রবিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

পর্তুগালে প্রবাসী বাংলাদেশির কৃষি উদ্যোগ

শাইখ সিরাজ

পর্তুগালে প্রবাসী বাংলাদেশির কৃষি উদ্যোগ

কৃষি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে প্রোথিত। এ দেশের মানুষ বিশ্বের যেখানেই যাক না কেন সুযোগ পেলেই যুক্ত হয়ে যায় কৃষির সঙ্গে। বিশ্বের নানা প্রান্তের বিভিন্ন দেশে গিয়ে আমি এমনটি দেখেছি। সেই ২০০৪ সাল থেকে এখন অবধি চ্যানেল আইয়ের হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্বে উন্নত বিশ্বের নানা কৃষি কৌশল নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করে আসছি। আমি চেয়েছি এদেশের কৃষকদের উন্নত কৃষি কৌশলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। একই সঙ্গে দেশের নীতি-নির্ধারক ও সরকারের সংশ্লি­ষ্ট দফতরগুলোর কর্তাব্যক্তিদের কৃষিভাবনায় যুক্ত করতে চেয়েছি আগামীর কৃষি কৌশল। আর এ জন্য আমি গিয়েছি এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার অন্তত ৩০টি দেশে। কোনো কোনো দেশে আবার একাধিকবার যাওয়া হয়েছে। যেখানেই গিয়েছি, দেখেছি প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রবাস জীবনে একটু থিতু হলেই যুক্ত হয়েছেন কৃষির সঙ্গে। হয়ে উঠেছেন সেখানকার কৃষি উদ্যোক্তা। সেটা হয়তো মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার, কুয়েত কিংবা ওমান অথবা ইউরোপের যুক্তরাজ্য, জার্মানি কিংবা ফ্রান্স, যেখানেই হোক বাংলাদেশের মানুষের বুকে ফল-ফসল ফলানোর এক গভীর তৃষ্ণা আমি টের পেয়েছি। আর তারা অনেকটা নীরবেই ঘটিয়ে দিচ্ছেন অন্যরকম এক সবুজ বিপ্ল­ব।

গেল মাস আগস্টে ইউরোপের সর্ব পশ্চিমের দেশ পর্তুগালে গিয়েছিলাম। দেশটি শিল্প ও কৃষি দুই দিকেই সমান অগ্রসরমান। পর্তুগাল মোটামুটি আয়তাকৃতির একটি দেশ। এর উত্তরের ভূমি পর্বতময় হলেও সবুজে ঢাকা। প্রচুর বৃষ্টি হয় এবং আবহাওয়াও শীতল। মাটি বেশ উর্বর। আঙ্গুরের ফলন সেসব অঞ্চলে বেশি। বিশেষ করে দৌরু নদীর উপত্যকা আঙ্গুর ফলানোর জন্য বিখ্যাত। আঙ্গুর ছাড়াও জলপাই ও টমেটোর জন্য বিখ্যাত পর্তুগাল। গম, বার্লি, ধান প্রভৃতি ফসলও ফলায় সেখানকার  কৃষক। দেশটির মধ্য ও দক্ষিণ ভাগ উষ্ণতর ও শুষ্ক।

গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে পর্তুগালে বাংলাদেশি প্রবাসীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সেখানকার বাংলাদেশিদের দেওয়া তথ্যমতে প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি পর্তুগালে বসবাস করছেন এ সময়ে। তারা নানারকম পেশার সঙ্গে যুক্ত। কেউ কেউ যুক্ত হচ্ছেন নানারকম কৃষি উদ্যোগের সঙ্গে। এমন এক কৃষি উদ্যোক্তার সাক্ষাৎ পাই পর্তুগালে। হুমায়ূন কবীর জাহাঙ্গীর নামের এক উদ্যোক্তা গড়ে তুলছেন সমন্বিত কৃষি খামার। পর্তুগালের কৃষি বাণিজ্যের প্রবণতা বুঝেই তিনি সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তোলার এ স্বপ্ন দেখেছেন। এর জন্য পর্তুগালের কৃষি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একটি কোর্সও সম্পন্ন করে নিয়েছেন তিনি। তারপর কৃষি আবাদ অধ্যুষিত লওরিনা এলাকায় চার হেক্টর জায়গা লিজ নিয়ে কৃষি খামার গড়ে তুলছেন। বলা যায়, স্বপ্নের বীজ রোপণ করেছেন শুধু।

আগস্টের ২৫ তারিখ সকালে জাহাঙ্গীর নিজের গাড়ি নিয়ে এলেন তার কৃষি খামার আমাকে ঘুরিয়ে দেখাবেন বলে। কর্মচঞ্চল যুবক জাহাঙ্গীর পর্তুগালে নানা ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। এ উদ্যোক্তা এখন স্বপ্ন বুনছেন কৃষিতে। তাই বিনিয়োগ করেছেন নতুন উদ্যমে। সকাল ৭টায় রাজধানী লিসবন থেকে রওনা দিলাম লওরিনার উদ্দেশ্যে। সঙ্গে সহকর্মী আদিত্য শাহিন। আমাদের দুজনের হাতে দুই ক্যামেরা। ঝকঝকে রোদের দিন। অন্যরকম নীল আকাশ। আমাদের দেশে আকাশের নীল আমরা দেখতেই পাই না। দূষণ ইউ আমেরিকা গেলে আকাশ তারা মসৃণ রাস্তা কখনো উঁচুতে উঠে গেছে, কখনো নিচে নেমে গেছে। এক পাশে আটলান্টিকের নীল জলরাশি। ঘণ্টা দেড়েকের মাঝে আমরা পৌঁছে গেলাম জাহাঙ্গীরের কৃষি খামারে।

ইউরোপ আমেরিকার কৃষিজমি মানেই বিস্তীর্ণ ভূমি। পর্তুগালের লওরিনার মাটির রং লাল। অনেকটা আমাদের দেশের গাজীপুরের ভাওয়াল অঞ্চলের মতো। দেখে মনে মনে ভাবছিলাম দেখতে অনুর্বর এ লাল রঙের মাটিতে কী ফসল ফলবে? এ মাটিতে পানি পড়লেই শক্ত কাদায় রূপান্তরিত হবে। কিন্তু জাহাঙ্গীরের কৃষি খামার দেখে ভুল ভাঙলো। জাহাঙ্গীর চার হেক্টর কৃষি জমিতে চাষ করছেন আলু, টমেটো, শিম, মিষ্টি কুমড়াসহ নানা জাতের শাকসবজি। আছে ভেড়া ও ছাগলের খামার। ইউরোপের খামারিরা ঐতিহ্যগতভাবেই ব্যবহার করেন বড় বড় ট্রাক্টর ও অন্যান্য কৃষিযন্ত্র। নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে জাহাঙ্গীর ট্রাক্টর ভাড়া নিয়ে চাষাবাদের কাজটি চালিয়ে নিচ্ছেন। জাহাঙ্গীর জানালেন ট্রাক্টর ভাড়া করে চাষাবাদ বেশ সুবিধাজনক। যদিও বাংলাদেশের হিসাবে এটি বেশ ব্যয়বহুল। প্রতি ঘণ্টায় ৬০ ইউরো ভাড়া গুনতে হয় ট্রাক্টরের জন্য। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ছয় হাজার টাকা।

নোয়াখালী থেকে পর্তুগালে আসা জাহাঙ্গীর আলুর আবাদ করেছিলেন বিস্তৃত জমিতে। জানালেন, এ বছর বৃষ্টি বেশি হওয়ায় আলুর ফলন আশানুরূপ হয়নি। তারপরও প্রতি হেক্টরে প্রায় এক হাজার কেজি আলুর ফলন পেয়েছেন। সবজি খেতে রয়েছে লালশাক, কুমড়া, চিচিঙ্গা, ঢেঁড়শ, শিম, কচুর লতিসহ নানান জাতের সবজি। উদ্যোক্তা জানালেন, তিনি বাংলাদেশ থেকেই বিভিন্ন ফসলের বীজ সংগ্রহ করছেন। ইতিমধ্যে বীজ নিয়ে কিছু সংকটের মুখোমুখিও হয়েছেন তিনি। তিনি চান বৈধভাবেই যেন বাংলাদেশ থেকে বীজ সংগ্রহ করা যায় এমন একটি পদক্ষেপ নিক সরকার ও সংশ্লি­ষ্ট মহল। সেখানকার বীজ ও সবজির একটা বড় বাজার দখল করে রেখেছে পাশের দেশ ভারত।

জাহাঙ্গীরের খামারের জায়গাটিতে একসময় ছিল পর্তুগিজ মালিকের সিরামিক কারখানা। পুরনো স্থাপনার কিছু অংশ এখনো রয়ে গেছে। সেখানেই খামারের উপকরণ রাখাসহ অন্য কাজগুলো করা হয়। বিভিন্ন ফল-ফসলের চারা তৈরি করা হচ্ছে সেখানে। বীজ থেকে চারা তৈরির কাজটা যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে করেন তরুণ কর্মী সাইফুল ইসলাম।

চাষাবাদের পাশাপাশি বীজ ও চারা নিয়ে রীতিমতো পরীক্ষাও চালাচ্ছেন এ উদ্যোক্তা। পর্তুগালের মাটি ও আবহাওয়ায় বাংলাদেশের প্রচলিত সবজি ফসলের ফলন কেমন হতে পারে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে বেশ কিছু ফসলের চাষাবাদ করে বেশ ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। কৃষি এমনই একটি বিষয়, কাজ শুরু করলে নানান পদ্ধতি এমনিতেই কৃষকের মাথায় খেলে যায়। তার প্রমাণ পাওয়া গেল জাহাঙ্গীরের খামারেও। খেতজুড়ে কোমলপানীয়র প্লøাস্টিকের বোতল পুঁতে রাখা দেখে জানতে চাইলাম বিষয়টা কী? জাহাঙ্গীর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলেন। আলো, তাপ ও আদ্রতা নিয়ন্ত্রণের জন্য চারাগাছগুলোকে প্লøাস্টিকের বোতল কেটে তা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। শিম খেতে সাথী ফসল হিসেবে চাষ করছেন লালশাক।

সমন্বিত কৃষির অংশ হিসেবে জাহাঙ্গীর শুরুতেই নিয়েছেন দারুণ লাভজনক এক উদ্যোগ। খামারের এক অংশে টিনের শেডে গড়ে তুলেছেন ছাগল ও ভেড়ার খামার। মাংসের জন্য ভেড়া আর দুধের জন্য ছাগল। অত্যন্ত পরিকল্পিত এক উদ্যোগ। জাহাঙ্গীরের খামারের ছাগলের দুধ কিনে নিয়ে যায় স্থানীয় খামারিরা। ছাগলের দুধ থেকে তৈরি হয় মানসম্মত চিজ। জাহাঙ্গীর জানালেন, সেখানকার হালাল মাংসের বাজারের ৮০ ভাগ দখল করে রেখেছে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা।

ছাগল ও ভেড়ার খাবারের জন্য মানসম্পন্ন ফডারও সংরক্ষণ করে রেখেছেন জাহাঙ্গীর। কৃষি নিয়ে বহুদূর এগিয়ে যেতে চান তিনি। অদূর ভবিষ্যতে তার ইচ্ছা রয়েছে ইউরোপের প্রচলিত গ্রিন হাউস ও পলিনেট হাউসের কৃষিতে। ইতিমধ্যে জাহাঙ্গীরের            কৃষি সাফল্য দেখে অনেকেই উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন কৃষি বাণিজ্যে যুক্ত হওয়ার। তাদেরই একজন শাহাদৎ হোসেন। তিনিও নতুন উদ্যোগের চিন্তাভাবনা গুছিয়ে এনেছেন। জানালেন, পর্তুগালের কৃষির সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে কৃষি শ্রমিকের অভাব। তিনি কৃষি শ্রমিক সাপ্লাই দেওয়ার একটি এজেন্সি খুলেছেন।

ভিনদেশে বাঙালিদের কৃষি উদ্যোগ, নতুন কোনো বিষয় নয়। গত এক যুগে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য সবখানেই এ উদ্যোগ প্রত্যক্ষ করেছি। পর্তুগাল ইউরোপের সুন্দরতম এক দেশ। এখানে প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য যেমন রয়েছে, রয়েছে শিল্প ও  কৃষির দারুণ সমৃদ্ধি। আবহাওয়াও কৃষির জন্য বেশ অনুকূল। জাতি হিসেবে পর্তুগিজরা পরিশ্রমী ও আত্মবিশ্বাসী। এ জাতিই পৃথিবীতে উপনিবেশ গড়ার পথ দেখিয়েছিল। কখনো উন্নয়নের অভিযান, কখনো দস্যুতার ভিতর দিয়ে তারা নিজেদের গড়ে তুলেছিল। অবশ্য সে বিতর্ক এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। আজ থেকে ৫০০ বছর আগে পর্তুগিজ জাতিই আমাদের ভূমিতে উপনিবেশ গড়েছিল, তারা আমাদের নদীমাতৃক ভূখ-েই দেখেছিল বাণিজ্যের স্বপ্ন। আজ বাঙালি কৃষক জাতি হিসেবে পৃথিবীর দেশে দেশে কৃষির নতুন বিপ্লবের জন্ম দিয়ে চলেছে। এর ধারাবাহিকতায় পর্তুগালে প্রবাসী উদ্যোক্তা জাহাঙ্গীরের কৃষি উদ্যোগ সাত্যিই আশা জাগানিয়া। আমি বিশ্বাস করি, হুমায়ুন কবীর জাহাঙ্গীরের হাত দিয়ে পর্তুগালে কৃষির এক দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য সূচিত হবে। দিনে দিনে সেখানে প্রবাসী বাঙালিদের হাত দিয়ে আরও বহু খামার গড়ে উঠবে, সেখানে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশও নানাভাবে উপকৃত হবে।

শুধু পর্তুগালে নয়, বাংলাদেশ থেকে যারা গিয়েছেন বিভিন্ন দেশে, তারা প্রবাস জীবনে কখনোই ভুলতে পারেননি দেশের মাটিতে ফলানো ফসলের স্বাদ। বাংলাদেশের ফল-ফসলের স্বাদের তৃষ্ণায় তারা নিজেরাই যুক্ত হতে চেয়েছেন কৃষিতে। তারপর দেখেছেন বাংলাদেশের ফল-ফসলের বড় একটি বাজার তৈরি হয়ে গেছে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই। প্রবাসীরা লুকিয়ে চুকিয়ে বাংলাদেশ থেকে বীজ নিয়ে গড়ে তুলছেন তাদের কৃষি সাম্রাজ্য। বাংলাদেশের সবজি ও ফল-ফসলের বীজের একটা বড় বাজার তৈরি হয়ে আছে সারা পৃথিবীতে। সরকার উদ্যোগ নিলেই এ বাজার দখল করে আরও বিস্তৃত করা সম্ভব, সম্ভব দেশের অর্থনীতিতে নতুন এক খাত তৈরি করা।

            লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর