শুক্রবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি ইমাম হোসাইন (রা.)

মাওলানা মুহম্মদ জিয়াউদ্দিন

মহররম মাসের ১০ তারিখে রসুল (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.)সহ নবী পরিবারের বহু সদস্য ও সাথীবর্গসহ মোট ৭২ জন শাহাদাতবরণ করেন। ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল ৬১ হিজরির ১০ মহররম শুক্রবার। রসুল (সা.) এর নাতি হিসেবে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রতি সব মুমিনের অফুরন্ত ভালোবাসা রয়েছে। কোরআন হাদিসে আহলে বায়েত ও ইমাম হোসাইনের (রা.) বিশেষ মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। তাদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ ইমানের পরিচায়ক হিসেবেও নির্ধারিত হয়েছে। আহলে বায়েতের ফজিলত সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন— ‘হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের পূর্ণরূপে পূত পবিত্র রাখতে।’ (সূরা আহজাব : ৩৩)। সূরা আলে ইমরানের ৬১ নম্বর আয়াতেও আহলে বায়াতের বিশেষ মর্যাদার আভাস দেওয়া হয়েছে।

হজরত যাবের (রা.) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, আমি আরাফার দিবসে রসুলুল্লাহ (সা.)-কে তার কাছওয়া নামক উটের ওপর বসে খুতবা দিতে শুনেছি। তিনি বলেন, ‘হে মানব সকল আমি তোমাদের নিকট যা রেখে যাচ্ছি, যদি তোমরা এগুলো আঁকড়ে ধরো বা প্রতিপালন করো তাহলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তার মধ্যে এক হলো আল্লাহর কিতাব (কোরআন) এবং অপরটি হলো আমার আহলে বায়েত।’

রসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘হোসাইন আমার থেকে আর আমি হোসাইন থেকে।’ (ইবনে মাজাহ)।

ইয়াজিদ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ইমাম হোসাইন (রা.) তার হাতে বায়াত গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। ইয়াজিদ ছিল দুশ্চরিত্র, বেনামাজি ও মদ্যপায়ী। হজরত হাসান ও হজরত মুয়াবিয়ার (রা.) ইন্তেকালের পর খিলাফতের ন্যায়সংগত দাবিদার ছিলেন হোসাইন (রা.)। নীতিজ্ঞানহীন ইন্দ্রিয়পরায়ণ ইয়াজিদের কাছে জীবনের বিনিময়েও হজরত হোসাইন (রা.) মস্তক অবনত করতে রাজি ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন পাপীষ্ট ইয়াজিদের বায়াত গ্রহণ করলে ইসলামের গুরুত্ব ক্ষুণ্ন হতে পারে। তার দেখাদেখি অন্যান্য অনুসারীও ইয়াজিদের কাছ থেকে বায়াত নেবেন। ইমাম হোসাইন (রা.) অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসীন ইয়াজিদের বায়াত না নিয়ে বাতিলের সামনে মাথানত না করার অসীম সাহসিকতা দেখিয়েছেন। ঘটনা প্রবাহের সে সময় কুফাবাসী ইমাম হোসাইন (রা.)-কে চিঠির মাধ্যমে সেখানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। ইয়াজিদ শাসনের মোকাবিলায় তার হাতে বায়াতের অঙ্গীকার করে বিপুল সংখ্যাক চিঠি ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কাছে প্রেরণ করা হয়। তারা ইমাম হোসাইন (রা.)-কে খিলাফতের অধিক যোগ্য, তার জন্য জানমাল কোরবানির জন্য প্রস্তুত এবং আহলে বায়াতের অনুরক্ত এমন পয়গাম পাঠায়। তাদের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য হোসাইন (রা.) আপন চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিলকে কুফায় পাঠান। কুফার গভর্নর নুমান বিন বশিরসহ ৪০ হাজার মানুষ মুসলিমের হাতে হোসাইন (রা.)-এর নামে বায়াত নেন। পরিস্থিতি হোসাইন (রা.) এর অনুকূলে এমন বর্ণনা দিয়ে একজন পত্রবাহককে চিঠি দিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.)-কে কুফায় আসতে অনুরোধ করা হয়। কুফাবাসীর অস্থির চিত্তের জন্য ইবনে আব্বাস (রা.)সহ অনেকের বাধা সত্ত্বেও ৬০ হিজরির ৮ জিলহজ পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব ও প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশে রওনা দেন। পথিমধ্যে হোসাইন (রা)-এর চাচাতো ভাই আবদুল্লাহ জাফর সাক্ষাৎ করে মদিনার গভর্নর কর্তৃক প্রদত্ত নিরাপত্তা সনদের ভিত্তিতে মদিনায় ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি বলেন, আমি স্বপ্নে নানাজির সাক্ষাৎ পেয়েছি। তিনি আমাকে একটি কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। ফলাফল যাই হোক না কেন, আমি অবশ্যই তা করব আর কাজটি কী, সে সম্পর্কে মৃত্যুর আগে আমি কাউকে কিছু বলতে পারি না। ‘যি জাশাম’ নামক স্থানে উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের পক্ষ থেকে হুর ইবনে ইয়াজিদ ইমাম হুসাইনের পথ রোধ করে এবং ইমাম কাফেলার সামনে ছাউনি ফেলে। হুর ইবনে ইয়াজিদ ইমাম হোসাইন (রা)-কে তাদের সঙ্গে যেতে বাধ্য করে। ইমাম হোসাইন (রা.) তাদের সঙ্গে চললেন। ৬১ হিজরির ৯ মহররম বৃহস্পতিবার দিন ইমাম হোসাইন (রা.) তার সঙ্গী-সাথীসহ কারবালা প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন। কারবালায় অবস্থানরত দ্বিতীয় দিনে আমর ইবনে সা’দ চার হাজার সৈন্য নিয়ে ইবনে যিয়াদের পক্ষ থেকে কারবালায় পৌঁছে।

ইয়াজিদ বাহনীর পক্ষ থেকে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১০ মহররম ইমাম হোসাইন (রা.) পরিবার-পরিজন ও সাথীবর্গ নিয়ে জালিমদের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হন এবং একে একে হোসাইন (রা.)সহ ৭২ জনের সবাই শাহাদাতবরণ করেন। পরিবারের নারী ও শিশুসহ বাকি ১২৮ জন সদস্য বন্দী হন। ১০ মহররম কারবালার ময়দানে ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথানত না করে যে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা ইমানদারদের জন্য অনুসরণীয়।

লেখক : ইসলামী গবেষক।

সর্বশেষ খবর