৩০ শতাংশই শুধু নেশার খরচ জোগান দিতেই নানা অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ে। এসব জরিপে যে তথ্যটি সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ও ভয়ের কারণ, তা হচ্ছে দেশে মাদকাসক্তের ৯১ শতাংশই কিশোর-তরুণ ও যুবক বয়সী। আর এ আসক্তির ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে ছাত্র ও শিক্ষিত বেকারদের মধ্যে।

জীবনীশক্তি ধ্বংসকারী ইয়াবা সেবনকারীরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছে এবং যৌনশক্তি হারিয়ে ফেলেছে চিরতরে। কিডনিসংক্রান্ত নানা জটিলতায়ও ভুগছে তারা। বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন  ইয়াবা আসক্তদের ওপর পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা এসব তথ্য জানিয়েছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে প্রায় ১৫ হাজার মাদকাসক্ত রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৯ হাজার ইয়াবাসেবী। একটানা মাত্র দুই-আড়াই বছর ইয়াবা সেবনের ফলেই তারা মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাদের নার্ভগুলো সম্পূর্ণ বিকল হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে দেশে ইয়াবা আসক্তির সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। সর্বনাশা মাদকের কারণে যুবসমাজ যে শুধু মেধাশূন্য হচ্ছে তাই নয়, এই মাদকাসক্তদের মধ্যে মনুষ্যত্ব লোভ পাচ্ছে।

অন্যদিকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে ঢাকা শহরে মাদকাসক্ত শিশুর প্রায় ৩০ শতাংশ ছেলে এবং ১৭ শতাংশ মেয়ে। ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ছেলে ও মেয়ে শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন জানায়, মাদকাসক্ত ৮০ শতাংশ পথশিশু মাত্র সাত বছরের মধ্যে অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি জরিপের হিসাব অনুযায়ী মাদকাসক্ত শিশুদের ড্রাগ গ্রহণ ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত ৪৪ শতাংশ পথশিশু, পিকেটিংয়ে জড়িত ৩৫ শতাংশ, ছিনতাইয়ে ১২ শতাংশ, মানব পাচার সহায়তা কাজে ১১ শতাংশ, দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের সহায়তাকারী হিসেবে ৫ শতাংশ ও অন্যান্য ভ্রাম্যমাণ অপরাধে জড়িত ২১ শতাংশ। এ ছাড়া বোমাবাজিসহ অন্যান্য সহিংস কর্মকা-ে জড়িত ১৬ শতাংশ পথশিশু। সম্প্রতি আমাদের দেশের সংবাদপত্রে প্রতিদিন খুন, সন্ত্রাস, মেয়েদের উত্ত্যক্তসহ যেসব অপরাধের খবর ছাপা হচ্ছে তার সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে দেশের তরুণ ও যুবসমাজ এর একটি অংশ ।

বাংলাদেশের শহর-জনপদের ধনী পরিবারের সন্তানদের মধ্যে সম্প্রতি ইয়াবা আসক্তির যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে তা সমগ্র জাতির জন্য এক ভয়াবহ পরিণতির ইঙ্গিতবাহী। ইয়াবা কেবল আমাদের তরুণ প্রজন্মের প্রাণশক্তি ও মেধাকে ধ্বংস করছে না, ইয়াবার কারণে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অপসংস্কৃতি ও অপরাধের বিস্তার ঘটছে।

পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, দিন দিন ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। আসক্ত তরুণ-তরুণীরা অধিকাংশ উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। মাদকাসক্তি প্রতিরোধের সর্বাপেক্ষা কার্যকর উপায় হচ্ছে মাদকদ্রব্য ও মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা। মাদকদ্রব্যের অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করা, মাদক ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা, বেকারদের কর্মসংস্থান ও স্কুল-কলেজে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাদকাসক্তির কুফল সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত

প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি— মানস সদস্য, জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত টাস্কফোর্স সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড 

E-mail : [email protected]

সর্বশেষ খবর