রবিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

নৌকাডুবি : মৃত্যুর স্বাদ কেমন!

মোশাররফ হোসেন মুসা

নৌকাডুবি : মৃত্যুর স্বাদ কেমন!

যারা বাল্যকালে ডুব-সাঁতার খেলেছেন তাদের একটি অভিজ্ঞতা রয়েছে; তা হলো কে কতক্ষণ ডুব দিয়ে থাকতে পারে। আমি তো পাল্লা দিয়ে দুই কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দম থাকা পর্যন্ত পানিতে ডুব দিয়ে থাকতাম এবং এক পর্যায়ে হুস করে পানির ওপরে উঠে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা দিতাম। দম বন্ধ হওয়ার মুহূর্তটা কি খুব বেশি যন্ত্রণাদায়ক? আমার অভিজ্ঞতায় সেটা বলে না। তবে নৌকা কিংবা লঞ্চডুবিতে মৃত্যুর ঘটনায় যন্ত্রণার চেয়ে আতঙ্কটাই থাকে বেশি। গত ৩১ আগস্ট চলনবিলে পানিতে ডুবে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে সেটার প্রমাণ পেয়েছি। আমি নিজে প্রাইমারি কালচারের প্রচারক। সামান্য অসতর্কতার কারণে পাঁচজন মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটে। সে জন্য নিজের দায়বোধ থেকে কিছু কথা না বললেই নয়। কুষ্টিয়া শহরের শফি খান (রিজু ভাই) দীর্ঘদিন যাবত আমেরিকা প্রবাসী। সম্প্রতি তিনি দেশে ফিরে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশের মাটিতে কিছু একটা করবেন। সেই সুবাদে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। তিনি ছয় মাস আগে থেকেই বলে আসছেন তিনি কখনো চলনবিল দেখেননি। সে জন্য পরিবার-পরিজনসহ চলনবিল দেখার আগ্রহ তার। গত ৩১ আগস্ট আমরা সবাই চলনবিল ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিই। কুষ্টিয়া শহরের আটজন সিএনজিযোগে ভাঙ্গুড়া বড়ালব্রিজে এসে আমাদের সঙ্গে মিলিত হন। কুষ্টিয়ার শফি খানের সঙ্গে আমার দুজন ঘনিষ্ঠজন সাইদুর রহমান (এনজিও কনসালট্যান্ট) ও তারিফ হোসেন (দৈনিক যুগান্তরের সাবেক সহ-সম্পাদক) আসেন। আমরা মোট ২৫ জন সকাল সাড়ে ১০টায় চরভাঙ্গুড়া ঘাটে পৌঁছাই। প্রসঙ্গত ঈশ্বরদীর ওষুধ ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলামের বাড়ি চলনবিল এলাকায় হওয়ায় তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় নৌকা ভাড়া করার। রফিকুল ইসলাম যে নৌকাটি পছন্দ করেন সেটির বিষয়ে সাইদুর রহমান দ্বিমত পোষণ করেন। কারণ এক চায়ের দোকানদার না কি আরেকটি নৌকা দেখিয়েছে (একই দোকানদার গত বছরও নৌকা ঠিক করে দিয়েছিল)। শেষে সাইদুর রহমানের পছন্দের নৌকা ২ হাজার টাকায় ভাড়া নেওয়া হয়। মাঝির সঙ্গে চুক্তি হয় তিনি তাড়াশ উপজেলা শহরে নিয়ে যাবেন এবং আসার পথে সিরাজগঞ্জ রোডের মান্নান নগরে নামিয়ে দিবেন। আমাদের সহযাত্রী আবদুল মজিদের স্ত্রী বাতজ্বরের রোগী হওয়ায় তিনি হাঁটু ভেঙে বসতে পারেন না। সে জন্য তার জন্য একটি পুরাতন প্লøাস্টিকের চেয়ার কেনা হয়। প্রায় ১১টার দিকে আমরা আনন্দ সহকারে যাত্রা শুরু করি। যাত্রার শুরুতে  ৭-৮ জন পুরুষ লোক ও ২ জন মহিলা ছৈয়ের ওপর ওঠে বসেন। আমি মাঝিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বেশি লোক উঠলে ছৈ ভেঙে যাবে কি না! মাঝি আশ্বাস দিয়েছিলেন ২৫ জন উঠলেও কিছু হবে না। দুপুর আড়াইটায় আমরা তাড়াশ বাজারে যাই এবং ‘শুভদা’ নামক হোটেলে দুপুরের খাবার খাই। উল্লে­খ্য, আবদুল মজিদ তার অসুস্থ স্ত্রীর সঙ্গে নৌকাতেই থেকে যান। বিল্লাল গণি মতামত দেন- ‘নৌকায় করে আবার ভাঙ্গুড়া যাওয়ার কী দরকার? বিল তো দেখা হয়েই গেছে, চলেন সড়ক পথে বনপাড়া দিয়ে চলে যাই।’ আলমগীর কবির (ডাল গবেষণায় কর্মরত) বলেন, ‘ভাবী তো (মজিদের স্ত্রী) উঁচু রাস্তায় উঠতে পারবেন না।’ তার কথায় আবদুল মজিদও সমর্থন দেন। সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমরা যেখান থেকে উঠেছি সেখানে গিয়ে যাত্রা শেষ করব। রাত হলেও সমস্যা হবে না। সবাই একসঙ্গে মোবাইলের টর্চ জ্বালাব।’ তার কথায় সকলে হেসে ওঠেন। ফলে সিদ্ধান্ত হয় আবার ভাঙ্গুড়ায় ফিরে যাওয়া। হান্ডিয়াল পাইকপাড়া ‘কাটাখাল’ যখন আমরা অতিক্রম করি তখন প্রায় সন্ধ্যা সোয়া ৬টা। ছৈয়ের মাথার দিকে থাকা কুষ্টিয়ার লোকজনের মধ্যে দুজন উঠে দাঁড়ালে হঠাৎ ধপাস করে বিকট শব্দ হয়। মনে হচ্ছিল নৌকাটি কোনো একটি খুঁটির সঙ্গে জোরে আঘাত করেছে। আমি ছিলাম ছৈয়ের পেছনের দিকে। দেখি নৌকাটি দ্রুত তলিয়ে যাচ্ছে। দেখলাম লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পানিতে ভাসছে। কেউ কেউ চিৎকার করে বলছে, ‘ভাইসব এগিয়ে আসেন! আমাদের বাঁচান!’ প্রথমেই নজর পড়ল আমার ৭ম শ্রেণিতে পড়–য়া মেয়ে অর্পার প্রতি। সে দুই হাত ছুড়ছে আর চিৎকার করে বলছে, ‘আব্বু বাঁচাও! আব্বু বাঁচাও! লাফ দিয়ে তার কাছে যেতেই সে আমার গলা পেঁচিয়ে ধরে। বাপ-বেটি তলিয়ে যেতে থাকি। সেকেন্ডের মধ্যে বহু চিন্তা মাথায় আসে। এটাই কী মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত? আমরা কী দুজনে একসঙ্গে ডুবে মরে ইতিহাস সৃষ্টি করব, না শুধু একাই বাঁচব? একপর্যায়ে নিষ্ঠুরভাবে সর্বশক্তি দিয়ে তার হাত থেকে মুক্ত হই এবং ভেসে উঠে দম নিই। দেখি মেয়েও ভেসে উঠে কাতল মাছের মতো পানি খাচ্ছে আর ক্ষীণ কণ্ঠে আব্বু! আব্বু! বলে ডাকছে। সাঁতার জানা থাকার কারণে আমি দুই পা চালিয়ে ভেসে থাকার চেষ্টা করি এবং এক হাত দিয়ে তার একটি হাত ধরে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করি। দেখি একটি বোতল ভেসে যাচ্ছে। মেয়েকে বললাম, ‘আব্বু বোতলটি ধরো।’ সে বোতলটি ধরতে ব্যর্থ হলো। দেখলাম আমাদের নৌকার মাঝির ব্যবহৃত বাঁশের লগিটি ভেসে যাচ্ছে। সেটা অনেক কষ্ট করে নিজে ধরলাম, মেয়েকেও ধরিয়ে দিলাম। মাত্র ৩০ সেকেন্ড ভেসে থাকতে হবে। কারণ একটি নৌকা আমাদের উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসছে। তখন এক সেকেন্ডকে অনন্তকাল মনে হচ্ছিল। নৌকা কাছে আসলেও স্রোতের কারণে ধরতে পারছিলাম না। কিশোর ছেলেটি (সুমন) বৈঠা এগিয়ে দেয়। বৈঠা ধরে সামান্য এগিয়ে নৌকা ধরলাম, মেয়েও আমার সঙ্গে সঙ্গে নৌকা ধরে ফেলল। কে যেন মেয়েকে টেনে নৌকায় তুলল এবং আমিও সামান্য উঠে ভেসে থাকলাম। উদ্ধারকারী ছেলেটি বলছে, ‘আপনারা নৌকা ধরে থাকেন, নৌকায় উঠবেন না।’ পরে শুনেছি শাহনাজ ও আসমা নামে আরও দুজন মহিলা দুটি ডিঙি নৌকা নিয়ে একইভাবে উদ্ধারে এগিয়ে এসেছিলেন। ছৈয়ের ভিতরে আটকে গিয়ে আমার স্ত্রী শাহনাজ পারভীন পারু ও বিল্লাল গণির স্ত্রী শিউলী খাতুন পানির নিচে তলিয়ে যান। স্বপন বিশ্বাস তার মেয়ে সওদা মনির এক হাত ধরে উদ্ধারকারী নৌকার দিকে যাচ্ছিল এবং রফিকুলও সওদা মনির আরেকটি হাত ধরেছিল। কিন্তু একপর্যায়ে স্বপন বিশ্বাস তার মেয়েকে নিয়ে তলিয়ে যায়। রফিকুলও আতঙ্কে তার হাত ছেড়ে দেন। স্বপন বিশ্বাস ভালো সাঁতারু হয়েও কেন যে তলিয়ে গেলেন তা রহস্যজনক। বিল্লাল গণিও সাঁতার জানতেন। তিনি তার মেয়েকে নৌকায় তুলে দিতে পারলেও নিজে তলিয়ে যান। ভাবছি, তারাও আমার মতো লড়াই করেছেন; হয়তো ঘটনার আকস্মিকতায় কিংবা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পানিতে ডুবে যান। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ওঠার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওঠার কোনো শক্তি পেলাম না। যদি শক্তি থাকত তাহলে আবার সাঁতরে নৌকার কাছে যেতাম। মেয়ে কাঁদছে আর বলছে, আম্মু কই! আম্মু কই! এরই মধ্যে ঈশ্বরদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নৌকা ডুবির ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেছে। শুনলাম টেলিভিশন, ফেসবুক ও অনলাইন পত্রিকাগুলোতে নৌকাডুবির ঘটনাটি প্রচারিত হচ্ছে। সলিমপুর ইউপির চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বাবলু মালিথা, ঈশ্বরদী পৌরসভার কাউন্সিলর ইউসুফ আলী প্রধান, হান্ডিয়াল ইউপির চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন, কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের লোকজনসহ প্রায় দুই শতাধিক লোক ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং তারা সারা রাত সেখানে অবস্থান করেন। এ ঘটনায় পুরো ঈশ্বরদী স্তব্ধ হয়ে পড়ে। ফায়ার ব্রিগেডের লোকজন ও বগুড়া থেকে আসা ডুবুরিরা নৌকা তোলার চেষ্টা করেন। পরদিন পাবনার জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিনের উপস্থিতিতে উদ্ধার কাজ চলতে থাকে এবং পর্যায়ক্রমে ৫ জনের লাশ উদ্ধার হয়। গ্রামের লোকজনের সহযোগিতা ভোলার নয়। তারা সারা রাত জেগে ফায়ার ব্রিগেড ও ডুবুরিদের সহযোগিতা করেন এবং খিচুড়ি রান্না করে সবাইকে খাওয়ান। কার্ল মার্কস বলেছেন-‘ উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন মানুষের সংস্কৃতি নির্ধারণ করে।’ খেটে খাওয়া ও প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা মানুষের চরিত্র নির্মল হয় সেটার প্রমাণ সেখানে পাওয়া গেছে। জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি হিসেবে সহকারী কমিশনার (মূল্যায়ন) মাহাবুব হাসান ও ডিএফ মো. মনোয়ার হোসেন সরাইকান্দি গ্রামে আমার শ্বশুরালয়ে গিয়ে আমার কন্যাদের সান্ত্বনা দেন। তাছাড়া আমার মধ্য অরনখোলাস্থ বাড়িতে ঈশ্বরদীর ইউএনও মো. আল মামুন এসে সবাইকে সমবেদনা জানান। ঈশ্বরদীর সংস্কৃতি অঙ্গনে স্বপন বিশ্বাস ছিল প্রিয় মুখ। সওদা মণি ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ছিল। সে ছিল সব ক্ষেত্রে পারদর্শিনী। বিল্লাল গণির পিতা ছিলেন একজন স্বনামধন্য পীর। সেই সুবাদে তিনি সুফিবাদ দর্শনে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাদের মৃত্যুতে সবাই মর্মাহত হয়েছেন। কোনো কোনো পত্রিকা লিখেছে- সেলফি তুলতে গিয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে ৮ সেপ্টেম্বর একটি দৈনিকের ম্যাগাজিন ছুটির দিনে ‘সাধারণের অসাধারণ সাহস’ শিরোনামে এক প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে উদ্ধারকারীদের প্রশংসা করতে গিয়ে আমাদের আবার পানিতে ফেলে দেয়। প্রতিবেদনের এক জায়গায় লেখা হয়েছে- ‘ছৈয়ের নিচে থাকা যাত্রীরা একে একে ছৈয়ের ওপর ওঠেন ছবি তুলতে। সবাই ওপরে একপাশে উঠলে হেলে যায় নৌকাটি। হুড়মুড় করে ভেঙে যায় ছৈ।’ এটি সত্য নয়।                প্রকৃত ঘটনা হলো ছৈয়ের খুঁটি ভেঙে গেলে ছৈয়ের ওপরে থাকা লোকজন নৌকার এক পার্শ্বে পড়লে নৌকাটি কাত হয়ে তলিয়ে যায়। কিছুটা দেখে, কিছুটা শুনে এবং কিছুটা আন্দাজ করে লেখার নাম সাংবাদিকতা নয়। প্রতি বছর চলনবিলে নৌকা ভ্রমণের জন্য শত শত দেশি-বিদেশি পর্যটক বেড়াতে আসেন। কিন্তু নৌকাগুলোর ফিটনেস ও লাইভজ্যাকেট আছে কি না, এমনকি সামান্য টায়ার-টিউব আছে কি না সেটা দেখার দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের। এসব বিষয়ে লেখার দায়িত্বও স্থানীয় সাংবাদিকদের রয়েছে।

লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক।

 ই-মেল : [email protected]

সর্বশেষ খবর