বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

সবার ওপরে মানুষ সত্য

মাজহারুল ইসলাম

সবার ওপরে মানুষ সত্য

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘সবার উপরে’ উপন্যাসের আলোকে ভারতীয় একটি বাংলা ছবি দেখেছিলাম। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন বাংলা ছায়াছবির অমর জুটি উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন। ছবিতে উত্তর কুমার শঙ্কর আর সুচিত্রা সেন রিতা নামে অভিহিত। ছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে শঙ্করের বাবা প্রশান্ত চ্যাটার্জি। হেমাঙ্গিনী বিশ্বাস নামে এক বিধবা নারীকে হত্যার মিথ্যা অভিযোগে প্রশান্ত বাবু কারাবরণ করেন। ঘটনাটি ঘটেছিল কলকাতার কৃষ্ণনগরে। ১৯৪২ সালের ২২ জুন। যে পুলিশ কর্মকর্তাটি হেমাঙ্গিনী হত্যার ঘটনা তদন্ত করেছিলেন তিনি কর্তার ইচ্ছায় সঠিক তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেননি। মৃত্যুর আগে তিনি ডায়েরিতে লিখে যান, ‘হেমাঙ্গিনীর হত্যার জন্য প্রশান্ত বাবু দায়ী নন।’ শঙ্করের কাছে লিখিত চিঠিতে তিনি লিখে যান হেমাঙ্গিনীর জীবনকাহিনী গভীরভাবে অনুসন্ধান করার জন্য। পুলিশি শাস্ত্রে বলা আছে, যিনি খুন হন তার জীবনকাহিনী বিশ্লেষণ করলেই খুনের আসল রহস্য উদ্ ঘাটন ও প্রকৃত খুনিকে শনাক্ত করা যায়।

যখন ছবিটি দেখেছিলাম তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। চিত্তবিনোদনই ছিল ছবি দেখার মূল উদ্দেশ্য। তখন বয়স কম ছিল, আবেগ ছিল বেশি। পরবর্তী কর্মজীবনে এসে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে চলতে হয়েছে। সবার উপরে সিনেমার গল্পটি শুধু সিনেমাই নয়, সমাজের এক সচিত্র ঘটনা। আমাদের সমাজ-ব্যবস্থায়ও অসংখ্য অগণিত নিরপরাধ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। কিন্তু মানুষের আদালত থেকে রক্ষা পেলেও প্রকৃতির আদালত থেকে অপরাধীরা কখনো পার পায় না। সমাজব্যবস্থায় অনাদিকাল থেকে অন্যায় আছে, অবিচার আছে, তার পরও সমাজ থেমে থাকেনি। প্রাকৃ-তিক নিয়মেই মানবসমাজ এগিয়ে চলেছে এবং অনাগত দিনেও চলবে। প্রশান্ত বাবু ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ সহজ-সরল মানুষ। তিনি কাজ করতেন জীবন বীমা করপোরেশনে। আইনে, ধর্মে, ভগবানে অনন্ত বিশ্বাস ছিল তার।

২০১৪ সালে আমি টাঙ্গাইল জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে দায়িত্ব নিয়ে যোগদান করি। একটা বিশেষ ক্ষমতাসীন পরিবার ১১০০ পতিতাকে টাঙ্গাইল শহর থেকে উচ্ছেদ করে দেয়। আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পতিতাদের পক্ষ অবলম্বন করি। তৎকালীন টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সালেহ মো. তানভীর, জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব হোসেন এবং আমি ক্ষুদ্র মানুষটি ওই দুঃসময়ে পতিতাদের অবস্থা দেখে ব্যথিত হয়েছি। আমাদের সঙ্গে ছিলেন মানবাধিকার কর্মী, মিডিয়া ও কিছু সৎ রাজনৈতিক নেতা। আদালতের রায়ের মধ্যমে ডিগ্রি নিয়ে পতিতারা তাদের আবাসনে ফিরে যায়। কিন্তু যারা তাদের উচ্ছেদ করেছিল তারা কেউ বা কারাগারে কেউ বা পলাতক। মানুষের আদালত থেকে পার পেলেও প্রকৃতির আদালত থেকে অন্যায়কারী পার পায় না, ঘটনাটি তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ।

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল ২২ পরিবারের শাসন ও শোষণের কবল থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করা। ৪৭ বছর পেরিয়ে গেল দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু কিছু লোকের দেশপ্রেম আর সততার অভাবে দেশ তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে বার বার হোঁচট খাচ্ছে। মহান সংসদের ২২তম অধিবেশনে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ১০০ ঋণখেলাপির নাম জাতির সামনে উপস্থাপন করলেন। তিনি একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। ঋণখেলাপিরা তার মন্ত্রণালয়ের আওতায় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ‘খেলাপি’ সেজে বসে আছেন। এ ব্যর্থতার দায় কার? টাকাগুলো তো কোনো দলের নয়, সরকারের নয়, টাকাগুলোর মালিক প্রজাতন্ত্রের জনগণ। কিছু উচ্চাভিলাষী লোক ভোগবিলাসী জীবনযাপন করবে তাও আবার রাষ্ট্রীয় তহবিল তছরুপ করে, এটা তো জাতির কাছে কাম্য ছিল না। আমি পৃথিবীর কিছু দেশ সফর করেছি। সেসব দেশে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা জš§গ্রহণ করেনি। সেসব দেশের স্বাধীনতার জন্য এত রক্তক্ষয়ও ঘটেনি। এই তো সেদিনের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পরিণত হয়েছিল। হিরোশিমা, নাগাসাকি নগরীতে আণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল। সেই বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ঘরবাড়ি, দালানকোঠাসহ অগণিত মানুষ। শুধু সততা, দেশপ্রেম আর কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা জাপান পৃথিবীর মানচিত্রে অন্যতম সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাই স্বাধীনতার শেষ ঠিকানা। ইতিমধ্যে বিশ্ববাসী তাকে দিয়েছে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ উপাধি। কিন্তু নিজ দেশে যদি মানবতার লঙ্ঘন হয়, কিছু উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি যদি সাধারণ মানুষের হক নষ্ট করে তবে মিয়ানমারের নেত্রী সু চির মতো আগামীতে জননেত্রীকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ক্ষমতা কোনো চিরস্থায়ী বিষয় নয়। তার আন্তরিকতা, সততা, দেশপ্রেম নিয়ে কারও মনে কোনো প্রশ্ন নেই। গল্পটি যে কাহিনী দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই কাহিনীর শেষ দিয়ে আজকের লেখা সমাপ্ত করব। কয়েদি প্রশান্ত চ্যাটার্জিকে ১২ বছর পর নির্দোষ বলে প্রমাণ করেছিলেন তার সন্তান শঙ্কর চ্যাটার্জি। জনতার আদালতে প্রশান্ত চ্যাটার্জির পুনর্বিচার হয়েছিল। জেলখানা থেকে মুক্তি পাওয়ার সময় প্রশান্ত চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘আমার ফেলে আসা ১২টি বছর কে ফিরিয়ে দেবে? আইন, আদালত, ধর্ম, ভগবান সবকিছু মিথ্যা। সবার ওপরে আছে সত্য এবং সেটা মানুষ সত্য।’

লৈখক : কলামিস্ট

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর