মঙ্গলবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

সন্তানকে দীন শিক্ষা দিন

মাওলানা আবদুল কুদ্দুছ

হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআন তিলাওয়াত করে, বোঝে ও হালাল-হারাম মেনে চলে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তার আত্মীয়স্বজনের মধ্য থেকে এমন দশ জনের ব্যাপারে তার সুপারিশ কবুল করবেন যাদের ওপর জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গেছে।’ তিরমিজি। হারদুইর হজরত শাহ্ আবরারুল হক (রহ.) এ হাদিসটি বর্ণনা করে বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআন পড়ল, বুঝল এবং সে অনুযায়ী আমল করল সে জান্নাতের ১১টি ভিসা পেয়ে গেল। একটি তার নিজের, অন্য দশটি তার আত্মীয়স্বজনের।’ মানুষ তো আজ আমেরিকার ভিসা পাওয়ার জন্য অস্থির। ভিসার জন্য কত কষ্ট, কত দৌড়ঝাঁপ! এ ভিসা তো জান্নাতের ভিসা। এর সঙ্গে কি দুনিয়ার কোনো ভিসার তুলনা চলে? হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি শুদ্ধভাবে কোরআন পড়া শিখবে, অন্যকে শেখাবে এবং যারা কোরআন জানে তাদের সম্মান করবে, সে ব্যক্তির কখনো রিজিকের অভাব হবে না।’ একটু ভেবে দেখি, আমি কি কোরআন মজিদ শুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করতে পারি? আমার সন্তা -নকে কি কোরআন মজিদ শিক্ষা দিয়েছি? সন্তানকে হাশরের ময়দানে আমার জন্য সুপারিশ করার মতো যোগ্য করে তুলতে পেরেছি? আমার সন্তান কি পারবে মৃত্যুর সময় আমার মৃত্যুযন্ত্রণা লাঘব করতে? পারবে কি নিজ হাতে সুন্নত মোতাবেক গোসল ও কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করতে? পারবে কি জানাজার নামাজ পড়াতে? একজন মানুষের যখন দুনিয়া থেকে বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসে তখন তার পাশে সূরা ইয়াসিন তিলাওয়াত করলে মৃত্যুযন্ত্রণা লাঘব হয়। এ সময় তার পাশে কলমার তালকিন করতে হয়। আমার সন্তান কি তা করতে পারবে?

মৃত্যুর পর দাফনের আগে তিনটি কাজ করতে হয়- গোসল, কাফন ও জানাজা।

মা-বাবার ইন্তেকালের পর এ কাজের দায়িত্ব সন্তানের। মা মারা গেলে মেয়ে গোসল করাবে। বাবা মারা গেলে ছেলে গোসল করাবে। এরপর সুন্দরভাবে কাফন পরাবে। নিজে জানাজার নামাজ পড়াবে। সমাজে কজন এমন আছে, যার মৃত্যুর পর সন্তানরা এ বিষয়গুলো নিজেরা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে পারবে? সবাই ছোটে ইমাম-মুয়াজ্জিনের কাছে। আফসোস! যে সন্তানের পেছনে পুরো জীবন ব্যয় করলাম সে সন্তান আমার দুনিয়ার শেষ দিনটাতে কোনো কাজেই এলো না। এরপর জানাজার সময় জানাজা পড়াবে তো দূরের কথা, হুজুরকে এসে বলে, নামাজের নিয়ত আর জানাজার নিয়মটা বলে দিন। জানাজার পর সন্তান আপনাকে কবরে রেখে আসবে। কোরআন তিলাওয়াত করে, নেক আমল করে আপনার কবরে সওয়াব পাঠানোর শিক্ষাটুকুও তো তার নেই। সেখানে তখন আপনার দুনিয়ার কোন জিনিস কাজে আসবে বলুন?

সন্তানের এ অবস্থার জন্য কি আমি নিজেই দায়ী নই? আমি কেন সন্তানকে দীন শিক্ষা দিলাম না, কেন কোরআন শিক্ষা দিলাম না?

সন্তানকে কোরআন-সুন্নাহর শিক্ষা দেওয়া হয়নি বিধায় সে পিতা-মাতার হক ও প্রাপ্যের কথা জানে না, বোঝে না। ফলে বাবা-মার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। বিশেষত বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতা যেন সন্তানের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। বৃদ্ধাশ্রমগুলো এর জ্বলন্ত প্রমাণ। সেখানে বৃদ্ধ মা-বাবারা সন্তানদের ছাড়া মানবেতর জীবনযাপন করে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, ব্যবসায়ীসহ শিক্ষিত ও সম্পদশালী বহু লোক রয়েছেন ছেলেমেয়েদের দৃষ্টিতে এরা তাদের সঙ্গে থাকার উপযুক্ত নয়, তাই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছে।

সন্তানকে দীনি ইলম শিক্ষা দিলে সে জানতে পারত, আল্লাহ কোরআনে তাঁর ইবাদতের পরই মা-বাবার ইবাদতের কথা বলেছেন। সে জানত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো নেক সন্তান মা-বাবার দিকে দয়ামায়ার দৃষ্টিতে তাকালে আল্লাহ তাকে প্রতিবার তাকানোর বিনিময়ে একটি কবুল হজের সওয়াব দান করবেন।’

সাহাবিরা আরজ করলেন, যদি কেউ এক দিনে এক শ বার তাকায় তবু?

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ, আল্লাহ অনেক বড়, অনেক মহান।’ শুয়াবুল ইমান। সে আরও জানত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা চাইলে বান্দার সব গোনাহ মাফ করে দিতে পারেন। তবে মা-বাবাকে কষ্ট দেওয়ার গোনাহ তিনি মাফ করবেন না; বরং তার মৃত্যুর আগে দুনিয়াতেই এর শাস্তি ভোগ করাবেন।’ শুয়াবুল ইমান। সে কোরআন-হাদিস পড়েনি বিধায় মা-বাবার কদর বোঝে না। মা-বাবাকে কষ্ট দেয়। সম্মান করে না। সন্তানকে দীন শিক্ষা না দেওয়ার এটা হলো দুনিয়াবি কুফল। আর আখিরাতে তো এর শাস্তি আছেই। হাশরের ময়দানে এ সন্তানই পিতা-মাতার বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ করবে। এমনকি পিতা-মাতার জন্য কঠিন শাস্তির আবেদন করবে। কোরআনুল কারিমে এর বিবরণ এসেছে এভাবে, ‘তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের অনুসরণ করেছি, আর তারাই আমাদের পথভ্রষ্ট করেছে। হে আমাদের রব! তাদের দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদের মহা-অভিসম্পাত করুন।’ সূরা আহজাব, আয়াত ৬৮, ৬৯। যে সন্তানের জন্য বাবা-মা এত কষ্ট স্বীকার করছে সেই সন্তান না মৃত্যুর সময় কাজে এলো, না মৃত্যুর পর। কবরের জীবনেও কোনো কাজেই এলো না। আর হাশরের ময়দানে তো কাজে আসবেই না; বরং সন্তান পিতা-মাতাকে দোষী সাব্যস্ত করে তাদের জন্য দ্বিগুণ শাস্তির আবেদন করবে।

লেখক : প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিস, ফরিদাবাদ মাদ্রাসা, মহাসচিব, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর