বৃহস্পতিবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

কাপাসিয়ার শহীদ তিন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাথা

মাহমুদুল আলম খান বেনু

কাপাসিয়ার শহীদ তিন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাথা

দিনটি ছিল সোমবার ১১ অক্টোবর ১৯৭১ সাল। কাপাসিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম একটি দিন। দিনটি একদিকে বীরত্বের, গৌরবের অন্যদিকে গভীর বেদনার। হ্যাঁ, সেই দিনটির কথা আমার স্মৃতিপটে পরিষ্কারভাবে গাঁথা আছে। আমি চোখ বুজলেই সে দিনটির প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ঘটনা দেখতে পাই। সেদিন আমি সনমানিয়া ইউনিয়নের চন্ডালহাতা গ্রামে মরহুম ডা. গিয়াসউদ্দিনের বাড়িতে অবস্থিত আমার বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে অবস্থান করছিলাম এবং রুটিনমাফিক ঘুম থেকে উঠেই মুক্তিযোদ্ধাদের সকালের অনুশীলন পরির্দশন করে নাশতা খেতে বসেছিলাম। এমন সময় আমার বিশ্বস্ত ‘গোয়েন্দা’ তরগাঁও গ্রামের নৌকার মাঝি আবদুল বাতেন এসে জানাল আজই কাপাসিয়ায় অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনী নদী অতিক্রম করে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি দখল করবে। আসলে তিন দিন আগেই বাতেন হেডকোয়ার্টারে এসে আমাকে বলে গিয়েছিল ‘ম্যাক ভাই’ (মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা এই সংক্ষিপ্ত নামেই আমাকে ডাকত, কারণ ‘বেনু’ নামে পাকিস্তান আর্মি আমাকে চিনত) দু-তিন দিনের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের নিয়ে নদী অতিক্রম করে আমাদের ঘাঁটিগুলো আক্রমণ করবে। যেহেতু বাতেন নৌকার মাঝি ছিল এবং তার নৌকা দিয়ে রাজাকার ও দালালরা নদী পার হয়ে এপার-ওপার যাতায়াত করত তাই সে বোকা সেজে এ তথ্যগুলো জানতে পেরেছিল। যাই হোক, বাতেনের খবর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দুই সেকশনের ইনচার্জ মোস্তফা ও রমিজকে বললাম ১৫ জন চৌকস মুক্তিযোদ্ধাকে রেডি করতে এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্র (এসএলআর ও স্টেনগান) এবং যথেষ্ট পরিমাণ গোলাবারুদ সঙ্গে নিতে। আমি স্বয়ং আমার প্রিয় সাবমেশিনগানটি ও গুলিভর্তি চারটি ম্যাগাজিন নিলাম। আমার পরিকল্পনা ছিল নদীর মধ্যেই নৌকায় তাদের আক্রমণ করা যাতে নৌকা ডুবে তারা নদীতে পড়ে মারা যায়। চ-ালহাতা থেকে সাফাইশী গুদারাঘাট এ ৪ মাইল আমরা ২০-২৫ মিনিটে পৌঁছে গেলাম। নদীর পাড়ে পজিশন নিতেই দেখলাম নদী অতিক্রমরত পাকিস্তানি আর্মি আমাদের দেখে ফেলেছে এবং ভয় পেয়ে হাতে ইশারা করছে গুলি না করতে। অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নদীর পাড়ে গাছের আড়ালে পজিশন নিতে বলে আমি নিজে নৌকা বরাবর আরও সামনে গিয়ে সাবমেশিনগানের গুলি চালিয়ে পরপর দুটি ম্যাগাজিন শেষ করলাম এবং অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও গুলি করতে লাগল। নৌকায় অবস্থানরত ১০-১২ জন পাকিস্তানি সৈন্য সঙ্গে আরও কিছু রাজাকার গুলিবিদ্ধ হয়ে নদীতে পড়ে মারা গেল, বাকিরা নৌকা ডুবে মারা গেল। তখন আমি আরও সামনে গিয়ে জীবন্ত পাকিস্তানি ধরার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে গেলাম। কিন্তু আমি জানতাম না কিছু পাকিস্তানি আর্মি ইতিমধ্যে নদী পার হয়ে গিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ তারা রেডি হয়ে পাল্টা আক্রমণ চালাল। পাশে তাকিয়ে দেখি আমার বাহিনীর ছেলেরা আমাকে রেখে প্রায় ১০০ গজ পেছনে চলে গেছে। আর সামনে থেকে পাকি বাহিনী সমানে গুলি চালাচ্ছে। যেহেতু তারা ছিল নদীর পাড়ে অর্থাৎ ঢালুতে আর আমি ছিলাম ওপরে এবং গাছের আড়ালে তাই তাদের গুলিগুলো আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল। তবে আমার বাহিনীর ছেলেরা পেছন থেকে ব্যাকফায়ার করতে থাকল, ততক্ষণে পাশের একটি গর্তে পড়ে আস্তে আস্তে ক্রলিং করে বেশ দূরে এসে আমার বাহিনীসহ একত্রিত হয়ে হেডকোয়ার্টারে ফিরে এলাম। ভোর রাতে এলো সেই চরম দুঃসংবাদ, তরগাঁও গ্রামের তফি মোক্তারের বাড়ির পাশে সম্মুখসমরে শহীদ হয়েছেন আমার বাহিনীর অকুতোভয় যোদ্ধা সাজ্জাদ ও গিয়াস এবং নদীর পাড়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আউয়ালকে এক রাজাকার দেখিয়ে দেওয়ার পর ধরে নিয়ে নির্মম অত্যাচার করে, নিষ্ঠুরভাবে তাকে হত্যা করে হায়েনার দল পাকিস্তানি সেনারা। আসলেই এ ঘটনার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। কারণ ’৭১ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে সিএনসি স্পেশাল ট্রেনিং নিয়ে কলকাতা হয়ে আগরতলায় এসে ৩ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার মনতলা ক্যাম্পে আসি। ৩ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক লে. কর্নেল, পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান মে. জে. শফিউল্লাহ আমাকে কোম্পানি কমান্ডার করে হেডকোয়ার্টারে অবস্থানরত ট্রেনিংপ্রাপ্ত কাপাসিয়ায় সব মুক্তিযোদ্ধাকে আমার অধীন করে কাপাসিয়ায় পাঠান এবং এও বললেন, পরবর্তীতে যেসব মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিয়ে কাপাসিয়া যাবে তারা তোমার কমান্ডে যুদ্ধে করবে। কয়েকটি সফল অপারেশনের পর আমরা কাপাসিয়া সদরে অবস্থিত পাকিস্তান বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিই এবং চারদিক থেকে তাদের ঘেরাওয়ের উদ্দেশ্যে করিহাতা, উত্তরখামের, বাঘিয়া এবং নদীর দক্ষিণ পাড়ে গোপনে সূর্যনারায়ণপুর ও চানপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি স্থাপন করি। এসব ঘাঁটির কমান্ডারকে (প্লাটুন কমান্ডার) গোপনে পাকিস্তানি বাহিনী, রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দিই, যাতে সঠিক সময়ে আমরা একযোগে সদরে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করে নিশ্চিহ্ন করতে পারি। কিন্তু উত্তরখামের এই যে গ্রুপটি (মোতালেব মাস্টার প্লাটুন কমান্ডার) থাকার কথা ছিল, তারা আমার অনুমতি ছাড়াই একেবারে নদীর পাড়ে তরগাঁও গ্রামে অক্টোবরের ৫/৬ তারিখে অবস্থান নেয়। এ খবর রাজাকার বা শান্তি কমিটির লোক মারফত হয়তো পাক সেনারা পেয়ে থাকবে। তাই উক্ত ঘাঁটি আক্রমণ করার পরিকল্পনা পাক সেনারা দু-তিন দিন আগেই করেছিল; যা বাতেন মাঝি আমাকে জানিয়েছিল কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য নদীর এত কাছে আমার একটি গ্রুপ অবস্থান করছে তা আমি জানতাম না, ফলে ১১ অক্টোবর সকালে নৌকায় আক্রমণ করে পাক সেনাদের হত্যা করে যখন হেডকোয়ার্টারে চলে এলাম তখন পাক বাহিনী পুনরায় একত্রিত হয়ে সঙ্গে আরও সৈন্যসহ দুপুরের দিকে তফি মোক্তারের বাড়ির পাশে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের চারদিক থেকে ঘেরাও করে সাজ্জাদ ও গিয়াসকে গুলি করে হত্যা করে। সাজ্জাদের হাতে একটি এলএমজি ছিল, পাশে গিয়াস ম্যাগাজিনে গুলি ভরে দিচ্ছিল। সামনের তিন-চার জন পাক সেনাকে সে হত্যা করেছিল কিন্তু পেছন থেকে গুলি করে পাক সেনারা তাদের হত্যা করে। শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি তাদের লাশটিকে বেয়নেট চার্জ করে ক্ষতবিক্ষত করে দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে সারা কাপাসিয়া বাজার ঘুরিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন করে লাশটি নদীতে ফেলে দেয়। মুক্তিযোদ্ধা আউয়াল নদীর পাড়ে একটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিল, এক রাজাকার তাকে দেখিয়ে দেওয়ার পর হায়েনার বাহিনী তাকে হত্যা করে।

লেখক : কাপাসিয়ার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার

সর্বশেষ খবর