শিরোনাম
রবিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

এই দিন দিন নয় আরও দিন আছে

নঈম নিজাম

এই দিন দিন নয় আরও দিন আছে

গণফোরাম গঠনের সময় আমি ভোরের কাগজের রিপোর্টার। সৈয়দ বোরহান কবীর আর আমি ড. কামাল হোসেনের মতিঝিল অফিসে গেলাম। এরপর ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের অফিসে। ব্যারিস্টার আমীর তখন মতিঝিলে বসেন। শুরুটাতে উত্তাপ ছিল। কারণ, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, পংকজ ভট্টাচার্য, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিকসহ ডান-বামের বিশাল রাজনৈতিক একটি গ্রুপ ছিলেন কামাল হোসেনের সঙ্গে। সেই সময় দেশজুড়ে তোলপাড়। সবার ধারণা ছিল, কামাল হোসেন এবার একটা কিছু করবেন। এর মাঝে যুক্ত হলেন মোস্তফা মহসীন মন্টুর মতো সাহসী সাংগঠনিক দক্ষ নেতা। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের একটি বড় অংশ তখন মন্টুর সঙ্গে। বিশেষ করে ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের একটি গ্রুপ। কিন্তু এই গ্র“প বেশি দিন থাকেনি। তারুণ্যকে আকর্ষণ করানোর মতো কর্মসূচি ছিল না বলেই সবাই আবার ফিরে আসে আওয়ামী লীগে, ছাত্রলীগে। ফিরে এসে এর মাঝে কেউ কেউ এমপি হয়ে এই সংসদেও রয়েছেন। অন্যদিকে জাতীয় নেতাদের যারা গণফোরামে গেলেন এক পর্যায়ে তাদের অনেকেই রাজনীতি থেকে সরে পড়েন। একাকী হলেও হাল ছাড়েননি কামাল হোসেন। তিনি কথা বলছেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার, গণতন্ত্র, মূল্যবোধ নিয়ে। অনেকে তার এই কাজগুলোরও সমালোচনা করেন। কিন্তু আমি করি না। আমি মনে করি, কিছু বিষয়ে কিছু মানুষকে কথা বলতেই হবে। এতে রাষ্ট্রের অপকার নয়, উপকারই হয়। কামাল হোসেন এখন হঠাৎ কথা বলছেন, বিষয়টি তেমন নয়। বিএনপির সময়ও তার কঠোর বক্তব্য ছিল স্পষ্ট। এসব কারণেই ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে সম্মান করি। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে তিনি কতটা কী করতে পারবেন তা আলাদা বিষয়। এ নিয়ে অহেতুক হৈচৈ করে কী লাভ। বরং শত ফুল ফুটতে দাও। কোন ফুল কৃষক তার বাড়ির আঙিনায় লাগাবে তা কাউকে বলে দিতে হবে না। বাগানের মালি জানে, কোনটা কী ফুল। কোনটা বাজারে বিক্রি হবে, আর কোনটা আগাছা হিসেবে ঝেড়ে ফেলতে হবে।

আসলে সব কিছুর একটা সময় থাকে। বাস্তবতা থাকে। এই বাস্তবতাকে কাজে লাগাতে পারলে পরিস্থিতি বদলে যায়। ১৯৭০ সালে নির্বাচন না করা ছিল মওলানা ভাসানীর ভুল সিদ্ধান্ত। অন্যদিকে ভোট করে বাংলাদেশ স্বাধীন করে ফেললেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই ভোটই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করে। বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন ইতিহাসের মহানায়ক ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। ২০১৪ সালে একটা সুযোগ ছিল মুুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ছোট দলগুলোর জন্য। সেই সময় তারা একটা জোট করতে পারত। সেই জোট ড. কামাল হোসেন, অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্না, আ স ম আবদুর রব, সুলতান মুহাম্মদ মনসুররা নেতৃত্ব দিলে আজকের ইতিহাসে তারা নতুন একটা অবস্থান পেতেন। গত পাঁচ বছর দেশ পেত শক্তিশালী একটি বিরোধী দল। এতদিনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনেক বেশি শক্তিশালী হতো। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব তাদের কাছেও ছিল। বিএনপি ভোট বর্জনের পর সরকারের একটি মহল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। বৈঠকও হয়েছিল কারও কারও সঙ্গে। সরকারের অনুরোধ ছিল ভোটে অংশ নেওয়ার। সেই অনুরোধ কেউ নেননি। সেই দিন তারা ভোটে গেলে আজকের রাজনীতি অন্য রকম হতে পারত। অনেক বিদেশি কূটনীতিকও চেয়েছিলেন ভোটে এই দলগুলো অংশগ্রহণ করুক। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সবাই একরকম হবেন রাজনীতিতে এমন কথা নেই। সব কিছুর সঙ্গে সবাই খাপ খাওয়াতে পারবেন তাও নয়। তাই বলে অসম্মান করতে হবে কেন কাউকে? কামাল হোসেন চেষ্টা করছেন। তার রাজনৈতিক ব্যর্থতা নিয়ে বেশি কথা বলার কী দরকার? স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখা বড় কষ্টকর। রাজনীতিতে স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখতে হলে জনগণকে সঙ্গে নিতে হবে। গণমানুষের মনের কথা বলতে হবে। বিশাল সংগঠন থাকতে হবে অথবা সংগঠন তৈরি করতে হবে। মিডিয়াতে মাঠ জমানো আর বাস্তবতা অনেক কঠিন। রাজনীতির বাস্তবতা এক আলো-আঁধারীর খেলা। এই খেলা কখন কোন দিকে মোড় নেবে কেউ জানে না। কারণ অন্ধকারে হঠাৎ আলোর ঝলকানি সবাই সহ্য করতে পারে না।

স্বপ্ন সবাই দেখে। কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ অনেক বড় কঠিন কাজ। চাইলেই বড় কথা বলা যায়। বড় কাজ করা যায় না। পেশাজীবী থেকে রাজনীতিবিদ সবার জন্যই একই কথা প্রযোজ্য। তবে রাজনীতিতে সুযোগ সব সময় তৈরি হয় না। এখানে সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের ১০ ফোঁড়। ইতিহাস তাই বলে। রাজনীতিতে এখন কথা হচ্ছে ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে। এ নিয়ে কথা বেশি বলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই। কামাল হোসেন অতীতে তাদের সঙ্গে ছিলেন বলেই হয়তো তাকে ভুলতে পারছেন না। কেউ কেউ সমালোচনার পাহাড় বইয়ে দিচ্ছেন। প্রবীণ এই মানুষটিকে নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনার কিছু আছে? একজন ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগের তৈরি। জীবনে আওয়ামী লীগের রাজনীতিই বেশি সময় করেছেন। এমনকি ওয়ান-ইলেভেনের আগে তার বক্তৃতা-বিবৃতিও ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিল রেখে দেওয়া। আমি ড. কামাল হোসেনকে একজন সফল আইনজীবী মনে করি। তার রাজনৈতিক সফলতা নিয়ে অনেকের মতো আমার মনেও প্রশ্ন ছিল ও আছে। তার রাজনৈতিক সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন ইতিহাস হয়তো একদিন করবে। কিন্তু সাদা চোখে রাজনৈতিক সাফল্যের ধারবাহিকতা দেখি না।

কামাল হোসেন রাষ্ট্রপতি পদে সরাসরি ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে। সেই সময় মাঠপর্যায়ে আওয়ামী লীগের ছিল কঠিন সময়। সংগঠন ছিল মহাবিপর্যয়ে। অভ্যন্তরীণ গ্রুপিংও কম ছিল না। কামাল হোসেন তখন দলের প্রভাবশালী নেতা। শুধু রাষ্ট্রপতি নয়, সংসদ নির্বাচনেও তিনি অনেকবার অংশ নিয়েছেন। কিন্তু ’৭৩ সালের পর আর সংসদে যেতে পারেননি। আসলে ভোটের জনপ্রিয়তার মাপকাঠি আমাদের দেশে আলাদা। মানুষের পছন্দ মিরপুরের এস এ খালেক। কামাল হোসেন নন। কামাল হোসেন ভাঙাগড়ার খেলায় গণফোরাম করেছেন। চেষ্টা করছেন কিছু করার। আমরা মিডিয়া তার চেষ্টাকে তুলে ধরি। আওয়ামী লীগের ভিতরেও তোলপাড় হয়। মানুষ ভালো বলে। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে গ্রহণ করে না। সমস্যাটা এখানেই। বুঝতে হবে, রাজনীতিতে সময় থেমে থাকে না। সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সময় কামাল হোসেনের জন্য বসে নেই। রাজনীতি ধারাবাহিক স্থিরতার বিষয়। অস্থিরতা নিয়ে রাজনীতিকে ধরে রাখা যায় না। এখনকার বাস্তবতা অনেক কঠিন। এই কাঠিন্য ভেদ করার জটিলতা এই বৃদ্ধ বয়সে কামাল হোসেনের জন্য সহজ নয়। কারণ সামনে একটি ভোট। আর এই ভোটের হিসাব-নিকাশ আওয়ামী লীগ বনাম অ্যান্ট্রি আওয়ামী লীগ স্রোতকে নিয়ে। আর বিএনপি হচ্ছে বিভিন্ন মতের মানুষের একটি ক্লাব। এই ক্লাবের রাজনীতি কখন কোন দিকে মোড় নেবে বলা মুশকিল। কারণ বিএনপির ভিতরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর শক্ত অবস্থান রয়েছে। এই শক্ত অবস্থানের মানুষেরা ভোটের বাক্সে এক হয়ে যায়। এখন বিএনপি কামাল হোসেনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা থাকবেন তো?

আওয়ামী লীগ তার মিত্র চিনতে অনেক সময় ভুল করে। বিএনপি করে না। এখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষের জন্য শেষ ঠিকানা আওয়ামী লীগ। এই দলটি গণমানুষের চিন্তাকে লালন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছে। ক্ষমতার আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে নির্দিষ্ট মানুষের জন্য। বিরোধী দলের আওয়ামী লীগ ত্যাগী নেতা-কর্মীদের। আর ক্ষমতার আওয়ামী লীগে ভালো করে আগাছারা। এই আগাছাদের একটি অংশ মনে করে ক্ষমতার ছায়া থেকে আসল আওয়ামী লীগারদের দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। তাদের কাছে আসতে দিলে হাইব্রিডদের ফলন বন্ধ হয়ে যাবে। এই কারণে ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগে অভিমানী মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায়। যা ক্ষতিগ্রস্ত করে দলটিকে। সুন্দর একটি আগামী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করতে আওয়ামী লীগকে দরকার। বিভিন্ন মতের মানুষ ২০১৪ সালে ভুল রাজনীতি করেছেন। তাদের সেই ভুলের খেসারত এখন সবাইকে দিতে হচ্ছে। সে সময় রাজনীতি ছিল বিএনপির নিয়ন্ত্রণে। এবার তা নেই। তাই বিএনপি এবার ভোটে আসবে না মনে করলে ভুল করবে সবাই। বিএনপি অস্তিত্ব রক্ষা করতে এবারকার নির্বাচনে অংশ নেবে। দলের নীতিনির্ধারক মহল ইতিমধ্যে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে মনে হয়। তাই আওয়ামী লীগকে পা ফেলতে হবে সাবধানে। মাথায় রাখতে হবে পচা শামুকও পা কাটে। আর এখন বিভিন্ন ইস্যুতে আওয়ামী লীগবিরোধী একটা প্রচারণা চলছে। আমি জানি না সরকারবিরোধী প্রচারণার খবরগুলো সংশ্লি­ষ্ট মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয় জানে কি না। বিশ্বমিডিয়াতে এখন গুরুত্ব পাচ্ছে বাংলাদেশের খবর। এর মাঝে যোগ হয়েছেন শহিদুল আলম। আল-জাজিরা টিভিতে কী সাক্ষাৎকার তিনি দিলেন, আর কত মানুষ তা দেখল জানা নেই কিন্তু এখন দুনিয়াজুড়ে কথা হচ্ছে তাকে নিয়ে। তার পক্ষে লেখা হচ্ছে বিশ্বের সব মেইন স্ট্রিম পত্রিকাতে। টিভিগুলো আলাদা করে রিপোর্ট প্রকাশ করছে। সরকারের স্ট্রং ভয়েস নেই বিশ্ব মিডিয়াতে। সরকারের লোকজন শুধু দেশে নিজের মতের মানুষকে অকারণে খোঁচানো নিয়ে ব্যস্ত। বিশ্বমিডিয়ার জবাবে কাজও করতে পারে না। এর মাঝে যোগ হয়েছে ডিজিটাল আইন। এই আইনের কারণে আগামী দিনের মিডিয়া হুমকিতে পড়বে। ’৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্যবহৃত হয়েছিল বেশি আওয়ামী লীগের বিপক্ষে।

ভোটের আগে এমন একটি আইনের কী দরকার ছিল? বাংলাদেশের সাংবাদিকদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ চলছে। কোন বালির বাঁধ এই রক্তক্ষরণ বন্ধ করবে আমি জানি না। তবে আমার মনে হয়, এই দিন দিন নয় আরও দিন আছে। এই দিন নিয়ে যাবে সেই দিনের কাছে। সেই দিন ভালো হলে ভালো। না হলে এর খেসারত সবাইকে দিতে হবে।

             লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর